মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০৮:৫৭

বাখরখানি তো খান, জানেন এই নামের ইতিহাস?

 বাখরখানি তো খান, জানেন এই নামের ইতিহাস?

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: পছন্দের বাকরখানি তো খান, জানেন কি এই নামের ইতিহাস? পুরান ঢাকায় ভোরটা বড় সুনসান। দিনমান যেখানে রিকশা আর নানা যানের জটে যাত্রীরা এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঠার মতো আটকে থাকেন, সেই ঢাকা ভোরের নরম আলোয় একেবারেই অন্য রকম। হাঁকডাক নেই, হুল্লোড় নেই, নেই গাড়ির প্যাঁ-পোঁ। দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তাগুলো ফাঁকা। এ সময় ঐতিহ্যের দ্বার খুলে বউনি করতে শুরু করে বাখরখানি আর মাঠার দোকানগুলো। এ দৃশ্য দেখে পুরান ঢাকায় বড় হওয়া মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে উঠতে পারেন।

এ সময় বড় কাটরা, চকবাজার, বেগমবাজার, নাজিমউদ্দীন রোড, সাত রওজার মোড়ে ঘুরতে ঘুরতে তেমন অনুভূতিই কাজ করছিল। অন্য সময় যেই অলিগলিতে রিকশার জ্যামে আটকে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়, সেখানে গলিগুলো প্রায় সুনসান। দু-একটা রিকশা গলি দিয়ে ধীরগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। রেস্তোরাঁ ছাড়া দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ। অল্প কয়েকজন মানুষ হেঁটে আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যে মোড়ের গলিতে বিচ্ছিন্নভাবে মাঠা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল কয়েকজনকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠার দোকানে ক্রেতা বাড়তে লাগল।ভোরে পুরান ঢাকার বড় কাটরা এলাকা। বড় কাটারার রাস্তায় রতন ঘোষ নামের একজন মাঠার সসপ্যান, ছানা নিয়ে বসেছিলেন। একজন মাত্র ক্রেতা সেখানে। ২৫ বছর ধরে এ জায়গাটিতেই মাঠা বিক্রি করছেন বলে জানালেন রতন ঘোষ। বংশানুক্রমিক তাঁরা এ ব্যবসায় যুক্ত।  ভোর পাঁচটা থেকে মাঠা, ছানা নিয়ে বসেন। প্রতি গ্লাস মাঠা বিক্রি করেন ১০ টাকায়।

সোয়ারীঘাটের কাছে মাঠা বিক্রেতা উত্তম ঘোষ বললেন, তিনি ২২ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। মাঠা, ছানার সঙ্গে মাখন, ক্ষীর বিক্রি করেন। বাসায় পরিবারের সবাই মিলে তৈরি করেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ লিটার মাঠা বিক্রি হয় তাঁর।

নাজিমউদ্দীন রোড ধরে এগোতে চোখে পড়ল বাখরখানির দোকান। দোকানে আবুল খায়ের নামের এক ব্যক্তি তাঁর দুই কিশোর ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে বাখরখানি বানাচ্ছেন। আবুল খায়ের বললেন, ৩০ বছর ধরে তিনি বাখরখানি বানান। দোকানটি তাঁর ভাইয়ের। প্রতিদিন তাঁরা চিনি ও পনির বাখরখানি তৈরি করেন। চিনি বাখরখানি প্রতি পিস তিন টাকা আর পনির বাখরখানি প্রতি পিস ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার পিস বাখরখানি বিক্রি করতে পারেন।উত্তম ঘোষের মাঠার দোকান। পুরান ঢাকার বিশেষজ্ঞদের মতে, সেখানের ঐতিহ্যপূর্ণ খাবারের তালিকায় মাঠা ও বাখরখানি অন্যতম। তবে স্বাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। খাস্তা ও নিমসুখা নামের দুই ধরনের বাখরখানি রয়েছে। এর মধ্যে আকারে বড় কিন্তু পাতলা ও হালকা নিমসুখা বাখরখানির দেখা মেলে না বললেই চলে। বাজারে যে বাখরখানি এখন দেখা যায়, তা খাস্তা বাখরখানি।

ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক আজিম বখ্শ বলেন, পুরান ঢাকার মতো বৈচিত্র্য খুব কম স্থানেই আছে। নানান ঐতিহ্যপূর্ণ খাবার রয়েছে। বাখরখানি ও মাঠা তেমনই। আগে পুরান ঢাকার অধিবাসীদের সকালের নাশতার তালিকায় মাঠা অবশ্যই থাকত। সকাল শুরুই করতেন তাঁরা মাঠা খেয়ে। ভোর থেকে সকাল আটটার মধ্যে মোড়ে মোড়ে মাঠা বিক্রি হতো। সাধারণত হিন্দু গোয়ালারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এখনো পুরান ঢাকায় সকালে মাঠা খাওয়ার চল রয়েছে। মাঠার সঙ্গে ছানা ও মাখন বিক্রি হয়।মায়ের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার পথে মাঠা খেয়ে নিচ্ছে শিশুটি। আজিম বখ্শ আরও বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন কলাপাতায় ছানা ও মাখন বিক্রি করা হতো। আর বালতির মধ্যে দুধ নিয়ে তা ফেটা হতো। দুধ ফেটার জন্য ব্যবহার করা হতো বাঁশের তৈরি চোঙা।’

বাখরখানি প্রসঙ্গে আজিম বখ্শ জানান, পুরান ঢাকায় এখন হাজারের ওপর বাখরখানির দোকান রয়েছে। মোড়ে মোড়ে অলিতে গলিতে রয়েছে দোকান। তবে বাখরখানির সেই স্বাদ আর নেই। বলা হয়ে থাকে, আগা বাকের নামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই এলাকায় বাখরখানির প্রচলন শুরু করেন। তাঁর নামের বাকের ও তাঁর প্রেয়সী খনি বেগমের নামের প্রথম অংশ নিয়ে ‘বাখরখানি’ নাম হয় এ খাবারের। নিমসুখা বাখরখানি পুরান ঢাকার জিঞ্জিরার দু–একটি দোকানে শুধু পাওয়া যায়।

আজিম বখ্শ আরও বলেন, একসময় মৃত বাড়িতে শোক পালনের সময় চুলা জ্বালানো হতো না কয়েক দিন। ওই সময় আত্মীয়–স্বজনেরা বাখরখানি পাঠাতেন ওই বাড়িতে। এ ছাড়া বিয়ের পরদিন নতুন জামাইয়ের বাড়িতে চিনির সিরায় ডুবিয়ে বাখরখানি পাঠানোর রেওয়াজ ছিলো পুরান ঢাকায়।
১৭ অক্টোবর ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে