বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৭, ০৮:৪৭:৪৭

মার্কিন হুমকির পর পাকিস্তানের পাশে থাকার যে ঘোষণা দিলো চীন

মার্কিন হুমকির পর পাকিস্তানের পাশে থাকার যে ঘোষণা দিলো চীন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন আফগান নীতি ঘোষণার সময় পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদীদের ‘নিরাপদ স্বর্গ’ এবং ‘গণ্ডগোলের এজেন্ট’ আখ্যা দিয়ে পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছিলেন। একই সাথে আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব বাড়ানোর কথাও বলেছেন।

এ বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে চীন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব তাহমিনা জানজুয়ার সঙ্গে বৈঠক করে চীনের সমর্থনের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

চীনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ওয়াং ও তাহমিনা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুই দেশ একে অপরকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করার কথা বলেন।

এ সময় তারা আফগানিস্তান-চীন-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ত্রিদেশীয় ফোরামের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গত জুনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলামাবাদ সফরকালে এ ফোরাম গঠিত হয়।

ত্রিদেশীয় এ ফোরামের মাধ্যমে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতার বিষয়কে স্থায়ীত্ব দেয়া হয়েছে।

বৈঠককালে ওয়াং ও তাহমিনা চীন-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যু এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

এদিকে এই দুই কর্মকর্তার বৈঠকের আগে ট্রাম্পের পাকিস্তান বিরোধী বক্তব্যের নিন্দা করে মুখ খোলেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চ্যুনিং।

তিনি বলেন, পাকিস্তান সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্য প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলতে চাই, পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এ দেশের ‘মহান আত্মত্যাগ’ রয়েছে এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ’ অবদান’ রেখেছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে পাকিস্তানের প্রচেষ্টাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেবে আন্তর্জাতিক মহল।

তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে আমেরিকা ও পাকিস্তান সন্ত্রাস দমনে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রাখবে, এমনটা দেখতেই ভাল দেখায়।

পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপে ভারত বেশ উচ্ছসিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ভারত-মার্কিন বিরোধী অবস্থানের বিপরীতে চীন-পাকিস্তান-রাশিয়ার অক্ষ শক্তির ধারনাকে শক্তিশালী করতে পারে। ভারতের জনমানসে পাকিস্তানের সাথে লড়াইয়ে যে ধরনের উত্তেজনা থাকে চীনের সাথে লড়াইয়ের প্রশ্ন এলে তাতে আবেগের মাত্রা কমে যেতে থাকে। এর কারণ ভারতের দু’টি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পেছনে ভারতের প্রধান ভূমিকা। ভারত এই যুদ্ধকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে দেখে থাকে। অপর দিকে, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।

চীন এখন বিশে^র এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সামরিক দিক দিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। কিন্তু এর পরও ভারতের মধ্যে চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাসনা গোপন থাকে না। এর প্রকাশ শুধু পাকিস্তানের সাথে বিরোধের মধ্যে ঘটে থাকে তা নয়, ভিয়েতনামের সাথে চীনের সামরিক সম্পর্ক কিংবা আসিয়ান দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের মধ্যে ফুটে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার হওয়ার পর ভারতের আমলাতন্ত্র ও নন স্টেট অ্যাক্টরদের মধ্যে আত্মবিশ^াসের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, আঞ্চলিক শক্তি থেকে ভারতকে সুপার পাওয়ার ভাবতে শুরু করেছে।

ভারতের এই মনোভঙ্গি চীন ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এর ফল হিসাবে ভারত যতটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ট হয়েছে, চীন ততটাই পাকিস্তানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১০ বছরের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের এপ্রিলে দুদেশের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের ব্যাপারে দু’দেশ চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এই চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সাথে পাকিস্তান জানিয়ে দেয় চীনের সাথে একই ধরনের চুক্তি আগেই পাকিস্তান স্বাক্ষর করেছে। পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর থেকে কাশ্মিরের সীমান্তঘেঁষা গিলগিট বাল্টিস্থান হয়ে চীনের কাশগড় পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপন নিয়ে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। ভারত মনে করে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর থেকে চীন যে রাস্তা নির্মাণ করছে এর সামরিক গুরুত্ব ভারতকে কোণঠাসা করে ফেলবে। ভারতের এই উদ্বেগ নরেন্দ্র মোদির পাকিস্তান নীতিকে প্রভাবিত করছে। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।


পাকিস্তান দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ করে আসছে, ভারত বেলুচিস্তানের বিদ্রোহীদের সহায়তা দিয়ে আসছে। মোদির এই ঘোষণার পর বালুচ বিদ্রোহীদের সাথে ভারতের সম্পর্কের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলুচিস্তানের নিরাপত্তা শুধু পাকিস্তান নয় চীনের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তানে চীন যে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে তার বড় অংশ বেলুচিস্তানকেন্দ্রিক। এছাড়া বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর থেকে চীন সহজে আরব সাগরে প্রবেশের সুযোগ পাবে। এ ছাড়া বেলুচিস্তানে অস্থিরতায় ভারতের ভূমিকায় ইরানও উদ্বিগ্ন। কারণ বেলুচিস্তানের একটি অংশ ইরানে। স্বাধীন বেলুচিস্তানের যেকোনো প্রচেষ্টা ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকি।

ফলে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন পাকিস্তানের সাথে চীনের কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের পথকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বেশকিছুদিন থেকেই চীনের ভূমিকায় ভারতের হতাশা বাড়ছে। নিউক্লিয়ার্স সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের সদস্যপদ লাভের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছে চীন। পাকিস্তান এই গ্রুপের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করছে গত মে মাসে। তাতে চীন ও তুরস্ক সমর্থন দিয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনায় পাকিস্তানের প্রতি চীনের প্রকাশ্য অবস্থান এই কৌশলগত সম্পর্কের অংশ মাত্র।

এর আগে কাশ্মির ইস্যুতে ভারত যখন পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে চাপের ফেলার চেষ্টা করছে, তখন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী মহড়া শুরু করে। পাকিস্তানের এফ-১৬ জঙ্গিবিমান লাহোর থেকে রাওয়ালপিণ্ডি পর্যন্ত মহাসড়কে ওঠানামার মহড়া দেয়। এই মহাসড়কটি চীনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৭৫ কিলোমিটারের এই মহাসড়কটি পাকিস্তান বিমানবাহিনী রানওয়ে হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ভারতের বিমানবাহিনী তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।

ইকোনমিস্ট এক বিশ্লেষণে জানাচ্ছে, ভারতীয় অস্ত্রসজ্জায় বড় ধরনের ফাঁক আছে। সত্যিকার অর্থেই ভারতের অস্ত্রশস্ত্র পুরনো বা অবহেলিত। ‘আমাদের বিমান প্রতিরক্ষা রয়েছে করুণ দশায়’, ইকোনমিস্টকে বলেন ভারতের সামরিকবিষয়ক ভাষ্যকার অজয় শুক্লা। বিমানবাহিনীতে সক্রিয় ফাইটার যেগুলো দেখা যায়, সেগুলোর সবই ১৯৭০-এর দশকের পুরনো।

চমকপ্রদ নতুন কিছু স্থাপন করতে হয়তো আরো ১০ বছর লাগবে। প্রায় দুই হাজার বিমান নিয়ে কাগজে-কলমে ভারতের বিমানবাহিনী বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রতিরক্ষা প্রকাশনা আইএইচএস জেনসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এগুলোর মাত্র ৬০ ভাগ ওড়ার মতো অবস্থায় আছে। চলতি বছরের প্রথম দিকের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান শাখার গর্ব বিবেচিত ৪৫টি মিগ২-কে বিমানের মাত্র ১৬ ভাগ থেকে ৩৮ ভাগের কাজ করার সামর্থ্য রয়েছে।

বিমানবাহী যে রণতরীটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটি থেকে এসব বিমান উড়বে বলে ধরা হচ্ছে। ওই বিমানবাহী রণতরী ১৫ বছর আগে অর্ডার দেয়া হয়েছিল, ২০১০ সালে উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সরকারি নিরীক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১১৫০টি পরিবর্তনের পর এখন সেটি ২০২৩ সালের আগে পানিতে ভাসবে বলে মনে হচ্ছে না।

ভারতের বিমানবাহিনীর এসব দুর্বলতার দিক সামনে রেখে পাকিস্তান বিমানবাহিনী মহড়া চালায় বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। পাকিস্তানের এসব তৎপরতা ছিল ভারতের ওপর উল্টো চাপ প্রয়োগের কৌশল। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্স থেকে ভারত ৩৬টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করে। এগুলো হাতে আসতে আরো পাঁচ বছর লাগবে। এই ৩৬টি বিমানের দাম পড়বে ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর এতে ফ্রান্সে পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বিপুল অংকের অর্থব্যয় করে এসব যুদ্ধ বিমান কেনা সঠিক কিনা তা নিয়ে ভারতে আগে বিতর্ক ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপমুখী ভারতের এ ধরনের প্রবণতা দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু রাশিয়াকে ভারতের দিক থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন তা আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার জন্য দিল্লিতে যখন ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন আলোচনায় ব্যস্ত, তখন রাশিয়ার ২০০ সৈন্য পাকিস্তানে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়ার জন্য পৌঁছে যায়। ভারতের পক্ষ থেকে দেন দরবার করা হয় যে, রাশিয়া যেন এই সময় পাকিস্তানের সাথে সামরিক মহড়া স্থগিত রাখে।

ভারতের এই অনুরোধে সাড়া দেয়নি রাশিয়া। অবশ্য সাড়া দেয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। উল্টো পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের গিলগিট বাল্টিস্থানে সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে দুদেশের সৈন্যরা। ভারত এই স্থানটিকে বিতর্কিত হিসাবে চিহ্নিত করে। রাশিয়া-পাকিস্তান সামরিক মহড়া এবারই প্রথম হচ্ছে এবং এটি আগে থেকে নির্ধারিত ছিল।

কিন্তু দুদেশের মধ্যে অস্থিরতার মধ্যে এই মহড়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে রাশিয়া ও পাকিস্তান সামরিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর পর থেকে পাকিস্তান রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কিনতে শুরু করেছে। বেশ কিছু এমআই হেলিকপ্টার ও ট্যাংক কেনার বিষয়ে দু’দেশ একমত হয়েছে। রাশিয়া ও চীনের সাথে যখন পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির দূরত্ব বাড়ছে। চীন ও পাকিস্তানের কৌশলগত সম্পর্কের চাপে থাকা ভারতের জন্য পাকিস্তানের সাথে চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা আরো বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে