রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:৫০:৫৫

বোমায় গুড়িয়ে দেয়া একটি দেশ যেভাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে

বোমায় গুড়িয়ে দেয়া একটি দেশ যেভাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক : ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধকালে লাওসে ২০ লাখ বোমা বর্ষণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ নয় বছর ধরে প্রতি আট মিনিটে একটি বিমানবোঝাই বোমা। সেই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে লাওস। কিভাবে? সাংবাদিক টি ডি অ্যালমানের অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লিখেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

বেশ কিছু দিন ধরে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এমন একটি প্রতীকী দৃশ্য, যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের শিকার একটি দেশ এবং সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে তার পুনরুত্থানের ছবি ধরা পড়বে। খুঁজতে খুঁজতে এক দিন পেয়েও গেলাম। প্রাদেশিক রাজধানী ফনসোবানের প্রধান সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা আছে একটি ভাঙা বিমান ও বোমার টুকরো। তার ঠিক পেছনেই একটি নতুন এটিএম মেশিন। দারুণ প্রতীকী। অতীতের ধ্বংসযজ্ঞ ও ভবিষ্যতের প্রাচুর্য যেন হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এটিএম বুথটিতে গেলাম, ঢোকালাম আমার ডেবিট কার্ড। বেরিয়ে এলো ১০ লাখ কিপ (১২০ মার্কিন ডলার)। ৫০ হাজার কিপের নতুন নোটগুলো যেন আমাকে নতুন এক লাওসের গল্প শোনাল, যেখানে ‘বোমাবর্ষণ যুগের’ পথটি এগিয়ে গেছে টাকাকড়ির নতুন যুগের পানে।

সত্যিই তাই। একটা সময় ছিল যখন এই জিয়াংকুওয়াং প্রদেশের শিশুরা বড় হয়ে উঠত সূর্যের মুখ প্রায় না দেখেই। এখন এই প্রদেশের রাজধানী ফনসোবানের রাজপথ এতই জনাকীর্ণ যে, এর ট্রাফিক বাতিতে ডিজিটালি দেখানো হয় নির্ধারিত কয়েক সেকেন্ডে কতজন পথচারী রাস্তা পারাপার করতে পারবে।

এত লোক কেন রাস্তা পার হয়? তারা কি ওপারে যায় ব্যাংক, রেস্তোরাঁ কিংবা সবজি ও ফলের বাজারে? না, ওসব এপার-ওপার দু’পারেই আছে। কিন্তু এক পাশে আছে মার্কিন বিমান যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ। এটা এখন পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে আছে পর্যটন অফিসও। একটি গলফ মাঠে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যুদ্ধদিনের স্মৃতি-বিস্ফোরিত ও অবিস্ফোরিত বোমা। এসব অবিস্ফোরিত বোমা থেকে লোহালক্কড় সংগ্রহ করতে গিয়ে কত মানুষ যে প্রাণ দিয়েছে!

তবুও লাওসবাসী পিছপা হয়নি লোহালক্কড় কুড়ানো থেকে। ব্যান নাফিয়া গ্রামের ফেট নাফিয়ার কথাই ধরা যাক। তিনি এসব কুড়িয়ে পাওয়া লোহা-ইস্পাত দিয়ে আস্ত একটি ফাউন্ড্রিই (কারখানা) খুলে বসেছেন। কী না তৈরি হয় সেখানে! বোমা-আকৃতির চাবির রিং থেকে শুরু করে চামচ, কাঁটাচামচ, চটস্টিক সবই। স্থানীয় সব রেস্তোরাঁয় এগুলো দেখা যাবে।

এসব করে ফেটের জীবনে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। তার রয়েছে একটি নতুন বাড়ি, স্যাটেলাইট টিভি, বিদ্যুৎবাতি সবই। তিনি জানেন, বাজার অর্থনীতিতে টাকা ফেললে সবই মেলে। বলেনও সে কথা : এই যে স্যাটেলাইট টিভি, এতে ৬০টি চ্যানেল দেখা যায়। তবে এতে বিদ্যুৎ খরচ হয়, সেই বিদ্যুৎ পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। মোবাইল ফোনের বেলায়ও একই কথা।

তবে তাই বলে এসব সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে একটুও পিছিয়ে নেই লাওসবাসী। যেমন, দেশটির লোকসংখ্যা ৭০ লাখেরও কম, কিন্তু মোবাইল ফোন আছে প্রায় ৫০ লাখ। মেকং নদীর উত্তর পাড়ের বান পাক-উ গ্রামের কথাই ধরা যাক। শান্ত সমাহিত একটি জেলেপল্লী। শত শত বছর ধরে এই গ্রামটি তেমনই আছে। ব্যতিক্রম এসেছে শুধু এক জায়গায় প্রতি দিন-রাতে অনেক গ্রামবাসীকে দেখা যাবে কোথাও না কোথাও পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারা কথা বলছে মোবাইল ফোনে।

রাজধানী ভিয়েনতিয়েনের কথাই ধরা যাক। একদা এটি ছিল একটি অগোছালো শহর। এখনো অগোছালো; তবে অনেক ১২ তলা ভবন দিয়ে। সেসব দিনে এই শহরের নীরবতা ভাঙত বৃষ্টির শব্দে, শিশুর কান্না ও কলকাকলীতে, লোকজনের হাসির শব্দে এবং শ্রমণদের স্তোত্র পাঠের গুঞ্জনধ্বনিতে। এখন সেসবের জায়গায় এসেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের (এসি) গুনগুন শব্দ, জেনারেটরের আওয়াজ, মোটরবাইকের চিৎকার ও অন্যান্য যন্ত্রযানের হর্নের শব্দ।

লাওসের অর্থনীতি এখন প্রায় আট শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। দেশটিতে এখনো জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ওড়ে সোভিয়েত স্টাইলের কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা লাও পিপলস রেভল্যুশনারি পার্টির পতাকা। এই দলের নেতারা এক সময় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে নিবেদিত ছিলেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তাদের ভূমিকা এখন ভিন্ন। তারা এখন লাওসকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তবাজারে পরিণত করার চেষ্টায় কর্মরত। তাদের লক্ষ্য : ২০২০ সালের মধ্যে জাতিসঙ্ঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ওপরের দিকে যাওয়া।

সেদিকে যাওয়ার পথে থেমে নেই দেশটি। লাওস নামের এই দেশটিতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কাছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, দেশটির প্রত্যন্ততম এলাকায়ও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। মধ্য লাওসের ভিয়েতনাম সীমান্তসংলগ্ন একটি এলাকায় আমি দেখেছি, এক তরুণ মোটরবাইকে করে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরছে, তার বগলে একটি স্যাটেলাইট ডিশ। বেশ কিছু পাহাড়ি গ্রামও ঘুরেছি আমি। সেখানে দেখেছি সাদা-নীল ইউনিফর্ম পরে শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। এমন অনেক এলাকাও দেখেছি, যেখানে বৌদ্ধমন্দিরের পাশাপাশি আছে অ্যানিমিস্টদের মন্দির এবং খ্রিষ্টানদের গির্জা। আর লাওসের সর্বত্র দেখা যায় জাফরানি রঙের আলখাল্লা পরা বৌদ্ধ ভিক্ষু। নতুন নয় এটা। নতুন যা তা হলো তাদের হাতে বা কাঁধে এখন থাকছে কম্পিউটার ব্যাগ।

সেই অনাদিকাল থেকে ভিয়েনতিয়েনের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মেকং নদী। এক সময় এর পাড় ছিল কাদা ও বালিতে ভরা। এখন সব বদলে গেছে। এককালের বালি-কাদামাখা নদীতীর এখন দুই মাইল লম্বা এক আকর্ষণীয় খোলা জায়গা, যা সবসময় আনন্দপিয়াসী মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেখানে আছে জগিং করার পথ, আছে ব্যায়াম করার নানারকম মেশিন। আরো আছে পার্কিং স্পট, যেখানে সেডান ও এসইউভির মতো দামি গাড়ি নিয়ে লোকজন আসে। প্রতিটি সন্ধ্যা এখানে আনন্দ বয়ে আনে প্রেমিক-প্রেমিকার কূজন, স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের জগিং, শিশুদের হাসি ও প্রাণচঞ্চল চেঁচামেচি, ব্রেক-ড্যান্সারদের উচ্চাঙ্গ নৃত্য। কোথাও দেখা যায় উঠতি অথবা শখের শিল্পীরা গান করছে, কোথাও যোগগুরু শেখাচ্ছে নানা ধরনের ব্যায়াম। এক সময় সূর্য ডুবে যায়। কিন্তু নিয়ন বাতির উজ্জ্বল আলোতে রাতের অন্ধকারও বাধ্য হয় দূরে সরে থাকতে।

সত্যি বলতে কী, মেকং নদীর তীরে এই উন্মুক্ত ময়দান যেন এক ভিন্ন গল্পই বলে, যে গল্প একটি মানবতাবাদী নগর পরিকল্পনার। যে পরিকল্পনায় নদীতীরের খোলা মাঠে, মুক্ত আকাশের নিচে জীবনের কলরোল স্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে বাঁধানো নদীতীরটি ভিয়েনতিয়েন শহরকে বন্যার হাত থেকেও রক্ষা করে। এটি নির্মাণে বিপুল পরিমাণে ঋণসহায়তা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এটাও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এক সময় এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঋণ, অনুদান সবই আসত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে। আর এখন এশিয়ার উন্নয়নে এগিয়ে আসছে এশিয়ান দেশগুলোই।

ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন লাওসের ওপর কর্তৃত্ব করত, তখন তারা মেকং নদীর ওপর একটা সেতুও বানায়নি। আর আজ মেকং নদীর এপার-ওপারকে যুক্ত করেছে ছয়টি বৃহৎ সেতু। এর একটি হচ্ছে থাখেক। এটি যেখানে অবস্থিত, সেখান থেকে বর্ধনশীল অর্থনীতির অপর দু’টি দেশ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের দূরত্ব একেবারেই কম; মাত্র ৯০ মাইল। থাখেকে থাকতে টিভিতে ‘ভিয়েতনাম আইডল’ দেখতে দেখতে আমি হোটেলের জানালা দিয়ে ভিয়েতনামকে দেখতে পেতাম।

ভিয়েনতিয়েনে এক সকালে দেখতে পেলাম, আমার হোটেলের লবিটি মোটরসাইকেলে বোঝাই। কী ব্যাপার? এক মোটরসাইকেল আরোহী বিনয়ের সাথে জানাল, ‘আমরা মালয়েশিয়া থেকে আনন্দভ্রমণে এসেছি।’ বলে কী, এ যে ২৬ শ’ মাইল পথ! কিন্তু এটাই সত্য। আরেক ভোরে, আমি তখন লুয়াংফাবেং-এ, হোটেলের পাশের রাস্তায় অনেকগুলো নতুন গাড়ি। সবগুলোতে চীনের লাইসেন্স প্লেট লাগানো। মালয়েশীয় প্রমোদ ভ্রমণকারীরা যাচ্ছিল উত্তর দিকে, কুনমিং থেকে আসা ধনাঢ্য চৈনিক দল যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। দু’দলেরই উদ্দেশ্য অবশ্য এক : লাওসে ছুটি কাটানো। এভাবেই লাওসে ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটছে। তবে কমিউনিস্ট ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি দিয়ে নয়, এ ‘অনুপ্রবেশ’ আনন্দপিয়াসী স্বচ্ছল মানুষদের।

শান্তিপূর্ণ আন্তঃসংযোগের নতুন জমানার একটি চমৎকার মানবীয় চেহারা রয়েছে, যা সর্বত্র সবার চোখে পড়বে। এমনকি আকাশ থেকেও এটা দেখা সম্ভব। বিমানে সাভান্নাখেত থেকে মেকং পার হয়ে আসুন, দেখবেন ছয়টা বৃহৎ সেতু দিয়ে বিরতিহীনভাবে পারাপার হচ্ছে মানুষ ও পণ্য। লাওসে আসছে, লাওস থেকে যাচ্ছে। একটু উজানে যান, দেখবেন আকাশছোঁয়া টাওয়ার, যার মাধ্যমে নদীর ওপারে বিদ্যুৎ রফতানি করছে লাওস। একবার আমি বিমানে করে লুয়াংফাবেং গিয়েছিলাম। বোমার ঝলকানিতে আমার চোখ যেন ঝলসে গিয়েছিল। যুদ্ধশেষে এখন দেখতে পাই ভিন্ন দৃশ্য। দক্ষিণ কোরিয়া সেখানে বানিয়ে দিয়েছে গলফ কোর্স। চার দিকে সবুজ আর সবুজ।

মনে পড়ে, কয়েক দশক আগে ভিয়েনতিয়েনের এই নদীতীরে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। আমার ভেতরটা তোলপাড় করছিল একটি প্রশ্ন : ‘লাওসে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আমেরিকা কিভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে জয়লাভের আশা করে?’ যখন আমি লিখলাম, ‘লাওসে একটি গোপন যুদ্ধ চলছে,’ বিশ্বজুড়ে তা সংবাদ শিরোনাম হয়। আসলে লাওসে মার্কিন হস্তক্ষেপ কোনো গোপন বিষয় ছিল না। এটি ১৯৫০ সালে শুরু এবং ১৯৭৪ সালে শেষ হয়। যেকোনো লাওসবাসীকে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তারা জানত আফিম ব্যবসার সাথে মার্কিনিদের জড়িত থাকার কথা।

১৯৬৮ সালের একদিন আমি মেকং থেকে বোলোভেনস মালভূমিতে যাওয়ার জন্য একটি ট্যাক্সিতে চড়ে বসি। বেশ অনেক দূর যাওয়ার পর ট্যাক্সিওয়ালা বেঁকে বসল, সে আর যাবে না। অগত্যা কী আর করা, আমি হাঁটতে শুরু করি। আমার মাথার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটে চলছিল মার্কিন বোমারু বিমান। দিগন্তে দেখছিলাম বৃক্ষসারি। তখন আমার বয়স ২৩। এ বয়সটা সত্য প্রকাশে ব্যাকুল থাকার।

যা হোক, হাঁটতে হাঁটতে আমি ঢুকে পড়ি একটি পরিত্যক্ত পানশালায়। ফরাসি কফি উৎপাদকদের ফেলে যাওয়া এই পানশালাটি দেখে মনে হবে যেন পুরনো কোনো সিনেমার দৃশ্য থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেয়া। একটি দেয়ালচিত্রে (ম্যুরাল) দেখা যায়, এক ফরাসি প্ল্যান্টার এক লাওসিয়ান রমণীর সান্নিধ্য উপভোগ করছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পুরনো ফরাসি গির্জার পেছন দিকের একটি বাড়ি থেকে কেবল মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। আমি বাড়িটিতে ঢুকে দেখা পেলাম এক ফরাসি পাদ্রির। হুইস্কি পান করছেন। ভদ্রলোকের এক পা নেই। সেখানে কাঠের একটি কৃত্রিম পা লাগানো। তিনি আমার জন্যও একটি গ্লাসে হুইস্কি ভরলেন। হুইস্কি পান করতে করতে তিনি একটি আমেরিকান ফিকশন দ্য গ্রিন ব্যারেটস-এর ফরাসি অনুবাদ পড়ছিলেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, ভিয়েতনামে যা ঘটছে, তা কি এ বইয়ের মতোই?

সেদিনের পর কয়েক দশক কেটে গেছে। আমি আবার সেই পাকসং শহরটি দেখতে চাইলাম। জানি, সেই পাদ্রি আর নেই। কিন্তু আমি ভাবিনি যে, আমার দেখা সেই পাকসং শহরটিও ‘আর নেই।’ আমি আসার পরপরই মার্কিনিরা দু’দফা কার্পেট বোমা ফেলে পাকসং শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। একটি ভবনের এক কোণা ছাড়া সেখানে আর কোনো দাঁড়ানো বাড়ি ছিল না। সেটি ছিল লাওসিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানির স্থানীয় দফতর।

পাকসং শহর তো গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। তারপরও এতকাল পর সেই শহরকে দেখতে পাব ভাবতেই আমার মনটা অপার্থিব এক আনন্দে ভরে গেল কেন? এর জবাব হয়তো এই যে, এখন আমি সেই শহরে গিয়ে দেখতে পাব সুখী ও উন্নততর জীবনের অধিকারী একদল লোককে। লাওসের মতো পাকসং শহরও রণাঙ্গন থেকে পরিণত হয়েছে বাণিজ্যক্ষেত্রে। যেখানে ছিল ফরাসি ক্যান্টনমেন্ট, সেটি এখন একটি বড় বিপণিবিতান মানুষের হট্টগোল, কর্দমাক্ত, প্লাস্টিক ও জৈব আবর্জনায় ভর্তি চার দিকটা। কিন্তু আপনি যা-ই কিনতে বা বেচতে চান, সবই এখানে মিলবে। এখানকার যে পণ্যটি আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে তা হলো ‘লোহার মহিষ’।

কল্পনা করুন, আপনি লাওসের একজন কৃষক ও উদ্যোক্তা এবং টেলিভিশনে যা-ই দেখেন সবই আপনি পেতে চান। আর একটি জিনিস পেলেই এসবই আপনার পাওয়া হয়ে যায়। ওই জিনিসটাই হলো লোহার মহিষ। এটি গৃহপালিত জীবন্ত মহিষ নয় বটে, তবে ওটি মহিষের কাজ এবং তার বাইরেও অনেক কাজ করতে পারে। যেমন হাল চষতে পারে, পানি তুলতে পারে, ঘর আলোকিত করতে পারে। ভাবছেন, কী ব্যাপার? আসলে এটি হলো একটি মাল্টিপারপাস বহনযোগ্য ইঞ্জিন, যা দিয়ে আপনি প্রায় সবকিছুই চালাতে পারেন। ওটি আপনার পাম্পের সাথে যুক্ত করুন। ব্যস, আপনি গ্রীষ্মকালেও ক্ষেতে পানি দিতে পারবেন। লাগিয়ে দিন আপনার লাঙ্গলের সাথে, তিন গুণ বেশি জমি চাষ হয়ে যাবে। সংযোগ দিন আপনার গাড়ির সাথে; যাওয়া-আসায় যে পথে দু’দিন লাগত, তা পাড়ি দিতে একটি সকালই যথেষ্ট।

লোহার মহিষচালিত একটি গাড়িতে করেই আমি ল্যান কিওপানিয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি তার লোহার মহিষে একটি লোহার স্টিয়ারিং হুইল লাগিয়ে সেটি যুক্ত করে দিয়েছিলেন তার রাবারের টায়ার লাগানো গাড়িতে। তার গাড়িটি হচ্ছে একটি হ্যান্ডমেড পিকআপ ট্রাক। ল্যান বলছিলেন, ‘পাকজং মার্কেট থেকে আমাদের গ্রামের দূরত্ব ১২ মাইল। এই গাড়িতে এই পথ যেতে চার লিটার ডিজেল খরচ হয়। কিন্তু এটা আমার গায়ে লাগে না। কারণ, আমার ক্ষেতের কফি, ফলমূল ও শাকসবজি দ্রুত ওই বাজারে নিতে পারলে ভালো দাম পাই।’ ল্যান সেদিন তার নতুন বাড়ির জন্য প্লাস্টিকের ছাদ কিনেছিলেন। বৃষ্টি আসার আগেই সেগুলো লাগানোর জন্য তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই জানালেন তার ছেলেমেয়ে ছয়জন। গর্বের সাথে বললেন, সবাই স্কুলে যায় বা যাবে। গ্রামে একটি নতুন রাস্তা হয়েছে। বছর দুয়েকের মধ্যে বিদ্যুৎও এসে যাবে বলে আশা করছে গ্রামবাসী।

তার কথার খেই ধরে আমি জানতে চাই, এরপর আপনি আর কী চান? ল্যান বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের জমিগুলো বোমামুক্ত হোক। তাহলে আমরা উৎপাদন দ্বিগুণ করে ফেলতে পারব।’

আসলে মার্কিন বোমাবর্ষণে পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে লাওসের পাহাড়ি গ্রামবাসীই ভুগেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ বোমা তো চিনে না কে কমিউনিস্ট আর কে কমিউনিস্ট নয় কিংবা কে শিশু আর কে-ই বা সৈনিক। যুদ্ধ শেষে লাওসের নারীরা আকাশ থেকে নেমে আসা সেই গজবের দুর্দিনের ছবি ফুটিয়ে তুলল নকশি কাঁথায়। তাতে চিত্রিত হলো বোমার ঘায়ে রক্তাক্ত শিশু, জ্বলন্ত শস্যক্ষেত, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পলায়নপর গৃহপালিত প্রাণীদল। দেয়ালজোড়া আকৃতির এই চিত্রকলা যেন পাবলো পিকাসোর অমর সৃষ্টি ‘গুয়েরনিকা’র লাওসীয় অনুকৃতি।

এরকম নারীদের একজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার নাম কেই চা (৫৮)। তিনি আমাকে তার একটি অনন্য চিত্রকর্ম দেখালেন। এটি যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের করা। তাতে দেখা গেল যেন একটা স্বর্গের দৃশ্য ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। চার দিকে বিচিত্র সব বৃক্ষের সারি। আরেক দিকে নূহের (আ:) নৌকা, তাতে জগতের সব প্রাণীর সমারোহ। আমি দেখলাম তার হাতের জাদুতে একটি রুমাল হয়ে গেল জিরাফ, নীল কাপড়ের একটি টুকরা হলো উচ্ছলিত ঝরণা। আমি আরো দেখতে চাইলে তিনি বললেন যে, তিনি এসব কাজ এখন আর করেন না। কারণ, পর্যটকরা বড় ট্যাপেস্ট্রি কিনতে চায় না। তারা চায় কম পয়সার এমব্রয়ডারি, যা তাদের হাতের ব্যাগে ভরে দেশে নেয়া যাবে। তাই তিনি এখন ছোট ছোট জিনিসই বানান, যা কম পয়সায় বিক্রি করা যায়। জানতে চাইলাম, দেশে যে পরিবর্তন এসেছে, সে বিষয়ে তার ভাবনা কী। কোনো মন্তব্য করলেন না চা।

লাওসে অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্য, তবে একটা জিনিস অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। সেটা হলো তীব্র গরম। একটু ঠাণ্ডা পানির খোঁজে আমি ঢুকে পড়লাম কাচের দরজা দেয়া এক দোকানে। দোকানের মালিক এক নারী খেনচান খামসাও। তার দোকানের ময়লা ফেলার ঝুড়িটি প্রথমেই আমার দৃষ্টি কাড়ে। সেটা নিয়েই কথা শুরু। খেনচান জানান, ভাঙা ট্রাকের টায়ার দিয়ে ওটা বানানো। আমার মনে পড়ল ফেট নাপিয়ার চামচ ও ব্রেসলেটের কথা। এসবই লাওসবাসীর প্রতিভার চিহ্নবাহী : ফেলে দেয়া জিনিসকেও তারা দরকারি জিনিসে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে।

খেনচানের জীবনটাও কম সংগ্রামমুখর নয়। তাদের আদি বসত লাওসের মধ্যাঞ্চলীয় খেমুন প্রদেশে। এলাকাটিতে মার্কিনিদের ফেলে যাওয়া এতসব অবিস্ফোরিত মারণাস্ত্র ছড়িয়ে আছে যে, সেখানে চাষাবাদ অসম্ভব। এ অবস্থায় খেনচান ও তার স্বামী একদিন চলে আসেন লুয়ানফাবাংয়ের নর্থ-সাউথ রোডের পাশে এক খোলা জায়গায়। ১২ বছর পর তারাও লাওসের অসংখ্য সাফল্য কাহিনীর মতো এক কাহিনীর নায়ক-নায়িকা। তাদের নতুন বাড়ির পুরো নিচতলাটাই এখন তাদের দোকান। দোকান চালান খেনচান। স্বামী ৬৫ মাইল দূরে ভেংভিয়াং এলাকার একটি সেচ প্রকল্পের নির্মাণশ্রমিক। তাদের তিন সন্তান সবাই সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করে সবচেয়ে ছোটটি স্থানীয় স্কুলে, আর বড়টি ভিয়েনতিয়েনে।

সব মিলিয়ে খেনচানের পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব নেই। আগে তারা বাস করতেন বোমাবৃষ্টির ভেতর, আর এখন টাকার বিছানায়। তবে হালে তারা আবিষ্কার করেছেন, টাকা শুধু স্বাচ্ছন্দ্য দেয় না, বিপদও ডেকে আনে। যেমন আমি যখন বললাম যে, ভিয়েনতিয়েনে তাদের বড় ছেলেটি ভালো লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে, খেনচান জবাব দিলেন, ‘লেখাপড়ার জন্য আমরা তাকে অত দূরে পাঠাইনি। আমরা আসলে তাকে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।’

লাওসে আফিম নির্মূলের লক্ষ্যে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। তাতে অর্থসহায়তা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৬ সালে লাওস নিজেকে ‘আফিমমুক্ত’ ঘোষণা করে। কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি মাদকের জন্য ক্ষুধাও তীব্রতর হয়ে ওঠে। এ দেশটি হেরোইন, আফিম ইত্যাদির একটি বড় ট্রানজিট রুট। এ কুকাজটি এখন আবার বেড়ে গেছে। আর আমেরিকার মতো এখানেও মাদকের বড় শিকার মফস্বল এলাকা।

মৃত্যুর মৌসুম
লাওসে যখন তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসে, তখন লোকজন গায়ে কোট চড়ায়, মাথায় হ্যাট চাপায় আর পোহানোর জন্য আগুন জ্বালায়। আর তখনই শুরু হয় মৃত্যুর মওসুম। এক নববর্ষের রাতে জিয়াংকুয়াং প্রদেশের তিন তরুণ ক্যাম্পিংয়ে যায়। রাতে শীত ভালোভাবে নামতেই তারা আগুন জ্বালায়। আগুন জ্বলে উঠতেই তাদের ক্যাম্পের পাশে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা একটি অবিস্ফোরিত মার্কিন বোমা প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে তাদের একজন সেখানেই প্রাণ হারায়। আরেকজন গুরুতর আহত হয়। তৃতীয় জনের নাম ইয়ের হের। তার অবস্থা দেখতে আমি তার গ্রামের বাড়িতে যাই। ১৮ বছর বয়সী তরুণটি তার শার্ট খুলে আমাকে দেখায়, শুধু তার পিঠেই ১৯টি ক্ষতচিহ্ন।

ইয়েরের গ্রামটিতে কিন্তু বিদ্যুৎ আছে, স্যাটেলাইট টিভি আছে, মোবাইল ফোন আছে। আবার প্রায় প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ যুদ্ধ শেষের বহুকাল পরও যুদ্ধের বোমায় মারা গেছে বা পঙ্গু হয়ে গেছে, এমনও আছে।

ওই গ্রামের হাইস্কুলটি দেখতে যাই আমি। দেখি, ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে ছাত্রদের বীজগণিত শেখানো হচ্ছে। অঙ্কগুলো আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আসলে লাওসের এই প্রত্যন্ত গ্রামটিতে শিক্ষার্থীরা যে গণিত শিখছে, তা আমি আমার বয়সে আমেরিকায় যে গণিত শিখেছিলাম, তার চেয়ে অনেক অগ্রগামী। দেশে ফিরে আমি এক গণিতজ্ঞকে ওই ব্ল্যাকবোর্ডের ছবি দেখিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেন, ‘এতে বোমার মতো পতনশীল বস্তুর বেগ শেখানো হচ্ছে।’

অর্থাৎ যুদ্ধশেষের চার দশক পরও লাওসবাসীকে ছেড়ে যায়নি বোমা। কিভাবে যাবে? এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪০ লাখ টন বড় বোমা ফেলেছে লাওসে। গুচ্ছবোমা বা ‘বম্বিজ’কে হিসেবে ধরলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ কোটি ৭০ লাখ, যা দেশটির প্রত্যেক মানুষের মাথাপিছু একটিরও বেশি। এসব বোমার ওজন জীবিত লাওসবাসীর মোট ওজনের চেয়েও বেশি। সেই বোমার অনেকগুলো দেশটির এখানে-ওখানে এখনো অবিস্ফোরিত অবস্থায় লুকিয়ে আছে।

একটু অসাবধান হলেই প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যাচ্ছে। নিহত বা আহত হচ্ছে মানুষ। অঙ্গ হারিয়ে হয়ে যাচ্ছে পঙ্গু।

এর মধ্যেই এগিয়ে চলছে দেশটি। এত বোমাবর্ষণের পরও একটি দেশ, একটি জাতি সচল আছে, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফের মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এ যেন রূপকথাকেও হার মানায়। এই আধুনিক রূপকথার দেশ লাওস আর তার নায়ক লাওসের অগণিত মানুষ।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে