সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭, ০৯:০৪:০১

হোসেন মাস্টার আজ উন্মাদ ‘আঁর বউ, তিন পোয়ারে জরাই দিয়্যে মগ’

হোসেন মাস্টার আজ উন্মাদ ‘আঁর বউ, তিন পোয়ারে জরাই দিয়্যে মগ’

কক্সবাজার: ৫৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা আলী হোসেন (ডানে) ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মিয়ানমার সেনারা তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করার পর তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এখন কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁর শিকলে বাঁধা জীবন।

দুটি কলা এগিয়ে দিয়েছিলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের মেডিক্যাল ক্যাম্পের ডা. মোহাম্মদ আলম। আলী হোসেন গোগ্রাসে খেয়ে ফেলেন কলা দুটি।

এক বোতল পানীয় এগিয়ে দিতেই আলী হোসেন বলে ওঠেন, ‘আমাকে একটা বিড়ি দেন। ’ বিড়িতে টান দেওয়ার পরই বলতে থাকেন, ‘মগ বাহিনী আঁর বউরে জরাই (জবাই) দিয়্যে। ইতারা আঁর তিন পোয়ারেও জরাইয়ে। ’ অর্থাৎ মিয়ানমারের মগ (রাখাইন) সন্ত্রাসীরা আমার স্ত্রীকে জবাই করে দিয়েছে। তারা জবাই করে দিয়েছে আমার একে একে তিন সন্তানকেও। তাদের সবার নামও একে একে বলে যান তিনি। এই বলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আলী হোসেন। আরো কিছু জানতে চাইলে কেবলই বলে ওঠেন, ‘মগে আঁর সুফিয়ারে (স্ত্রী) জরাইয়্যে, আঁর হাসানরে জরাইয়্যে, হোসেনরে জরাইয়্যে, নুর হোসেনরেও জরাই দিয়্যে। ’ রাখাইন রাজ্যের মানুষ গড়ার কারিগর আলী হোসেন মাস্টার এখন কক্সবাজারে নিজেই শিকলে বাঁধা। নিজের চোখে দেখা সহিংসতার আঘাতে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

এক হাতে শিকল দিয়ে বেঁধে তালা লাগানো। শিকলের অন্য দিক ধরে বড় বোন মরিয়ম খাতুন ছোট ভাইকে টেনে আনেন মেডিক্যাল সেন্টারে। আনমনে কী যেন আউড়াচ্ছিলেন শিকলে বাঁধা মানুষটি। গতকাল রবিবার উখিয়ার কুতুপালং এক নম্বর শিবিরের টিভি টাওয়ার পাহাড়ের এক মেডিক্যাল ক্যাম্পে দেখা যায় এ দৃশ্য। রোহিঙ্গা আলী হোসেন। বয়স ৫০। আরাকান রাখাইন রাজ্যের বুচিদং শহরতলির চৈতাপাড়ার বাসিন্দা আলী হোসেন পেশায় ছিলেন শিক্ষক। আরবি, বার্মিজ ও ইংরেজি শিক্ষার আলো ছড়াতেন তিনি। এলাকার মানুষ তাঁকে এক নামে চিনত মাস্টার সাহেব নামে। মিয়ানমারের সরকারি শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন।

আলী হোসেন মাস্টারের পাড়ালিয়া রাখাইনের বুচিদং চৈতাপাড়ার বাসিন্দা মাওলানা আবুল কাশেম  বলেন, ‘২৫ আগস্ট মগ সেনাদের অত্যাচার-নিপীড়নের কদিন পরের ঘটনা। দুপুর বেলায় সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীরা পাড়াটি ঘিরে ফেলে। পাড়ার লোকজন যার যার ঘর থেকে বের হয়ে পালাচ্ছিল। অমনি ঘরের উঠানে রাখাইন সন্ত্রাসীরা তাদের পেয়ে বসে। ’ মাওলানা আবুল কাশেম জানান, মগ সন্ত্রাসীরা আলী হোসেন মাস্টারের চোখের সামনেই তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় আলী হোসেন মাস্টার তাদের উদ্ধারে এগিয়ে গেলে মগ সন্ত্রাসীরা তাঁর মাথায় আঘাত করে। সেই আঘাতে আলী হোসেন মাস্টার পড়ে যান। এর পরপরই মগ সন্ত্রাসীরা ধারালো দা দিয়ে একে একে আলী হোসেন মাস্টারের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, তিন ছেলে যথাক্রমে হাসান, হোসেন ও নুর হোসেনকে জবাই করে দেয়।

আলী হোসেন মাস্টার মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে ঢলে পড়ায় মগ সন্ত্রাসীরা মনে করেছিল তিনি মারা গেছেন। আলী হোসেন মাস্টার দীর্ঘক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে যখন দেখেন স্ত্রী-সন্তানদের জবাই করা লাশ পড়ে আছে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেই নির্মম ঘটনার পর থেকেই আলী হোসেন রাখাইনের পাহাড়ে পাহাড়ে সময় কাটিয়েছেন। কেউ এগিয়ে খাবার দিলে খেয়েছেন। নতুবা কাটিয়েছেন উপোস। তাঁর বড় বোন মরিয়ম খাতুন ছয়-সাত বছর আগে পালিয়ে এসেছিলেন, আছেন কুতুপালং শিবিরে। মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই আলী হোসেন স্ত্রী ও তিন পুত্রসন্তানকে হারানোর পর থেকে পাগল হয়ে গেছে। মাত্র চার দিন আগে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে এখানে আসে। আমাদের গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আবুল কাশেম আমার ভাইকে এখানে নিয়ে এসেছেন। ’

কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে বড় বোনের বস্তিঘরেই শিকলে বাঁধা জীবন কাটছে আলী হোসেনের। বস্তির সর্দার রোহিঙ্গা হামিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাইরে বড়ই নির্মম ঘটনা। যে লোকটা আরাকানে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিল, যে কিনা ঘরে ঘরে আলোকিত মানুষ গড়ছিল, তাকেও অং সান সু চি পাগল করে ছেড়েছে। ’ স্ত্রী-সন্তানসহ আপনজন হারানো এ ধরনের অপ্রকৃতিস্থ আরো অনেক রোহিঙ্গা রয়েছে শিবিরে—জানান রোহিঙ্গা সর্দার হামিদ।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে