বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:৪২:৫৭

হাওরে-হাওরে হাহাকার, কৃষকের ঘরে কান্না!

হাওরে-হাওরে হাহাকার, কৃষকের ঘরে কান্না!

ঢাকা : হাওরে-হাওরে হাহাকার। কৃষকের ঘরে কান্না। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সব খুইয়ে এখন সবাই চোখে অন্ধকার দেখছে। ধনী-গরিব সব এক কাতারে। বৈশাখের নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি যে তাদের ওপর খ্তগ নেমে আসবে কস্মিনকালেও চিন্তা করেননি হাওরের কৃষক। ধান-মাছ সবই লুটে নিয়েছে বানের পানি। আর এ সবের জন্য দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারা সময়মতো বাধ মেরামত করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।

তারপরও সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগে কৃষক যেন কিছুটা হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গবাদি পশু নিয়ে হাওরের ঘরে ঘরে এখন দুশ্চিন্তা। ধান না ওঠায় গোখাদ্য সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ কেউ পানির দরে বিক্রি করে দিচ্ছে গবাদি পশু। কেউ কেউ বাজারে গবাদি পশু নিয়ে হাজির হলেও ক্রেতা পাচ্ছে না। মানবিক এমন বিপর্যয়ের মাঝে গতকাল হাওরবাসী খবর পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী আসছেন তাদের দেখতে। এতে আশার আলোও দেখছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য নতুন বার্তা নিয়ে আসবেন এ আশায় প্রহর গুনছেন।

স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, হাওরে মাছের মড়কে প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজার গুলোতে। এখন বাজারে তেমন মাছও নেই। আর ক্রেতাও কম। গেল ক’দিন থেকে আগের মতো জমজমাট নয় মাছের বাজার। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের হাকডাক আর হৈ হুল্লুড় চোখে পড়ছে কম। এখন অনেকটা দুর্দিন যাচ্ছে জেলার স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীদের। হাওর তীরবর্তী মাছের বাজারগুলোতে মিলছে না দেশীয় প্রজাতির মাছ। বাজারে যেগুলো উঠছে তা ফিশারি কিংবা বাহিরের (চালানি) মাছ। তাছাড়া ওই মাছগুলোর দামও চড়া। দরও আগের চাইতে এখন কেজিতে ৫০-৬০ টাকা বেশি। নানা রোগ জীবাণু আর অজানা শঙ্কায় মাছের বদলে সবজি, ডাল আর মোরগের মাংসের দিকে ঝুঁকছেন তারা।

জেলার মৎস্য চাহিদা যোগানের অন্যতম উৎস হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর ছাড়াও অনান্য হাওরগুলোতে এ বছর একের পর এক দুর্যোগে নাকাল। বোরো ধানের পর মাছে ও অন্যান্য জলজ প্রাণির মড়ক। তাছাড়া হাওর তীরবর্তী এলাকার ব্যাপক সবজি ক্ষেতও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ এমন দুর্যোগে দিশাহারা স্থানীয় কৃষি ও জেলে পরিবার। বোরো ধান, মাছ, হাঁস আর সবজি ক্ষেত হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নির্বাক। জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায় জেলায় ৪১ টন মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে হাকালুকি হাওরে (মৌলভীবাজার অংশে) উৎপাদন হয় ২৫ টন। এ বছর হঠাৎ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে হাওরগুলোর থোড়ওয়ালা ও আধপাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় পানিতে নিমজ্জিত বোরো ধান পচে অ্যামুনিয়া গ্যাসের কারণে পানি দূষিত হয়।

এতে হাকালুকি হাওরে মারা যায় দেশীয় প্রজাতির ২৫ টন ডিমওয়ালা মা ও পোনা মাছ। তাদের তথ্য মতে হাকালুকি হাওরের কুলাউড়াতে ৮, জুড়িতে ৭  ও বড়লেখা উপজেলা অংশে ১০ টন মাছ মারা যায়। হাকালুকি হাওর পাড়ের মৎস্যজীবীরা জানান এর আগে এমন মাছের মড়ক কখনো দেখেননি তারা। হাকালুকির মতো মাছের মড়ক না হলেও নানা কারণে জেলার অন্যান্য হাওরেও দেশীয় প্রজাতির মাছ ধরা পড়ছে কম। হাকালুকি হাওর পাড়ের জেলেরা জানান গেল ২-৩ দিন থেকে তারা হাওরের বিল এলাকায় জাল ফেলে মাছ পাচ্ছেন না। দীর্ঘ সময় জাল ফেলে অপেক্ষার পরও মাছ ধরা পড়ছে না জালে। অনেকটা শূন্য হাতে বাড়ি ফিরছেন। মাঝে মধ্যে দু-একজনের জালে ধরা পড়ছে অল্প মাছ।

হাওর তীরের ঘাটের বাজার সব সময় হাওরের দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় দেখা গেলেও এখন নেই তেমন ক্রেতা-বিক্রেতা। কারণ হিসেবে স্থানীয় সাদিপুর গ্রামের মৎস্যজীবী বাছির মিয়া, দুদু মিয়া, সামরুল মিয়া, সুজাত মিয়া, ফয়ছল মিয়া, নাসিম মিয়া, আয়াছ আলীসহ অনেকেই জানান হাওরের মাছের মড়কের পর জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়ছে একে বারেই কম। হাওরের মাছ ছাড়া এ বাজারে অন্য কোনো মাছ উঠে না। মৌলভীবাজার শহরের টিসি মার্কেট ও পশ্চিম বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ, রিপন মিয়া, সুলতান আহমদ, আবদুল জলিল, বিল্লাল উদ্দিনসহ অনেকেই জানান এখন তাদের কাছে হাওরের মাছ আসছে কম। যেগুলো আসছে সেগুলোর ক্রেতাও কম।

তারা বলেন, সম্প্রতি হাওরে ব্যাপক হারে মাছ মরে পচে যাওয়ার পর মানুষ এসব দেখে এখন নিজে থেকেই মাছ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওই এলাকায় মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে হাওরের এসব  মরা মাছ না খেতে মাইকিং করা হলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে হাওরের মাছ নিয়ে ভয় ঢুকে যায়। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ.ক.ম শফিক উজ-জামান ও সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন হাওরের অবস্থা এখন ভালো হয়েছে। মাছ ধরা বন্ধ রাখার ঘোষণা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জেলেদের জালে ধরা পড়া মাছগুলো বিষাক্ত নয়। এই মাছ খেলে সমস্যা হওয়ার কথা না। খুব শিগগিরই  মাছের এই সংকট কাটবে। আমরা জুনের মধ্যেই হাকালুকিতে ১৮ লাখ পোনা মাছ অবমুক্ত করব।

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, তাহিরপুর উপজেলায় এখনও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারগুলোতে পৌঁছায়নি কোনো ধরনের ত্রাণসামগ্রী। একে একে সব হাওর ডুবে যাওয়ায় হাজার হাজার কৃষক এখন দিশাহারা। জীবন বাঁচার একমাত্র হাতিয়ার বোরো ধান হারিয়ে হাওর বেষ্টিত উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর, তাহিরপুর সদর, দক্ষিণ বড়দল, উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের হাজার হাজার কৃষক পরিবারে হাহাকার। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঘরে এখন নেই খাবার ও বিশুদ্ধ পানি। বেশির ভাগ পরিবারেই নেই নগদ টাকা ও চাল। আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকায় হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারগুলো উপজেলা সদরে ও নির্দিষ্ট বাজারে যেতেও পারছে না। উপজেলার ছোট বড় ২৩টি হাওর হাওরের কাঁচা, আধা পাকা বোরো ধান একবারেই পানিতে তলিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার হেক্টরের অধিক।

সর্ব শেষ শনির হাওর ডুবে যাওয়ায় হাওর পাড়ে সর্বত্রই এখন বুকভরা দ্বীর্ঘশ্বাস,আর্তনাদ আর আহাজারিতে আকাশ বাতাস কম্পিত হচ্ছে। কোনো সহায়তা না পাওয়ায় হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। তাহিরপুর উপজেলা সদরে সরকারি ভাবে ডিলারদের মাধ্যমে দেয়া ওএমএস চালে সংকুলান হচ্ছে না ভোক্তভোগীদের। সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পাচ্ছে না দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেকেই। উপজেলা সদরে ৩ জন ডিলার দিয়ে প্রতিদিন ১টন করে তিন জন ডিলার ৩টন চাল দেয়া হয়। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। সারা দিন অপক্ষো করে অনেকেই খালি হাতে বাড়ি ফিরছে। এই ওএমএসের চাল প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়নের ডিলারদের মাধ্যমে দিলে কিছুটা হলেও রক্ষা পেত হাওরবাসী।

এদিকে তাহিরপুর উপজেলা বাজারসহ প্রতিটি বাজারেই চালের দোকানগুলোতে চাল নেই। অন্যদিকে উপজেলা পরিষদ,উপজেলা নির্বাহী অফিস, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভিজিএফ কার্ডের নামের তালিকায় সঠিক ভাবে যাচাই বাছাইয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১-২দিনের মধ্যে জেলায় নামের তালিকা পাঠানো হবে।

তাহিরপুর উপজেলা পিআইও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ১৫৪০০ভিজিএফ কার্ডের জন্য নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এখন যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে। আজ কালের মধ্যে জেলায় পাঠানো হবে। এ কার্ডে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে এবং তা প্রমাণিত হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর জন্য দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাঠানো প্রয়োজন। বোরো ধান হারিয়ে কৃষক পরিবারগুলো এখন বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে ভুগছে।

ওদিকে বৃহত্তর শনির হাওরের ৭ কিয়ার বোরো জমি চাষ করেছিলাম সব শেষ হয়ে গেছে। এক মুট ধানও কাটতে পারি নাই। চোখের সামনে আধা পাকা-কাঁচা ধান পানির নিছে গেছে। কথা গুলো বলছিলেন তাহিরপুর উপজেলার উজান তাহিরপুর গ্রামের কৃষক বাদল মিয়া। বীর নগর গ্রামের কৃষক সাদেক আলী জানান, গত বছর ৭০ কিয়ার বোরো ধান করছিলাম সব ধান পানিতে নিছে এক মুটও কাটতে পারি নাই। এইবারও সব নিলো কি করমো ভেবে পাইতাছি না জীবন ভর কষ্টের হয়ে গেলে। সবার মতো কাঁদতেও পারতাছি না। কৃষক সোহাগ মিয়া বলেন, ভাই সব শেষ জীবনের মায়া ছেড়ে বাঁধে কাজ করছিলাম এই হাওরটা (শনির হাওর) রক্ষা করার লাগি। সেই বাঁধ ভেঙে হাওর ডুবে চারদিকে এখন পানি আর পানি।

উপজেলার মধ্যবিত্ত কৃষকরা বলেন, ভাই কি কইতাম যা হবার তো তাই হইছে। বাঁধ সঠিক ভাবে সময় মতো বাঁধলে এত বড় বিপদ হতো না। টাকা নিজের পকেটে বরভার লাগি আমরার হাওরের বাঁধে কাজ করে নাই। আমরা শুধু কইতে পারি কিন্তু কিছু করতে পারি না। আমরার কথার কোনো দাম নাই। আমরা এখন আছি মহা বিপদে এই হাওরের (শনির হাওর) উপরেই আমাদের জীবন চলে। সবার একটাই কথা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি আর প্রয়োজনীয় সরকারি সহযোগিতা।

ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, হাওর পাড়ের চারদিকে কৃষকের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস না। সব হাওর ডুবে যাওয়ায় শনির হাওরটিই ছিল ১০ হাজার হেক্টর বোরো ধানের শেষ সম্বল। সর্ব শেষ ডুবে গেল জামালগঞ্জের পাকনার হাওর। এরপর আর কোনো হাওর রইলা সুনামগঞ্জে।

জানা যায়, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় গত শনিবার দিন গত মধ্য রাতে শনির হাওরের বাঁধ লালুরগোয়ালাসহ ৩টি বাঁধ ভেঙে ফসল হারিয়ে সর্বত্রই হাহাকার বিরাজ করেছে। হাওরের চারদিকে পানিতে থৈ থৈ করছে এখন। একমাত্র জীবন বাঁচার সম্পদ, কষ্টে ফলানো সোনার ফসল চোখের সামনে পানিতে ডুবে যাওয়া দৃশ্য দেখে তাদের চোখের পানি একাকার হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে। আর তাদের আর্তনাদ,আহাজারিতে এক হৃদয় বিদায়ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে শনির হাওর পাড়ে।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জের সর্বস্বান্ত মানুষ বাকরুদ্ধ। হাওর নিয়ে ভাবলেই দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। পরিবার পরিজন নিয়ে আগামী এক বছর কিভাবে চলবেন সে চিন্তায় এখন দিশাহারা। কৃষিঋণ স্থগিত হলেও মাহাজনী ও এনজিওদের ঋণের তাগিদে নাস্তেনাবুদ। অভাব ও ঋণের তাগিদে অনেকেই ঘরের হাঁস মুরগি গরু মহিষ বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাদের দাবি কৃষিঋণ স্থগিত নয়। তা মওকুফ করতে হবে। সেই সঙ্গে এনজিওদের ঋণের ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চান তারা।   
 
এদিকে, খাদ্য সংকটের কারণেই প্রতিদিনই ওএমএসের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। ভোর রাত ২টা/আড়াইটা থেকে লাইনে দাঁড়াতে থাকেন কৃষক। সকাল ৯টা থেকে চাউল ও গম দেয়া শুরু করেন ডিলাররা। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অধিকাংশ লোকই চাল পান না। ডিলারের সংখ্যা কম হওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান চাল গমের সরকারি ডিলারা। ওএমসের ডিলারের সংখ্যা বাড়নো হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।   

টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে পাউবো’র বাঁধ ভেঙে জেলার প্রায় সব ক’টি হাওর তলিয়ে গেছে। এতে ৯০ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে। এতে মানুষের খাদ্যের পাশাপশি হাস মুরগি গরু ছাগল সহ সব ধরনের গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দেবে। এই সংকটের কারণেই অনেক কৃষক ও খামারিরা গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

আমবাড়ি গরু বাজারে কৃষক সিদ্দেক আলী বলেন, ধান জমি তলিয়ে গেছে। খড় না থাকায় গরুকে খাওয়াতে পারছি না। এজন্য গরু দু’টি বিক্রি করে দিতে এসেছি। বিরামপুর গ্রমের গৃহস্থ আব্দুল হাই বলেন, ছয় হাল জমি রুইছলাম, সব গেছেগি, রাইত ঘুমে ধরে না। ঘরের সামনে রাইছ মিলও বন্ধ করিলিছি। ধান নাই মিল দি কিতা করতাম। তার ভাই তালাত মিয়ার একই অবস্থা। গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কেউ তার গরুগুলো কিনছে না। ঘরে খাবার না থাকায় নদীতে বালু উত্তোলনের কাজ করতে গেলেও শ্রমিক বেশি থাকায় কাজও পাচ্ছেন না।

আমন-বোরো মিলিয়ে প্রতিবছর সুনামগঞ্জে প্রায় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়। জেলার চাহিদা প্রায় চার লাখ টন। এতে প্রতিবছর উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় ৬ লাখ টন, যা দেশের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। সুনামগঞ্জ জেলায় প্রতিবছর ৮৯ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়। জেলার চাহিদা ৫৪ হাজার টন। উদ্বৃত্ত থাকে ৩৫ হাজার টন। এ বছর মাছ মরার কারণে উৎপাদন কমে যাবে বলে মনে করছেন মৎস্যজীবীরা। তবে সুনামগঞ্জে বিভিন্ন হাওর বিলে এবার বিপুল পরিমাণ পোনা ছাড়া হবে বলে জানান। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।  

জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে ১০০০ টন চাল এবং ৪৮,৫০,০০০ টাকা জিআর ক্যাশ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় পরিবার প্রতি ৩০ কেজি হারে ২৩ এপ্রিল হতে জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত এ জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভা মোট দেড় লাখ কার্ডের মাধ্যমে দুস্থ, অতিদরিদ্র ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রদান করা হয়েছে।

স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে জানান, ইটনা সদর ইউনিয়নের দীঘিরপাড় গ্রামের কৃষক তারা মিয়া (৪৫)। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর পাঁচ সদস্যের পরিবার। একমাত্র কন্যা তামান্না দশম শ্রেণীতে এবং তার ছোট আশরাফুল ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ৬০ হাজার টাকা দেয়ার শর্তে মহাজনের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে প্রায় ছয় একর জমিতে তিনি বোরো ফলিয়েছিলেন। কিন্তু আগাম বানের পানি কেড়ে নিয়েছে তার জমির ফসল। পরিবার-পরিজন নিয়ে এখন তাঁর দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে।

জানালেন, ঘরে দুইটি গরু ছিল। এর মধ্যে ৪৫ হাজার টাকা দামের একটি গরু মাত্র ২৫ হাজার টাকায় বেঁচে এখন সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। স্থানীয় সংরক্ষিত মহিলা সদস্য জেসমিন আক্তার আম্বিয়ার কাছে কৃষি কার্ড দিয়েছেন আরো ১৫ দিন আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ধরনের সহায়তা পাননি তিনি।

কৃষক তারা মিয়া বললেন, ‘আমরার আর খাইয়্যা-থাহনের কোন বাও নাই। হের উপরে মাজনের রেইনের চাপ। পোলাপাইনরেও যে ক্যামনে পড়াইমু আল্লায়ই জানে।’ একই রকম দুরবস্থার কথা জানালেন পার্শ্ববর্তী বড়হাটি গ্রামের কৃষক মো. আলী বক্স। ষাটোর্ধ্ব এই কৃষক ৪ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। এ জন্যে তিনি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার এবং মহাজনের কাছ থেকে দেড়ি সুদে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু বানের পানিতে পুরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় তিনি একেবারে নিঃস্ব। ধারকর্জ করে অনাহারে-অর্ধাহারে চলছে তার ৬ জনের সংসার। কঠিন অভাবের মাঝেও মিলেনি কোন সরকারি ত্রাণ সহায়তা।

বড়হাটি গ্রামেরই আবদুর রহমান (৫০) বলদার হাওরে ১০ একরসহ মোট ১১ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। দেড়ি সুদে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়ার শর্তে মহাজনের কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তার আছে একটি এনজিওর ঋণ। তিনিও সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশায় কৃষিকার্ড দিয়েছেন সংরক্ষিত ইউপি সদস্য আম্বিয়াকে। কিন্তু ঘরে খাবার না থাকলেও এখনো পাননি কোন সহায়তা। কৃষক আবদুর রহমান জানালেন, এনজিও ঋণের আরেক কিস্তি ২ হাজার ১শ’ টাকা বাকি রয়েছে। কামলা দিয়ে কোনরকমে সেই কিস্তির টাকা জোগাড় করে নতুন করে ঋণের আশায় এখন রয়েছেন তিনি। ২ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার কিভাবে সামাল দিবেন, এই দুশ্চিন্তা কাটছেই না তার।

একই গ্রামের কৃষক হারুন-অর রশীদ জানান, দেড় একর জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন তিনি। সবটুকুই চলে গেছে হাওরের পানির পেটে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে হাবিব দর্জির কাজ করে কোন রকমে চালাচ্ছেন ৭জনের সংসার। কিন্তু যেদিন ছেলের কাজ মেলে না, সেদিন খেয়ে-না খেয়েই থাকতে হয় গোটা পরিবারকে। তিনিও এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সহায়তা পাননি বলে জানান। ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের দত্তহাটির দিলীপ চক্রবর্তী জানান, তার ভাতিজার সঞ্চিত সব অর্থ দিয়ে এবার তিনি তিন একর জমি করেছিলেন। এক ছটাক ধানও জমি থেকে আনতে পারেননি। ৮জনের সংসারে এখন শুধুই অভাব আর হাহাকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি পরিবারটিতে।

জয়সিদ্ধি ইউনিয়নেরই মোল্লাহাটির কৃষক আবদুল জলিল দেড় একর জমিতে বোরো করেছিলেন। জমি থেকে একটি ফসলও ঘরে তুলতে পারেননি। ৭জনের সংসার নিয়ে এখন তিনি বিপাকে। গত ১৫ই এপ্রিল অনেক দেনদরবারের পর ১০ কেজি চাল ত্রাণ সহায়তা পেলেও তিন দিনেই তা শেষ। এরপর থেকে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের। সন্তান ও নাতি-নাতনীদের নিয়ে এখন কিভাবে বাঁচবেন ভাবতে গিয়ে কেবল চোখে অন্ধকারই দেখছেন এই বয়োবৃদ্ধ।

জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের বড়হাটি গ্রামের বিধবা কৃষাণী জ্যোতি রাণী ঘোষের নামে জ্যোতি থাকলেও ফসল হারিয়ে তার সংসারে এখন শুধুই অন্ধকার। দেড় একর জমির পুরোটাই গেছে দক্ষিণের হাওরের পানির নিচে। তিন জনের সংসারে এখন কেবল অভাবেরই দাপট। গত ১১ই এপ্রিল ১০ কেজি চাল সহায়তা পেয়ে কয়েকদিন চললেও এখন তাকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে গার্মেন্টে কাজ করা মেয়ের দিকে। বড়হাটি গ্রামেরই রাখাল বিশ্বাস দিনমজুরির কাজ করে ৫০ শতক জমি করেছিলেন। বানের পানিতে পুরোটা জমি হারিয়ে সেই পুরনো দিনমজুরের কাজেই ফিরতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু এখন চাইলেই কাজ মিলছে না হাওরে। যে কারণে সরকারি সহায়তার আশাতেই রয়েছে ৫ সদস্যের এই পরিবারটি। এর মধ্যে ১৫ কেজি চাল সহায়তা হিসেবে পেলেও এখন ঘর একেবারে খাদ্যশূণ্য।

জয়সিদ্ধি ইউনিয়নেরই মুদিরগাঁও গ্রামের কৃষক আলআমিন ৩ একর জমি করে এখন নিঃস্ব। ৭জনের সংসারে টানাটুনি দেখারও কেউ নেই। এখন পর্যন্ত পাননি কোন ত্রাণ সহায়তা। একই গ্রামের কৃষক আতাব মিয়ারও একই দুরবস্থা। তিন একর জমির পুরোটাই গেছে পানির নিচে। ৬ জনের সংসারে এখন শুধুই অভাব আর হাহাকার। এরপরও পাননি কোন ত্রাণ সহায়তা। ১৫ একর জমি করেও দিনের চালের জন্য হাহুতাশ করতে হচ্ছে একই গ্রামের কৃষক মেনু মিয়াকে। ৭জনের সংসারজুড়ে এখন কেবলই নাই নাই আর নাই।

এই ইউনিয়নের বীরকুল গ্রামের কৃষক ছালাম মিয়া ১০ একর জমি করেও আজ নিঃস্ব। ৬ জনের সংসারের অভাব মেটাতে মিলেনি এতটুকু ত্রাণ সহায়তাও। এসব ফসলহারা কৃষকের বোবাকান্না এখন হাওরজুড়ে। মহাজনের ঋণ আর সংসার খরচের দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ নিয়ে তাই অনেকেই ছেড়ে যাচ্ছেন হাওরের নিজ গ্রাম। এ যেন এক মানবিক সংকট। ফসল হারিয়ে কাঁদছে কৃষক। তীব্র অর্থকষ্টে দুঃসহ হয়ে ওঠছে তাদের জীবন। সচ্ছল কৃষকেরাও আজ নিঃস্বের কাতারে।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, হাওরে এখন ত্রাণ বলতে ১০ কেজি চাল আর সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা। এ দিয়ে কৃষকের তিন দিনের বেশি সংসার চলে না। কৃষককে বাঁচাতে হলে জরুরীভিত্তিতে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালাতে হবে। এজন্যে অবিলম্বে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে হবে। ত্রাণ তৎপরতা বিলম্বিত হলে, ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণের অপেক্ষায় না থেকে অভাবের তাড়নায় কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাবে।

এদিকে মঙ্গলবার বিকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, ত্রাণ সহায়তা হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ৫৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ৫০ হাজার কৃষক পরিবারের প্রত্যেককে সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫শ’ টাকা দেয়া হবে।

এ জন্যে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আজকালের মধ্যে তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে এসব বিতরণ করা শুরু হবে। এছাড়া ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী এই চার উপজেলার প্রত্যেক ইউনিয়নে তিন জন করে ডিলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে ১৫ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করবেন। -এমজমিন
২৭ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে