রবিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৯:৪০:০৩

মীরাক্কেল বিজয়ী বাংলাদেশি তারকারা এখন কোথায়, কেমন আছেন?

মীরাক্কেল বিজয়ী বাংলাদেশি তারকারা এখন কোথায়, কেমন আছেন?

নাহিয়ান ইমন : প্রায় প্রতিবছর কলকাতার জনপ্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডি রিয়েলিটি শো ‘মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার’-এ অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশি পারফর্মাররা। নান্দনিক উপস্থাপনা, ব্যতিক্রমী কৌতুক বাছাই আর রঙ্গ-রসের মাধ্যমে এ দেশের প্রতিযোগীরা কলকাতায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করছেন। শতশত প্রতিযোগীদের টপকে শীর্ষ স্থানে থাকছেন বাংলাদেশের প্রতিযোগী। মীরাক্কেলের মতো প্ল্যাটফর্মে বড় থেকে নিজেদের ঝালিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের আনোয়ারুল আলম সজল, জামিল হোসেন, আরমান, পাভেল, হৃদয়। দেশে ফিরে তারা এখন কেমন আছেন, কে কী করছেন?

মীরাক্কেল থেকে ফেরার পর অনেক সম্মান পেয়েছি: সজল
কল্যাণপুর, ঢাকার ছেলে আনোয়ারুল আলম সজল ছিলেন ‘মীরাক্কেল-৬’ সিজন ২০১১-১২ এর দ্বিতীয় রানার্স আপ। মীরাক্কেল থেকে ফিরে সজল মনোযোগী হয়েছেন অভিনয়ে। তবে পুরোপুরি অভিনেতা হতে সজলের সময় লেগেছে প্রায় দু-বছর। ২০১৪ সালে গোলাম সোহরাব দুদুল পরিচালিত ‘হল্লাবাজি’ নাটকে অভিনয় করার পর সজল অভিনেতা হিসেবে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পান। সজলের দাবী, এই নাটকের মাধ্যমে তিনি অভিনেতা হিসেবে নতুন করে পরিচিতি পেয়েছেন। একইসঙ্গে এই নাটকে তার কাজ তুমুল সাড়া পেয়েছিলেন। এরপর সজল হয়েছেন পুরোপুরি পেশাদার অভিনেতা। কাজ করেছেন সিনেমাতেও, সুযোগ পেলে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্টেজ শো করেন।

সজল বলেন, মাটির পরী, তুই আমার, স্বপ্ন যে তুই এই সিনেমাগুলোতে আমি অভিনয় করেছি। তিনটি ছবিই মুক্তি পেয়েছে। আগামীতে ছিটমহল ও নদীর বুকে চাঁদ নামে দুটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তবে আমি এখন নিয়মিত নাটকে কাজ করছি। সোনার পাখি রূপার পাখি, বনলতা, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন ইত্যাদি নাটকগুলোতেও কাজ করছি। তাছাড়া খণ্ড নাটকে মাঝেমধ্যে কাজ করছি। আমি অভিনয়কে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। স্টেজ শোকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চাই না। অভিনয়ের ফাঁকে সুযোগ পেলে স্টেজে কাজ করছি। আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাট বল্টু নামে ক্যাপিটাল রেডিওতে লাইভ শো করছি।

সজল বলেন, মীরাক্কেল থেকে ফেরার পর অনেক সম্মান পেয়েছি। মানুষের যে পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি বলে শেষ করা যাবে না। তবে অভিনেতা হিসেবে অবস্থান মজবুত করতে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। মানে, মীরাক্কেলের ছেলে সজল যে শুধু জোকস নয়, অভিনয় করতেও পারে এই বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লেগেছে, কষ্ট করতে হয়েছে। আর আমাদের দেশে মীরাক্কেলের মত বড় কোনো কমেডি রিয়্যালিটি শো হয়না, এর কারণ হচ্ছে- আমরা সবকিছুই অল্পের মধ্যে করে ফেলতে চাই। আমাদের সঙ্গে যখন আয়োজকদের কথা হয়, তাদের ভাষ্য থাকে এমন- এতো বড় আয়োজন করতে পারবো না। কারণ বাজেট সংকীর্ণ। ছোটখাটোর মধ্যে করতে চাই।

আমার কথা হচ্ছে, স্ট্যান্ড আপ কমেডি আসলে ছোটখাটোভাবে করা যায় না। এটা তো গান না, যে সে আগে থেকেই প্র্যাকটিস করে এসেছে। স্টেজে এসে গেলে ফেলল। স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে একজন আনাড়ি প্রতিযোগীকে এনে কয়েকজন গ্রুমার টিম দিয়ে তাকে এক-দুমাস ধরে ট্রেনিং করিয়ে উপযুক্ত করাতে হবে। আর লম্বা সময় থেকে একটা টিমকে পুষে রাখবে এমন আয়োজক আমাদের দেশে নেই। গুগল থেকে জোকস সংগ্রহ করে বললেই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হওয়া যায়না। এতে করে মৌলিকতা নষ্ট হয়। সবশেষে বলতে চাই, আমাদের সময়ের মীরাক্কেলে যারা প্রতিযোগী ছিলেন আমি মনে করি ওদের চেয়েও আমি কিংবা আমরা এদেশের মিডিয়াতে ভালো আছি।

সবাই এখন আমাকে অভিনয়ের জন্য ডাকেন: জামিল
নোয়াখালীর ছেলে হিসেবে জামিল  হোসেন পরিচিত হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। ‘মিরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার-৬’ এর চূড়ান্ত পর্বের প্রতিযোগী ছিলেন তিনি। দেশে ফিরে জামিল এখন অভিনয়ে মনোযোগী। নিয়মিত নাটকে অভিনয় করছেন, আর দেশের বড় বড় কর্পোরেট শোতে অংশ নিয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছেন। জামিল অভিনয় করেছেন ‘আয়নাবাজি’ ছবিতে। এছাড়া তার ‘রং ঢং’ নামের একটি ছবি রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়। তবে অভিনেতা পরিচিতি পেতে জামিলের প্রায় তিন বছর ঘাম ঝরাতে হয়েছে।

জামিল বলেন, মীরাক্কেলে যে স্টারডম ছিল, দেশে ফিরে সেটা তেমনভাবে কাজে লাগেনি। সবাই মনে করত সেতো স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। অভিনয়ের কী বোঝে? আমি কিন্তু মিরাক্কেলের মঞ্চে অভিনয় বেজ পারফর্ম করতাম। তাই আমার লক্ষ ছিল দেশে ফিরে অভিনয়টাই মন দিয়ে করব। কিন্তু অভিনয় পারি এটা প্রতিষ্ঠা করতে আমার সময় লেগেছে তিনটি বছর। আমাদের দেশে কোনো মেয়েদের প্রতিযোগিতা বের হলেই সবাই তাকে নিয়ে কাজ করতে চায়। সেক্ষেত্রে মীরাক্কেল থেকে আমি ফেরার পর ওভাবে আমাকে কেউ-ই খোঁজেননি, বলেননি যে নাটকে কাজ করো।

তিনি বলেন, মীরাক্কেলের স্ট্যান্ড আপ কমেডি এখনো করি। তবে সেটা কর্পোরেট শোগুলোতে। এ ধরণের অনুষ্ঠানগুলো সারাবছই টুকটাক হয়। মীরাক্কেলে দেড় বছর গ্রুমিং করেছি, ওটা আমাকে ভীষণভাবে উপকার করছে। আর আমার বিচারক রজতাভ দত্ত ও প্রাণ রায়ের মন্তব্য ভীষণভাবে ফলো করতাম। কারণ তারা দুজনেই দুজনেই ঝানু অভিনেতা। গত দু-আড়াই বছর যাবত আমি খুব ভালো আছি। সবাই এখন আমাকে অভিনয়ের জন্য ডাকেন। দেশের নাট্যাঙ্গের সব ভালো ভালো নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করছি।

আমি গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই: কমর উদ্দিন আরমান
মীরাক্কেল-৯ (২০১৫-২০১৬) এর আসরে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিল কক্সবাজারের ছেলে কমর উদ্দিন আরমান। শুধু জোকস নয়, আরমান মীরাক্কেলের দর্শকদের মন জয় করেছিলেন তার গান দিয়ে। দেশে ফিরে মীরাক্কেলের তারকা খ্যাতি অন্যান্যরা অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইলেও আরমান চাওয়াটা বেশ ব্যতিক্রম। তিনি গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। একটি গানের অ্যালবাম প্রকাশ করার জন্য কাজও শুরু করেছেন। আর দেশ-বিদেশে স্টেজ শো করে বেড়াচ্ছেন। তবে মাত্র একটি নাটকে অভিনয় করেছেন আরমান।

আরমান বলেন, আমার মূল লক্ষ আমি গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। অ্যালবামে চারটি গান থাকবে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা চলবে। গান কারা লিখছেন, সুর করছেন সবকিছু ঠিক হয়েছে কিন্তু এখনই জানাতে চাইনা। আশা করছি এই বছরে অ্যালবামটি প্রকাশ করতে পারব। এছাড়া বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে স্টেজ শো করছি। সারা বছর টুকটাক স্টেজ শো করলেও শীত মৌসুমে বেশি ষ্টেজ শো করছি। একটি ছয় পর্বের ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছি। নাম প্রেম যে কাঁঠালের আটা। নাটকটি প্রচারের পর ভালো সাড়া পেয়েছি। এর পর অনেকগুলো কাজের প্রস্তাব পেয়েছি, কিন্তু স্টেজ শো এর ব্যস্ততার কারণে টানা সময় দিতে পারছি না। আগামী বৈশাখে অনুষ্ঠান করার জন্য জাপান যাব।

তিনি বলেন, মীরাক্কেল থেকে আমরা যে প্ল্যার্টফম পেয়েছি, আমাদের দেশে এসে সেভাবে কাজ করানো হয়নি। অনেকে অনেকভাবে চিন্তা করে আমাদের নিয়ে। কিন্তু আমাদেরকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছে না। খুব কম মানুষ আমাদের নিয়ে ভালো কাজ করে। আমি একজন স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হলেও, আমার গানের আলাদা শ্রোতা রয়েছে। সেজন্য আমি গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। আমি স্টেজ শোতে গেলে সত্তর শতাংশ মানুষ কমেডি শোনে, বাকি ত্রিশ শতাংশ মানুষ কিন্তু আমার গান শুনছেন। আমি এখন আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল। মীরাক্কেল থেকে ফেরার পর আর্থিক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মানুষ আমাদেরকে যতটুকু লুফে নেয়ার কথা ছিল, ওই পজিশনটা আমি বা আমরা পাইনি।

দেশে সেভাবে কাজের প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছি না: পাভেল
‘মীরাক্কেল’-এর নবম আসরে ফেসবুক ভোটে প্রথম কিন্তু চূড়ান্ত রায়ে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছিলেন সাইদুর রহমান পাভেল। জন্ম চাঁদপুরে হলেও পাভেল ঢাকার ছেলে হিসেবেই পরিচিত। মীরাক্কেলের মঞ্চ জয় করে পাভেল এখন উপস্থাপনা, স্টেজ শো ও টুকটাক অভিনয় করছেন। তবে তিনি নিজেকে কখনোই কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিতি পেতে চাননা। পাভেলের মতে, তিনি একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চান।

পাভেল বলেন, আগামী ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ নামে একটি নাটকে কাজ করবো। তার আগে তপু খানের নির্দেশনায় ‘কট বিহাইন্ড’ নামের একটি নাটকে কাজ করেছি। পাশাপাশি ‘নীল চক্র’ নামের একটি সিনেমায় কাজ করছি। এছাড়া বাংলাদেশের পুলিশের জন্য একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেছি। আর দেশের ভিতর স্টেজ শোগুলোতে অংশ নিচ্ছি। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী এপ্রিলে দেশের বাইরে একটি শোতে অংশ নিতে যাব। তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন মীরাক্কেল থেকে এসেছি। তাই আমি একজন কৌতুক অভিনেতা। কিন্তু আমি আসলে কৌতুক অভিনেতা নই, আমি স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান। সবাইকে বুঝতে হবে কমেডিয়ান এবং স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান এক জিনিস নয়।

আমি অভিনয়ও করতে পারি। সেজন্য আমি অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাই। কলকাতায় যখন ছিলাম তখন রাস্তায় বের হলেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়তো। দাদা নয়, তারা বলত পাভেল ভাই কিংবা ভাই-ব্রাদার বলতো। কিন্তু আমি আমার আমার মত মীরাক্কেল থেকে এসেছে তারা এদেশে সেভাবে কাজের প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে না। স্টেজ শো মাতাচ্ছি। মানুষকে মজা দিচ্ছি। এখন আমাদেরকে নিয়ে কেন বেশি কাজ করা হচ্ছে না? আমরাও তো পারি ভাই! সুযোগটা তো দিয়ে দেখবেন নাকি?

এত কাজ করছি পয়সা কামাচ্ছি কিন্তু মন ভরছে না: হৃদয়
মীরাক্কেলের নবম আসরে চতুর্থ হয়েছিলেন এমদাদুল হক হৃদয়। তিনি ঢাকার ছেলে। মীরাক্কেল জয় করে হৃদয় এখন বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত উপস্থাপনা করছেন। রেডিওতেও কাজ করছেন। হৃদয় বলেন, আমি প্রতিষ্ঠিত উপস্থাপক হতে চাই। প্রচুর স্টেজ শো করছি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ফ্রি ল্যান্সার উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছি, কর্পোরেট অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন হাতে কাজ করছি, দেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্র‌্যান্ডিং কনসার্টে অংশ নিচ্ছি। আমার কাছে কিছু নাটকে কাজের অফার এসেছিল। কিন্তু পছন্দ হয়নি বলে কাজ করিনি। মাঝেমধ্যে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও কাজ করছি। এছাড়া আমার কনসেপ্টের রবির একটি রেডিও বিজ্ঞাপন করেছি। আগামী শুক্রবার নতুন করে রেডিওতে একটি শো শুরু করছি। গতবছর বইমেলায় এ জার্নি বাই মীরাক্কেল নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলাম। এবারও একটি বই নিয়ে আসছি, নাম এ জার্নি আফটার মীরাক্কেল। আগেরটার সিক্যুয়ালে বইটি সাহস পাবলিকেশন্স থেকে আসছে।

মীরাক্কেল থেকে ফেরার পর আমরা কী করছি এটা নিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। মানুষ জানতে চায়, মীরাক্কেল থেকে ফেরার পর কি করছি এখন। এত কাজ করছি পয়সা কামাচ্ছি কিন্তু মন ভরছে না। কারণ এমন কোনো কাজ এখনো করতে পারিনি যেটার মাধ্যমে মীরাক্কেলের মতো রেসপন্স আসে! আমাদের এখানে যেসব প্রোগ্রাম হচ্ছে সেটা নিয়ে আমার আক্ষেপ যে, ভালো ভিজ্যুয়াল কাজের সাথে এখনো নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমি যথেষ্ঠ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি এবং প্রচুর কাজ করছি।-চ্যানেল আই
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে