সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ০৮:৪১:৩৭

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে কৃষকের স্বপ্ন ভঙ্গ

কালবৈশাখীর তাণ্ডবে কৃষকের স্বপ্ন ভঙ্গ

বগুড়া থেকে: মাত্র কয়েকদিন আগেই মাঠে মাঠে সোনালী ধানের শীর্ষ বাতাশে দোল খাচ্ছিল। সেই দৃশ্য দেখে কৃষকের মন নেচে উঠেছিলো। কেউ কেউ ধান কাটা শুরু করেছিলেন। অন্যরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল ধান কেটে গোলায় তোলার। ঠিক সেই মুহুর্ত্বে এসে বাঁধসাদলো কালবৈশাখী ঝড়। কৃষকের সোনালী স্বপ্ন এক রাতেই মাটিতে মিশে গেলো। হতাশায় নিমজ্জিত এখন কৃষক।

টানা ছয়দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়েই আকাশে মেঘের ঘটঘটা। সকাল রাতে নিয়মিতই ঝড়ছে বৃষ্টির পানি। সাথে দমকা হাওয়া। কখনো কখনো পড়ছে শীলাবৃষ্টি। বিশেষ করে গত ২৫ এবং ২৬ এপ্রিল বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে ব্যাপক শীলাবৃষ্টি হয়। এতে মাঠে থাকা পাকা আধাপাকা বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শুধুমাত্র বগুড়া জেলাতেই ১৮০০ হেক্টর জমির বোরো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কৃষি অফিস বলছে আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যে যদি জমি থেকে পানি নেমে না যায় তাহলে এসব জমির ধান পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে।

এদিকে প্রায় জমিতে পানি আটকে থাকায় ধান কাটতে পারছে না কৃষকরা। একবারে সবার জমির ধান মাটিতে শুয়ে যাওয়ায় ধানকাটা শ্রমিকের সংকটও দেখা দিয়েছে চরমভাবে। সব মিলেই এই অঞ্চলের কৃষকদের মাথায় হাত ঠেকেছে। এ যেন তীরে এসে তরি ডোবার অবস্থা হয়েছে।

এদিকে কৃষি অফিস থেকেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলেতে পাইকিং করে ৮০ভাগ পেকেছে এমন ধান কাটার জন্য বলা হচ্ছে। ফলে চাষিরা এক জোগে ধান কাটতে মাঠে নেমেছে। এতে এই অঞ্চলে চরম শ্রমিক সংকটে পড়েছে। শুকনা জমিতে একজন শ্রমিকের কাজের মাজুরি ৬০০টাকা আর জমিতে পানি থাকলে ৭০০টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে একজন শ্রমিক। বেশি মজুরির দেওয়ার পরেও চাহিদা অনুযায়ী ধানকাটা শ্রমিক মিলছে। বাধ্য হয়ে জমির মালিকরাই কাস্তেম হাতে তুলে নিয়েছে। নিজের ধান নিজেরই কাটতেছে।

কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে বর্তমানের পাকা ধান মাঠে আছে ৫লাখ হেক্টর জমির বেশি। সপ্তাকানেকের মধ্যে আরো ৫লাখ হেক্টর জমির মত ধান একবারে পেকে যাবে। সোমবার পর্যন্ত এঅঞ্চলে ২৫ভাগ ধান কাটার হয়েছে। আরো ৭৫ ভাগ ধান জমিতে আছে। এতে শ্রমিকের সংকট আরো তিব্র আকার ধারণ করবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বটতলা বাজার এলাকার বোরো চাষি মোন্তাছির রহমান, আনসার আলী, পচাবস্তা গ্রামের আমজাদ হোসেন জানায়, স্থানীয় তেনাছিরা বিলের বেশির ভাগ ধান মাঠে পেকে আছে। বৃষ্টি বাতাশের আতঙ্কে ভুগছেন এখনকার চাষিরা। তারা বলছে ধানকাটা শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমতে কমতে প্রায় শুণ্যের কোঠায় চলে এসেছে। এই এলাকায় যে কয়জন ধানের কাজ করে তাদের সিরিয়াল পাওয়াই মুশকিল।

এদিকে নওগাঁর আত্রাই, রানী নগর, বগুড়ার নন্দিগ্রাম, কাহালু, আদমদীঘি, দুঁচাচিয়া, শিবগঞ্জ, সোনাতলা, জয়পুর হাটের কালাই এলাকায় গিয়ে চোখে পড়েছে মাঠের পাকা ধান কাটা নিয়ে কৃষকের করুণ অবস্থা।

অপর দিকে মাঠে ধানকাটা শুরু হওয়ার পাশাপাশি চালু হয়েছে হাসকিং চালকলগুলো। মিলে চাল যাওয়া চাতালগুলো সরব হয়ে উঠেছে। এই চালগুলোতেও একটা বড় অনেক শ্রমিক কাজ করে। মাঠের পাশাপাশি চাতালগুলোতে শ্রমিকের সংকট সমান আকাড়ে দেখা দিয়েছে।

দুপচাঁচিয়া উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক হোসেন, চাতাল মালিক আবু কালাম আজাদ জানান, গত তিন চার বছর ধরে ভরা মৌসুমে তারা শ্রমিক সংকটে ভোগেন। একারণে চাহিদা অনুযায়ী তারা উৎপাদ করতে পারেন না। এর ফলে অনেকে সময় লোকসানের শিকার হতে হয়।

তারা আরো জানান, মৌসুম শুরু হওয়ার ১মাস আগেই শ্রমিকদের আগ্রিম টাকা দিয়ে বুক দিতে হয়। এখানে গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, নলডাঙ্গা, রংপুরের পীরগাছা, চৌধুরানী এলাকার শ্রমিকরা কাজ করে। বর্তমানে চাতাল শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক কমেছে।

২০ বছর আগে উত্তরে মোট কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিলো ৮০ লাখের বেশি। এখন নিয়মিত কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা নেমে এসছে ১০ লাখে। এই ১০ লাখ শ্রমিকের অর্ধেক দেশের পূর্ব, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বোরো কাটা মাড়াইয়ের কাজে গেছে। ফলে মাত্র ৫ লাখ শ্রমিক এখন কাজ করছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা জুড়ে।

এবার বগুড়া কৃষি অঞ্চলের চার জেলায় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্র ছিলো ৪লাখ ৪৮ হাজার৭৪১ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে তার চেয়েও বেশি। ৪লাখ ৫৯ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে। চাল আকারে উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭লাখ ৮৬হাজার ৯৪ মে.টন।

এদিকে বিগত কয়েক বছরের মধ্যে কৃষকরা ভরা মৌসুমে ভালো দাম পায়নি। এবার ধানের বাজারের দৃশ্য ভিন্ন। উত্তরের বিভিন্ন জেলার হাট বাজারের চিকন ধান কাচা ৮০০ টাকা মণ, শুকনা ৯০০-৯৫০ ও মোটা ধান কাচা ৬৫০ টাকা মণ, শুকনা ৭০০-৭৫০ দরে বিক্রি হচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো ধান। বগুড়া কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১৭ লাখ ৬২৯ কৃষক পরিবার এই ফসলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। বোরো চাষের উপর নির্ভর করে এই অঞ্চলের অর্থনীতি। বগুড়া কৃষি অঞ্চলের চার জেলায় প্রান্তিক চাষী পরিবার প্রায় ৬ লাখ ৮১হাজার ৪৭১জন। ক্ষুদ্র চাষী পরিবার ৩ লাখ ৯৪হাজার ৫১, মাঝারী কৃষি পরিবার ১ লাখ ৬৩হাজার ৩৮৩, বড় ২৯ হাজার ৮৯৪ পরিবার। বর্গা চাষী পরিবার প্রায় ৫০ হাজার।

এবিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার মুহা: মশিদুল হক বলেন, ঝড় বৃষ্টিতে বেশকিছু পাকা-অধাপাকা ধান মাটিতে পড়েছে। এরমধ্যে কৃষকরা পাকা ধান কাটা শুরু করেছে। তিনি আরো জানান, যেসব জমিতে পানি আটকে আছে সেই পানি যদি আগামী ৪-৫দিনের মধ্যে নেমে না যায় তাহলে ধান পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার জানান, চলতি বৈরী আবহাওয়ার ফলে এই অঞ্চলের বোরো ধান হুমকির মধ্যে আছে। ফলে কৃষকদের বলে দেয়া হচ্ছে যেসব জমির ধান ৮০ভাগ পেকেছে সেব জমির ধান দ্রুত কেটে ফেলতে।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে