শুক্রবার, ০৬ জানুয়ারী, ২০১৭, ০১:৩০:২০

এমপি লিটন হত্যা : ঘনিষ্ঠজন ও জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ঘিরে তদন্ত

এমপি লিটন হত্যা : ঘনিষ্ঠজন ও জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ঘিরে তদন্ত

আহমদুল হাসান আসিক ও গোবিন্দলাল দাস : গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য (এমপি) মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের কানেকশনের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, পাঁচটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত শুরু করলেও এখন তারা এই দুটি কারণকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

লিটনের মৃত্যুতে কার লাভ ও কার ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন, লিটনের পর কে সরকারি দলের টিকিটে সুন্দরগঞ্জের এমপি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন।

এতে করে জামায়াত-শিবিরের কোনো লাভ হবে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সময় লিটনের বাড়িতে উপস্থিত তার শ্যালক বেদারুল আহসান বেতারের মোবাইলের কললিস্ট পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি কার সঙ্গে কথা বলেছেন ও কী কথা বলেছেন তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারিতে রেখেছে।

এদিকে এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর আলহাজ ইউনুস আলীর ছেলে জামায়াত-শিবির ক্যাডার শহিদুল ও আশরাফুল বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

হত্যাকাণ্ডের সময় লিটনের বাড়িতে উপস্থিত কাজের লোক, তার আত্মীয়সহ কমপক্ষে সাতজনের জবানবন্দি রেকর্ড করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বুধবার নেয়া জবানবন্দিতে রহস্য উন্মোচনে কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি, লিটনের ছেলে সাকিব সাদমান রাকিনসহ লিটনের পরিবারের সদস্যরা গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় পৌঁছেছেন। ওই বাড়িটিতে অবশ্য তারা আগেও নিয়মিত থাকতেন না। বিশেষ কাজে যেতেন। এমপি লিটন রাজনৈতিক কাজে সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে অবস্থান করছিলেন, তার স্ত্রীও সে সময় গিয়েছিলেন।

লিটন হত্যার তদন্তের বিষয়ে ও গাইবান্ধায় বিভিন্ন সময় জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের বিষয়ে বুধবার ভিডিও কনফারেন্সে জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, এমপি লিটন হত্যার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কারও বিষয়ে তথ্য পেলেই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে ঘুরেফিরে এমপির স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি ও তার পরিবারের রহস্যজনক ভূমিকা সামনে আসছে। লিটনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তার হত্যার পেছনে পরিবারের কেউ জড়িত কিনা এবং তাদের কারও জামায়াত কানেকশন রয়েছে কিনা তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। খুনিদের কাউকে লিটনের পরিবারের সদস্যরা চিনত কিনা- এ বিষয়টি জানার চেষ্টা করছেন তারা।

তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সুন্দরগঞ্জের সাবেক এমপি ও জামায়াত নেতা আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়া আজিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাগির আলী বিহারির সঙ্গে লিটনের স্ত্রীর ব্যবসায়িক লেনদেন রয়েছে। এক বছর ধরে এমপি লিটনের সঙ্গে সাগির আলী বিহারিরও সখ্য গড়ে ওঠে।

লিটনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে ওই বিহারির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এক বছর ধরে লিটনের সঙ্গে থেকে ঠিকাদারির অনেক কাজ নেন তিনি। এমপির স্ত্রী স্মৃতির সঙ্গে বিহারির লেনদেনের সম্পর্ক আছে। ঘোড়া আজিজ যখন এমপি ছিলেন তখন তিনি সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তদন্তে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।

লিটন এমপি হলেও সুন্দরগঞ্জের রাজনীতিতে তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া লিটনের ছয় ভাইবোন কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তারা সবাই গাইবান্ধার বাইরে থাকেন। লিটন না থাকলে তার পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ স্ত্রীর হাতে চলে আসবে। তাছাড়া সুন্দরগঞ্জে ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির হাতে রয়েছে। এসব বিষয়কে তদন্তকারীরা গুরুত্ব দিচ্ছেন।

ঘটনার কিছুক্ষণ আগে রহস্যজনকভাবে বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে লিটনের স্ত্রী কাকতালীয় বললেও গোয়েন্দারা এটির আরও গভীরে যেতে চান। এদিকে এমপির শ্যালক বেদারুল আহসান বেতারকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারিতে রেখে পর্যবেক্ষণ করছে। বেদারুল ঘটনার আগে ও পরে মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে কী কথা বলেছেন তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ধারণা, লিটনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি চলে আসবে। সরকারি দলের টিকিটে তার এমপি হওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। এ ক্ষেত্রে লিটনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রভাব তৈরি হবে। তার হত্যার পেছনে এসব ফ্যাক্টর কাজ করেছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে এখনই এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

ঘটনার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের একটি বিশেষায়িত সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ১৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বামনডাঙ্গায় একটি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করেছিলেন লিটন। এ প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির হাতে।

তদন্তকারীরা এখন এ বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখতে চান, এমপি লিটনের মৃত্যুতে তার স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন কতটা লাভবান হয়েছেন এবং এতে করে জামায়াত-শিবির কতটা লাভবান হয়েছে। এমপি হত্যার পেছনে এই দুটি ফ্যাক্টর একসঙ্গে কাজ করেছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে তদন্তে এসব বিষয় গুরুত্ব দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত খুনের নেপথ্যে কারা রয়েছে এবং তাকে কেন খুন করা হয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

সাতজনের বক্তব্য রেকর্ড করেছে পিবিআই : বুধবার দুপুরে লিটনের বাড়ির তিন কেয়ারটেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র, এমপির ছেলের বডিগার্ড সাজেদুল ইসলাম, এমপির ভাগ্নি মারুফা সুলতানা শিমু, এমপির চাচি শামীম আরা আইনী ও একজন কাজের লোকের বক্তব্য রেকর্ড করেছে পিবিআই।

পিবিআই সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সময় কার কী ভূমিকা ছিল এসব বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। এখন এসব বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।

তদন্তে অগ্রগতি হচ্ছে : বুধবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্স থেকে ফেরার সময় ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি এবং অগ্রগতির খবর নিচ্ছি।’ তিনি আরও জানান, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন হত্যা মামলা তদন্তের অগ্রগতি হচ্ছে। শিগগির খুনিরা ধরা পড়বে এবং খুনের প্রকৃত তথ্যও জানা যাবে।

হত্যাকাণ্ডে পারিবারিক কোন্দলের ভূমিকার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ডেপুটি স্পিকার বলেন, এটা দুর্বৃত্তদের একটি অপপ্রচার এবং খুনের ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

লিটনের বাড়ির সবাই ঢাকায় : এমপি লিটন হত্যার তিন দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর মঙ্গলবার কুলখানি অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠান শেষেই লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি ও তার একমাত্র সন্তান সাকিব সাদমান রাতিন, ঢাকা থেকে আগত লিটনের বোন ও আত্মীয়স্বজন মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় চলে যান।

উপজেলা জামায়াতের আমীরের দুই সন্তান পলাতক : এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর আলহাজ ইউনুস আলীর ছেলে জামায়াত-শিবির ক্যাডার শহিদুল ও আশরাফুল বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। পলাতক এই দু’জন সুন্দরগঞ্জের একাধিক নাশকতা ও ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি সংঘটিত বামনডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাওয়ে ৪ পুলিশ পিটিয়ে হত্যা মামলার মূল আসামি। বিভিন্ন সূত্র থেকে আশংকা করা হচ্ছে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদেরও যোগসূত্র থাকতে পারে।

জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের বিচার হয়নি এখনও : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, পলাশবাড়ী, সাদুল্যাপুর, গোবিন্দগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতা, খুন, রাহাজানি, পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র ঘেরাও করে পুলিশ হত্যা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা ও অগ্নিসংযোগের মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাইবান্ধায় ২২ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

আলোচিত ৪ পুলিশ হত্যা, সুন্দরগঞ্জের গংসারহাটে আওয়ামী লীগ সমর্থক রিকশাচালক শরিফুলকে জিভ কেটে হত্যা, একই উপজেলার ডোমেরহাটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা খলিলুর রহমান মামুন হত্যা, সাঘাটার বুরুঙ্গিতে রেলে সহিংসতা চালিয়ে ৪ যাত্রী হত্যা, পরবর্তী সময়ে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে গাইবান্ধার তুলসীঘাটে ৯ জন নিরীহ মানুষ হত্যা, গোবিন্দগঞ্জে ব্যবসায়ী তরুণ দত্ত ও মহিমাগঞ্জের দেবেশ প্রামাণিককে হত্যা এবং সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর এমপি লিটনকে হত্যা করা হয়।

বুধবার ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, ২০১৩ সালে এ জেলায় জামায়াত-শিবির জঙ্গিদের যে সন্ত্রাসী তৎপরতা সংঘটিত হয় তাতে ২৩৫ জন আসামিকে গ্রেফতার করে ১৪৯টি মামলা করা হয়েছে।

এ ছাড়া ২০১৪ সালে ১৪৬ জন জামায়াত-শিবির ক্যাডারকে গ্রেফতার করে মামলা দেয়া হয়। কিন্তু এসব মামলার আসামিদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এসব মামলার বিচার এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি।

বামনডাঙ্গায় ছাত্রলীগের প্রতিবাদ সমাবেশ : এমপি লিটন হত্যার প্রতিবাদে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সমাবেশ করেছেন। উপজেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে বুধবার বিকালে বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন চত্বরে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যুগান্তর

০৬ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে