শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:২০:৪৮

সেদিন লন্ডনে যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু

সেদিন লন্ডনে যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু

জুলকার নাইন : পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন পৌঁছানোর পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি হোটেল ক্যারিজেসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলনে শুধু ব্রিটিশ নয়, বিশ্বের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

হোটেল লবিতে জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের লড়াইয়ের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে আমি যখন ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন বাংলাদেশের জনগণ আমাকে তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।’

জাতির জনক বলেন, ‘আমি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতাকামী সব রাষ্ট্র যারা আমাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিশেষত ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বাধীনতাকামী জনগণ যারা আমাদের সমর্থন জানিয়েছেন তাদের সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগোষ্ঠীকেও তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই। এখন আমি সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই বাংলাদেশকে অতিসত্বর স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানাতে।’

আধা ঘণ্টার কিছু কম সময়ের এই সংবাদ সম্মেলনের আগমুহূর্তে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চুরুটে আগুন ধরিয়ে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২ মিনিটের লিখিত বক্তব্য শেষ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষকে বাংলাদেশিদের মতো স্বাধীনতার জন্য এতটা মূল্য দিতে হয়নি। আমিও একটি মুহূর্তের জন্য তাদের এই দুর্দশার কথা ভুলতে পারিনি। তাই আমি দেশ ও দেশের বাইরে থাকা প্রত্যেক বাংলাদেশিকে ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে। যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করা লাখ লাখ মানুষের শোকাহত পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি সমবেদনা ও বিদেহী আত্মার মাগফিরত কামনা করছি।’

এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে কী বীভৎসতা চালানো হয়েছে তা শুনলে আপনারা আশ্চর্য হবেন। লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, মাইলের পর মাইল যেভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, বেঁচে থাকলে হিটলারও হয়তো লজ্জা পেতেন।’

পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটা আমার জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়, আমি গত ১০-১৫ বছর ধরেই এর মধ্যে রয়েছি। আর একটা বিষয় মনে রাখবেন, যে নিজেই মরতে চায়, তাকে কেউ মারতে পারে না। আমি ৩৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি, আমি জানতাম, আমি যদি কারাগারেও যাই বা বেঁচে নাও থাকি বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনবেই।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাকে যে কারাগারের যে সেলে রাখা হয়েছিল সেখানে সূর্যের আলো বা বাতাস কিছুই ঢুকত না, কোনো রেডিও বা খবরের কাগজও দেওয়া হতো না। বিশ্বের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার কাছে এসেছিল। তার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা, আমাকে প্রেসিডেন্ট করার কথা।’

সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি সহায়তার জন্য সারা বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানাই। কারণ সুজলা সুফলা বাংলাদেশে শুধু লাখ লাখ মানুষই মারা যায়নি, হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, রেলপথ ধ্বংস করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থনীতিকে পুরো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমি আবেদন জানাই দরিদ্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য।’

প্রশ্নকারী ব্রিটিশ সাংবাদিককে উদেশ্য করে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যে কতটা সম্পদশালী ছিল তা আপনারা জানেন। কিন্তু এক শ-দেড় শ বছরের বিদেশি শাসনে থেকে অনেক কিছুই হারিয়েছে বাংলাদেশ। আমি মনে করি ব্রিটিশ সরকারেরও এখন দায়িত্ব বাংলাদেশকে সহায়তা করা। কারণ বাংলাদেশের সম্পদ আহরণ করেই আজকের ব্রিটেনে অনেক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেই ঋণ আজ পরিশোধের সময় এসেছে। শুধু ব্রিটেন নয়, আমি সারা বিশ্বের প্রতি লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানাই।’

এর আগে, সেদিন সকালেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। একটি পাকিস্তানি সামরিক বিমানে খুব গোপনে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’

বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্জে এলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছে। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হোটেল ক্যারিজেস নিয়ে যাওয়া হয়।

অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান হোটেলে। বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান।

ওইদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তার কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না আসেন। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি হোটেল ক্যারিজেসকে ঘিরে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে।

দুপুরে এই হোটেলেই জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডন সময় সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু ওঠেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবহরের কমেট জেটে। বাংলাদেশে ফেরার পথে বিমানটি দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করে দিল্লিতে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। পরে ঢাকায় ফেরার পরের গণসংবর্ধনার কথা আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। বিডি প্রতিদিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে