রবিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৮, ০৫:৫৯:১৭

‘ওই মেয়েটাকে জ্বালিও না, সে তোমাকে বোমা মেরে দেবে’

‘ওই মেয়েটাকে জ্বালিও না, সে তোমাকে বোমা মেরে দেবে’

নিউজ ডেস্ক:  ভারতে বিভিন্ন অভিজাত স্কুলেও মুসলিম ছেলেমেয়েরা তাদের ধর্মের কারণে ক্রমবর্ধমান হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

ভারতের লেখক নাজিয়া ইরাম সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই ‘দি ডার্ক সিক্রেট ইন আওয়ার স্কুলস অ্যান্ড প্লেগ্রাউন্ড: মাদারিং এ মুসলিম’-এ তথ্য জানিয়েছেন।

ভারতের ১২টি শহরে ১৪৫টি পরিবার, এবং রাজধানী দিল্লির ২৫টি অভিজাত স্কুলের ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এই বইটি লিখেছেন।

এতে নাজিয়া ইরাম দাবি করেছেন, ধর্মের কারণে হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না পাঁচ বছরের মুসলিম শিশু।

ভারত এবং সারা বিশ্ব জুড়েই ইসলাম-ভীতি ক্রমশ বাড়তে থাকার পটভূমিতেই এটা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিবিসিকে নাজিয়া ইরাম বলেন, তিনি গবেষণায় যা পেয়েছেন তা তাকে স্তম্ভিত করেছে। তিনি বলেন, ‘যখন পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চারা বলে তাদেরকে ‘পাকিস্তানি’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলে ডাকা হয়েছে- আপনি তার কি জবাব দেবেন? সেই স্কুলের কাছেই বা কি অভিযোগ করবেন।’

নাজিয়া বলেন, ‘এর অনেকগুলোই হয়তো মজা করে বলা হয়েছে, মনে হতে পারে এটা নির্দোষ ঠাট্টা। কিন্তু আসলে তা নয়, এটা উৎপীড়ন।’

তার বইতে নাজিয়া ইরাম যে সব বাচ্চার সাক্ষাতকার নিয়েছেন, তারা বলেছে এমন কিছু প্রশ্ন বা মন্তব্য আছে যা প্রায়ই তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয়।

যেমন: ‘তুমি কি একজন মুসলিম? আমি মুসলিমদের ঘৃণা করি।’

‘তোমার বাবা-মা কি বাড়িতে বোমা বানায়?’

‘তোমার বাবা কি তালিবানের অংশ?’

‘সে একজন পাকিস্তানি।’

‘সে একজন সন্ত্রাসী।’

‘ওই মেয়েটাকে জ্বালিও না, সে তোমাকে বোমা মেরে দেবে।’
এই বইটি বের হবার পর থেকেই স্কুলগুলোতে ধর্মীয় ঘৃণা এবং বিরূপ ধারণা কতটা আছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে।

টুইটারে ‘মাদারিংএমুসলিম’ নামে একটি হ্যাশট্যাগে অনেকেই তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ননা করছেন। ভারতে জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু এবং মুসলিমরা প্রায় ১৪ দশমিক ২ শতাংশ।

এই দুই সম্প্রদায় অধিকাংশ সময় শান্তিতে বসবাস করলেও ১৯৪৭এর ভারত ভাগ এবং ১৯৯০-এর দশকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বৈরি মনোভাব আরো বেড়েছে।

লেখক নাজিয়া ইরাম নিজেই বলেছেন, তার প্রথম কন্যা সন্তান জন্মের পরই তিনি প্রথম ভয় পেলেন। তিনি তাকে কোন পরিচিত মুসলিম নাম দেয়া নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন।

এর পর থেকে তার ‘মুসলিম’ পরিচয় ছাড়া অন্য সব পরিচয়ই যেন গৌণ হয়ে গেছে, বলেন মিজ ইরাম।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই মুসলিমদের আগ্রাসনকারী, জাতীয়তাবিরোধী, এবং জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি বলে চিত্রিত করা হতে থাকে। টেলিভিশনে নানা তর্কবিতর্কে এই বিভেদ আরো গভীর হয়। আর এখন তা বড়দের থেকে ছোট বাচ্চাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ইরাম বলেন, ‘স্কুলে, খেলার মাঠে, ক্লাসরুমে, স্কুলবাসে একজন মুসলিম বাচ্চাকে লক্ষ্য করে ‘পাকিস্তানি’, ‘আইএস’, ‘বাগদাদি’, ‘সন্ত্রাসী’- এসব বলা হয়।

নাজিয়া ইরামের বইটিতে এমন গল্প আছে যেখানে একটি পাঁচবছরের মেয়ে বলছে, ‘মুসলিমরা আসছে, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে’- কিন্তু মেয়েটি নিজেই মুসলিম।

ইউরোপে এক সন্ত্রাসী আক্রমণের পর ১০ বছরের একটি ছেলেকে তার সহপাঠী বলছে ‘তুমি এটা কি করলে?’

১৭ বছরের একটি ছেলেকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ বলেছে, তার মা গালি দেয়া ছেলেটির মার কাছে অভিযোগ করেছেন। সেই মা বলছেন, ‘কিন্তু আপনার ছেলে যে আমার ছেলেকে বলেছে ‘মোটা’!’

সারা বিশ্বেই এমন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর বর্ণ-জাতি-ধর্ম নিয়ে এমন ঘটনা ঘটলে একে বলা হচ্ছে ‘ট্রাম্প এফেক্ট’। তাহলে ভারতে যা ঘটছে তাকে কি ‘মোদি এফেক্ট’ বলা যায়?

লেখক নাজিয়া ইরাম বলেছেন, সব পার্টিই এরকম ভাষা ব্যবহার করছে, ইসলামী পার্টিগুলোও করছে। তিনি আরো বলেন, স্কুলগুলো তাদের ক্যাম্পাসে এরকম ধর্মীয় উৎপীড়নের ঘটনা ঘটার কথা স্বীকার করতে অস্বীকার করেছে।

কিন্তু নাজিয়ার মতে এর সমাধান করতে গেলে প্রথম এটা স্বীকার করতে হবে, তা না হলে এই ঘৃণা ছড়াতে ছড়াতে এক সময় আমাদের সবাইকে গিলে ফেলবে।
এমটি নিউজ/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে