শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:৪৭:২১

মানবতার এই গল্পে নায়ক একজন অটোরিক্সা চালক

মানবতার এই গল্পে নায়ক একজন অটোরিক্সা চালক

রফিক সরকার: মানবতার এই গল্পে খল চরিত্র যে কোন ব্যাধি। তবে নেই কোন পার্শ্ব চরিত্র। গল্পের পেছনে আছেন শুধু একজন নারী পরিচালক। আর এই গল্পের পুরোটা সময় জুড়ে নায়ক একজন অটোরিক্সা চালক। পুরো নাম নাঈম দেওয়ান (২৩)। শ্রমজীবি সেচ্ছাসেবী হিসেবে তিনি গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় সবাই তাকে ‘নাঈম’ নামেই চেনেন। অটোরিক্সা চালান কালীগঞ্জ শহরে অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে। মূমুর্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজনে গল্পের ওই নায়ক ছুটে যান নারী পরিচালক স্বেচ্ছাসেবক নূসরাত কবিরের ডাকে।

নাঈম দেওয়ানের বাড়ি উপজেলার তুমলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়াখোলা গ্রামে। নাঈমের বয়স যখন ১২ বছর তখনই বাবা আব্দুর রহমান মারা যান। এ সময় জন্ম হয় ছোট বোন শাহনাজের। অভাব অনটনের সংসার, তাই ৫ম শ্রেণির পর তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। মা মাসুদা বেগম অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেই চলে সংসারের চাকা। যে বয়সে স্কুলে সহপাঠিদের সাথে স্কুলে যাওয়ার কথা আর খেলার সাথীদের নিয়ে মাঠে দৌড়িয়ে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে কিশোর নাঈম সংসার চালনায় মায়ের সাথে সহযোগীতার জন্য বাসে হেলপারের কাজ নেন। এখন সে টসবগে যুবক। জীবনের ভাল-মন্দের সিদ্ধান্ত সে নিতে পারেন। তাই সংসার চালানোর পর গাড়ীতে কাজ করার জমানো টাকা দিয়ে একটি অটোরিক্সা কিনে যাত্রী নিয়ে উপজেলার অলি-কলি পথ দাবরিয়ে বেড়ান। এ সময় তার রিক্সায় স্থানীয় রক্তদান সেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংগঠকদের আনা-নেওয়ার পথেই তিনি রক্তদানে উৎসাহিত হন এবং তাদের সাথে যুক্ত হয়ে রক্তদান শুরু করেন।

নাঈম বলেন, এটাই তার প্রথম রক্তদান। এর আগে তিনি রক্তদান নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কারের কথা শুনেছেন। কিন্তু রক্ত দিয়ে এর সবই ভুল প্রমানিত করেছেন। তাই তার মতে রক্তদানে এভাবে মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে আসলে হয়তো অনেক মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ বেঁচে যাবে। মানুষে মানুষে সৃষ্টি হবে নতুন ভাতৃত্য বন্ধন।

এ ব্যাপারে রক্তদান স্বেচ্ছাসেবক কলেজ শিক্ষার্থী নূসরাত কবির জানান, আজ থেকে মাস খানেক আগে তিনি নাঈমের রিক্সা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় রক্তের প্রয়োজনে তার মোবাইল ফোনে কল আসে। একজন সেচ্ছাসেবী হিসেবে রক্ত নিয়ে কথা বলার সময় নাঈম দেওয়ান খুব মনযোগ দিয়া কথা গুলো শুনেন। কথা শেষ হওয়ার এক পর্যায়ে নাঈম তাকে প্রশ্ন করেন রক্তদিলে কোনো ক্ষতি হয় কিনা। জবাবে তিনি নাঈমকে রক্তদান সম্পর্কিত সম্পূর্ন তথ্য বলেন। এতে করে তার মধ্যে থাকা ভুল ধারণা গুলো ভেঙ্গে যায় এবং সে সাথে সাথে রক্ত দানে আগ্রহী হয়ে যান। কিন্তু তার রক্তের গ্রæপ জানতে চাইলে তিনি জানেনা বলে জানান। পরে তিনি ওই সময় স্থানীয় একটি ক্লিনিকের সামনে চলন্ত অটোরিক্সা থামিয়ে নাঈমের রক্তের গ্রæপ টেস্ট করান। তখন জানা যায় তার রক্তের গ্রæপ বি পজেটিভ। পরে প্রায়ই শ্রমজীবি ওই নাঈমের সাথে দেখা হলে তিনি রক্ত দানে তার আগ্রহের কথা বলতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই স্থানীয় একটি ক্লিনিকে একজন মূমুর্ষ রোগীকে বাঁচাতে বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হলো। নাঈমকে সাথে সাথে ফোন করলে তিনি কাজ রেখে চলে আসেন রক্ত দিতে। কিন্তু দীর্ঘ একমাস পর তার স্বপ্ন সত্যি হওয়ায় তিনি ছিলেন হাস্যেজ্জল ও উৎফুল্ল। সেদিন নির্ভয়ে হাসি মুখে একজন মূমুর্ষ রোগীর প্রাণ বাঁচিয়ে চলে আসেন। পরে আরো রক্ত লাগলে জানাতে বলেন নাঈম।

তিনি আরো বলেন, রক্তদান করতে গিয়ে যারা নানা তালবাহানায় সব সময় অযুহাত খোঁজেন, নাঈম দেওয়ান তাদের কাছে শুধু একজন হিরো নয়। তিনি একজন সুপার হিরো। একজন শ্রমজীবি (অটোরিক্সা চালক) নাঈম যদি এত পরিশ্রম করে সেচ্ছাসেবীদের ডাকে রক্তদানে এগিয়ে আসতে পারে, তাহলে আমরা সুস্থ্য-সবল আরাম প্রিয় মানুষেরা কেন নয়?

রক্তদানের ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাক্তার মোহাম্মদ ছাদেকুর রহমান আকন্দ বলেন, যে কোন পেশার একজন সুস্থ্য সবল মানুষ প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর রক্ত দিতে পারে। রক্তদানে শরীর ভাল থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে