রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:৪১:৩৯

ভয়ঙ্কর খেলায় কিম জং উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প, তীব্র ঝুঁকিতে বিশ্ব

ভয়ঙ্কর খেলায় কিম জং উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প, তীব্র ঝুঁকিতে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের অস্ত্রভাণ্ডারে খুব শিগগিরই যোগ হতে যাচ্ছে দূরপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দিচ্ছেন সামরিক জবাবের হুমকি। ফলে অকস্মাৎ পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি জাগ্রত হয়েছে। বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। দু’পক্ষ থেকেই চলছে তীব্র বাগাড়ম্বর, আর তীব্র ঝুঁকির মুখে বিশ্ব।

মার্কিন রণতরী ও পারমাণবিক সাবমেরিন নোঙর ফেলেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সঙ্গে যোগ দিয়েছে জাপানের রণতরী। কিন্তু টলেনি উত্তর কোরিয়া। গতকালও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি। উৎক্ষেপণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্রটি বিস্ফোরিত হয়ে পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে বটে। কিন্তু পরীক্ষা করাটাই দেশটির নতি না স্বীকার করার লক্ষণ। কিন্তু যুদ্ধের হুমকি আসলে কতটুকু গুরুতর? জার্মানির প্রখ্যাত পত্রিকা দার স্পাইগেল এই প্রশ্নেরই জবাব দিতে চেয়েছে।

ম্যাথিউ ভন রোর, ক্রিস্টফ শিরম্যান, উইল্যান্ড উইগন্যার ও বার্নার্ড জ্যান্ড- দার স্পাইগেলের এই চার সাংবাদিকের লেখা এক বিশ্লেষণী নিবন্ধে বলা হয়, মহাপ্রলয়ের মহড়া অনেকদিন ধরেই চলছিল। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর বিকালের শুরুর দিকে সাইরেন বেজে উঠে সিউলে। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ায় গাড়ি-ঘোড়া। বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ব্যস্ত সড়ক মোড়ে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হলদে বাহুবন্ধনী পরা স্বেচ্ছাসেবীরা পথচারীদের নিয়ে যান পার্শ্ববর্তী আশ্রয়স্থলে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী শহরে এমন আশ্রয়স্থলের সংখ্যা আছে কয়েকশ’।

প্রস্তুত সামরিক বাহিনীও। সিউল ও সীমান্তমুখী মহাসড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচটাওয়ার। কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর সড়কের ওপর রাখা আছে কংক্রিটের তৈরি ভারী প্রতিবন্ধক। যুদ্ধ বাধলেই, স্বয়ংক্রিয় বিস্ফোরণ ঘটবে, আর সড়কের ওপর পড়ে যাবে এই প্রতিবন্ধক। ফলে আক্রমণকারীর এগুনোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।

উপকূলবর্তী সমুদ্র সৈকতেও পুঁতে রাখা আছে ট্যাংক-ফাঁদ আর কাঁটাতারের বেড়া। এসব কিছুই করা হয়েছে কোরিয়ান উপদ্বীপের দরিদ্র কিন্তু সামরিকভাবে শক্তিশালী উত্তরের হুমকি থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় অর্ধকে সুরক্ষিত রাখতে। সমস্ত সরঞ্জামই প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর আক্রমণের পরিকল্পনাও আছে। ‘কোরিয়া ম্যাসিভ পানিশমেন্ট অ্যান্ড রিটালিয়েশন’ বা সংক্ষেপে ‘কেএমপিআর’ নামে পরিচিত এই পরিকল্পনা। এর বিস্তারিত গোপন রাখা হয়েছে।

কিন্তু সম্ভাব্য এক কোরিয়ান যুদ্ধের প্রথম দৃশ্যপট হবে এমন: উত্তর কোরিয়া হামলার আগেই দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থলগুলো নিজেদের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দিতে। আর উত্তর কোরিয়ার যেসব ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট ফাঁক-ফোকর দিয়ে উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে, সেগুলোকে ধ্বংস করতে গুলি ছুড়বে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়া তাদের পদাতিক সৈন্যবাহিনীকে দক্ষিণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করানোর আগেই, দক্ষিণের বিশেষ বাহিনী পিয়ংইয়ং-এ ঢুকে শেষ করে দেবে একনায়ক কিম জং উনকে। মোটামুটি এটাই হলো কেএমপিআর পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাথমিক দৃশ্যপট।

ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের তিন সপ্তাহ আগে নববর্ষের দিনে কিম জং উন ঘোষণা করেন যে, তার দেশ শিগগিরই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করবে। এ ধরনের একটি রকেট পৌঁছে যেতে পারে উত্তর আমেরিকা মহাদেশেও। কিমের এই ঘোষণাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর উত্তর কোরিয়ার সরাসরি হামলার সবচেয়ে গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য হুমকি। জবাবে ট্রাম্প এক টুইটে লিখেন, ‘এমনটা কখনই হবে না।’

ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো পিয়ংইয়ং-এর পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। কিন্তু পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ট্রাম্প শুধু অনভিজ্ঞই নন, প্রায়ই তিনি আনাড়িপনার পরিচয় দেন। এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ দেখা গেছে দুই সপ্তাহ আগে, যখন ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, সতর্কতার জন্য তিনি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীকে তিনি উত্তর কোরিয়া অভিমুখে পাঠিয়েছেন। পরে অবশ্য দেখা যায় ওই রণতরী অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাচ্ছিল একটি মহড়ায় অংশ নিতে। হতে পারে ট্রাম্প ধাপ্পাবাজি করেছেন, কিংবা কোনকিছু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এই কমান্ডার-ইন-চিফের অধীনে পরিস্থিতি কোনদিকে ঘুরে যেতে পারে।

বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় জেরবার ট্রাম্প দৃশ্যত উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে বাগাড়ম্বরেই মনোযোগ সরানোর পথ বলে মনে করছেন। এক্ষেত্রে তিনি দৃশ্যত সফলও। তিনি যখন সিরিয়ায় এ মাসের শুরুতে ৫৯টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন, তখন খোদ তার সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন ট্রাম্প।

ফলে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রকল্প এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প- এ দুয়ের অর্থ হলো, ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং-এর বিবাদ এক নতুন ও অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতীতে সংঘাতের এমন সমূহ ঝুঁকি সৃষ্টির নজির বেশ বিরল। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, কোরিয়ান উপদ্বীপে যেকোনো যুদ্ধ পারমাণবিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে। জড়িয়ে পড়তে পারে কয়েকটি বৃহৎ আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্র। এ যুদ্ধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চেয়েও বেশি পরিমাণ মানুষ শরণার্থী হবে।

চীনের তীব্র আপত্তির মুখেও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন থাড আকাশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েনের কাজ শুরু হয়েছে। সংঘাতের আরো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এ সপ্তাহে। মঙ্গলবার, ইউএসএস মিশিগান নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ১৫০টি টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রধারী পারমাণবিক সাবমেরিন দক্ষিণ কোরিয়ায় থেমেছে। এটি মোতায়েন করা হয়েছে ২৫শে এপ্রিল, যেদিন উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি স্রেফ রুটিন কাজ, কিন্তু পিয়ংইয়ং একে অন্যভাবে নিতে পারে। একই দিনে উত্তর কোরিয়াও এক বিশাল আর্টিলারি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। সেদিন অস্বাভাবিকভাবে ট্রাম্প সিনেটের প্রত্যেক সদস্যকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য জানাতে।

কোরিয়ান উপদ্বীপে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বসবাস। এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, বিশ্বের তিন শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান যদি কোনো সংঘাতে জড়িয়ে যায়, তবে বিশ্ব কেবল বিপর্যয়কর এক মানবিক পরিস্থতিই প্রত্যক্ষ করবে না, অর্থনৈতিক ধস হতে পারে বিশাল। এমনকি রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাহলে কি কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের পর পৃথিবী আরো একবার পারমাণবিক যুদ্ধের সম্মুখীন? উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্প থামাতে বছরের পর বছর বিপল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর সামরিক সংঘাত কি অনিবার্য?

৩০ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে