শনিবার, ০৭ অক্টোবর, ২০১৭, ০৯:১৩:২১

‘এখন কী করে খামু, কী দিয়া শোধ করমু কিস্তি’

‘এখন কী করে খামু, কী দিয়া শোধ করমু কিস্তি’

প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে : ‘এখন কী করে খামু, কী দিয়া শোধ করমু কিস্তি! অরা ১০ তলা অবৈধ বিল্ডিং ভাংবার পারে না, খালি জুলুম এই গরিবের উপর।’ কয়েক জন রিকশাচালক শত শত মানুষের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন।

ঘটনার দিন সকালেও তারা জানতো না একটু পরে তাদের উপার্জনের শেষ সম্বলটি পুলিশের হাতে গুঁড়ো হয়ে ধুলায় মিশে যাবে। বগুড়ার সাতমাথায় পিষ্ট হবে ঋণের টাকায় কেনা রিকশাটি। গরিবের বাহন রিকশা। চালক-মালিক সবাই নিম্ন আয়ের।

শহরের রাস্তায় তাদের রিকশার চাকা ঘুরলেই মোড়ে মোড়ে চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা তোলে রাজনৈতিক দলের নেতার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের লোকজন। প্রকাশ্যে চাঁদা তুলতে দেখা যায় এই গরিব মানুষগুলোর কাছ থেকে। দিনে  একশ’ টাকার বেশি বিভিন্ন মোড়ে তাদের থেকে এসব চাঁদা তোলা হয়।

রিকশা চালকের ঘাম ঝরা টাকা প্রকাশ্যে এক শ্রেণির পরিচিত মুখ নিয়মিত চাঁদা তুললেও এসব চাঁদাবাজদের ঠেকানোর মতো কাউকে দেখা যায়নি। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বরতরাও সুযোগ পেলেই চাঁদা তোলে রাস্তার কর্মীদের থেকে।

বগুড়ার আলোচিত তুফান সরকার অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করতো। তার শতাধিক কর্মী বগুড়া শহরের অর্ধশত স্পর্টে নিয়মিত টাকা তুলতো। তুফানকে চাঁদা দেয়ায় শহরে নির্বিঘ্নে চলতো এসব ব্যাটারি রিকশা। পৌরসভা কিংবা পুলিশ প্রশাসন কখনোই এসব রিকশা চলাচলে বাধা দিতো না।

সম্প্রতি তুফান সরকার সম্ভ্রমহানীর মামলায় গ্রেপ্তার হলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ২০ হাজার রিকশাচালক। মাসখানেক তারা চাঁদা ছাড়াই শহরের অলিগলিতে রিকশা চালায়। তুফানের অনুপস্থিতিতে পুলিশ এসব অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য লোক দেখানো আটক শুরু করে।

গত দুই সপ্তাহে কয়েক শ’ অটোরিকশা আটকে রাখে পৌর এবং পুলিশ প্রশাসন। চালকরা অভিযোগ করছে তুফানকে যে চাঁদা দেয়া হতো সেই চাঁদা প্রশাসনকে দিলে অবৈধ এসব রিকশা বৈধ হয়ে যাবে।  

শহরের যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে বগুড়া জেলার পুলিশ এবং পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে বুধবার একরকম পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় ব্যাটারিচালিত কয়েক ডজন রিকশা।

এদিকে রিকশা আটক এবং তা গুঁড়িয়ে দেয়ায় মর্মাহত হয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সুভাষ চন্দ্র নামের এক অটোরিকশাচালক মারা যান। তার বাড়ি শহরের নাটাইপাড়া এলাকায়।

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এনজিও থেকে লোন নিয়ে সবেমাত্র ওই অটোরিকশাটি কিনে ছিলেন সুভাষ। তার ছেলে দাবি করে তার বাবার একমাত্র আয়ের উৎস রিকশাটি হারিয়ে তিনি বুধবার বিকালে স্ট্রোক করেন। ওইদিন সন্ধ্যায় তিনি মারা যান।  

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বগুড়া শহরকে যানজট মুক্ত করতে সম্প্রতি রিজিওনাল ট্রাফিক কমিটির (আরটিসি) বৈঠক হয়। বৈঠকে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজিচালিত রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশাসহ সব ধরনের অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়।

সেই সিদ্ধান্তের আলোকে শহরের সাতমাথায় অভিযান চালিয়ে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ এবং পৌর প্রশাসন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত রিকশার মালিক, চালকরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা অভিযোগ করেন এসব অটোরিকশা যারা তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালিয়ে অভিযানের নামে গরিবের ওপর জুলুম করেছে প্রশাসন।

এই ঝটিকা অভিযান চালানোর ঘটনায় বগুড়ার সর্বস্তরের  পেশাজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ বলছে গরিবের এসব রিকশা গুঁড়িয়ে প্রশাসন রীতিমতো তাদের পেটে লাথি মেরেছে।

জানা গেছে, সমপ্রতি বগুড়ার সিভিল, পুলিশ প্রশাসন, বিআরটিএ ও বগুড়া পৌরসভার যৌথ সিদ্ধান্তে বগুড়া পৌর এলাকায় সকল ব্যাটারি চালিত যানবাহন (অটোরিকশা ও ইজিবাইক), রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজিচালিত সবুজ সিএনজি চলাচল কড়াকড়িভাবে বন্ধ করার বিষয়টি আলোচিত হয়।

কিন্তু ব্যাটারিচালিত যানবাহন (অটোরিকশা ও ইজিবাইক),  রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজিচালিত সবুজ সিএনজি চলাচল কড়াকড়ি ভাবে বন্ধ করার বিষয়টি সিদ্ধান্ত  নেয়া হলেও বুধবার বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে শুরু হয় অটোরিকশা আটক, ভাঙচুর ও গুঁড়িয়ে দেয়ার অভিযান।

শুধু হাতুড়ি ও হ্যামার দিয়েই নয় রীতিমতো বুলডোজার এনে ভাঙা হয় রিকশাগুলোকে। রিকশা আটক ও ভাঙচুরের ঘটনা দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় জমায় শত শত উৎসুক মানুষ। আর যাদের রিকশা ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় তারা এসময় ভেঙে পড়েন কান্নায়।

ডুকরে ডুকরে কেঁদে রিকশাচালকরা জানান, ‘এখন কি করে খামু, কি দিয়া শোধ করমু কিস্তি! অনেকেই অসুস্থও হয়ে পড়েন এসময়। আর্তনাদ করে তারা বলেন, ‘অরা ১০ তলা অবৈধ বিল্ডিং ভাঙবার পারে না, খালি জুলুম এই গরিবের ওপর, যত বাহাদুরি এই গরিবের সঙ্গেই।’ এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে