বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৮, ১১:১৫:৫২

ল্যুভর থেকে চুরি হয়ে গেল লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মোনালিসা!

ল্যুভর থেকে চুরি হয়ে গেল লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মোনালিসা!

মনালিসা অনিমেষ চৌহান: সকাল নয়টার দিকে এসেছেন চিত্রকর লুই ব্যারাউড। জানতে চাইলেন, এটি কোথায়? ব্রিগেডিয়ার পাওয়ার বিন জানালেন, ফটোগ্রাফার নিয়ে গেছেন। কিন্তু দুপুরের মধ্যেও ফটোগ্রাফার এলো না!

পাওয়ার বিন খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। কিন্তু কোথাও ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পাওয়া গেল না । দুঃসংবাদটি দুপুরেই পৌঁছল সংবাদপত্র অফিসে। পরের দিন হেডলাইনে বের হল- ‘অভাবনীয়: মোনালিসা কোথাও নেই!’ ল্যুভর থেকে চুরি হয়ে গেল লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির মোনালিসা!

সাধারণ জনগণ এই মূল্যবান শিল্পসম্পদটিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তারা প্রথমে বিশ্বাস করেনি এই সংবাদটি সত্য। পুলিশ গোপনে অনুসন্ধান শুরু করল। একই সঙ্গে অন্যান্য ছবিগুলো বুলেটপ্রুফ কাচের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। ছবিটি খুঁজে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করা হল- যে এনে দিবে তাকে ৪০ হাজার ফ্রাংক কোনরকম প্রশ্ন ছাড়াই দেওয়া হবে। প্যারিস জার্নাল ঘোষণা করল ৫০ হাজার ফ্রাংক।

অথচ নেপোলিয়নের বেডরুমে মোনালিসা ছিলেন পরম নির্ভরতায়, নিঃছিদ্র নিরাপত্তায়। কখনো ভুলেও ধূলো জমলে নেপোলিয়ন তা মুছে দিতেন পরম মমতায়। তখনকার সময়ে মেয়েরা সৌন্দর্য বাড়াতে ভ্রু সরু করতেন।

ভিঞ্চির মোনালিসার ভ্রুও খুব সরু ছিল। নেপোলিয়ন এতোটাই যত্ম নিতেন যে, মোনালিসার সরু ভ্রুটা কখন যে মুছে গেছে, টেরও পেলেন না। তাই মোনালিসার অধরে মুচকি হাসি থাকলে চোখের ওপরে ভ্রুয়ের কোন চিহ্ন নেই। তবুও লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি অদ্ভুত সুন্দরী মোনালিসার প্রতিকৃতিটি বিখ্যাত হয়ে আছে কেবল তার অধরে মুচকি হাসির কারণেই।

মনোহারিণী মুচকি হাসি ছাড়াও মোনালিসার ছবিতে আশ্চর্যজনক আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। লিওনার্দো ছবিটি এঁকেছিলেন ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে ইতালির ফ্লোরেন্সে। তাই ভিঞ্চি’র মোনালিসা পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ মানুষের চোখে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পরিচিত শিল্পকর্ম। পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত, এবং সবচেয়ে সমালোচিত শিল্পকর্মও মোনালিসা।

শুধু আলোচিত নয়, মূল্যমানের দিক দিয়েও এটি পৃথিবীতে সেরা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এর এক আর্টিকেলে বলা হয়েছে, সৃষ্টির চার’শ বছর পর ১৯০৬ সালে ছবিটির দাম হয় ১৬২ কোটি ৯৫ লাখ ২৮ হাজার ৬২ ডলার।

প্রতিমিনিটে এর দাম বাড়ে ৯৪ দশমিক ৩০ ডলার। বর্তমান সময় পুরো প্যারিস শহরকে বিক্রি করে দিলেও মোনালিসার দাম পরিশোধ হবে না। প্রতিদিন শুধুমাত্র মোনালিসা দেখতে লাখ লাখ মানুষ ভীড় জমায় ল্যুভর মিউজিয়ামে। মোনালিসা‘র সামনে লম্বা এক লাইন। প্রত্যেক দর্শক মাত্র ৩০ সেকেন্ড করে সময় পায় এই বিখ্যাত শিল্পকর্মটি দেখতে।

লিওনার্দো যখন ফ্রান্সে অভিবাসী হন, তখন সঙ্গে নিয়ে আসেন ছবিটি। এখানে এটি বিক্রি করেন মাত্র চার হাজার সোনার মুদ্রার বিনিময়ে। এটি তখন রাখা হয় ভার্সাই রাজপ্রাসাদে। এরপর মোনালিসার হাসিতে মুগ্ধ নেপোলিয়ন এটিকে নিয়ে যান টুইলিরাইসে নিজের বেডরুমে।

নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর ১৮০৪ সালে ছবিটি প্যারিসের ল্যুভর গ্যালারিকে উপহার দেওয়া হয়। ১৯১১ সালে একদিন ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রতিদিনের মতো পাহারায় থাকা এক রক্ষী জানান, মোনালিসা দেয়ালে যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই।

ল্যুভর থেকে হারিয়ে যাওয়ার প্রায় দুই বছর মোনালিসার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। ছবিটি চুরি যাওয়ার পর চিত্রকলা প্রেমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেন। প্যারিসের অলিগলিতে এই বিষয়ে নানারকম গুজব ছড়াতে শুরু করে। জনগণের বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের কারণে ল্যুভর মিউজিয়ামের তৎকালীন কিউরেটর থিওপেলি হোমলোকে বরখাস্ত করা হয়। মিউজিয়ামে কড়া নিরাপত্তা আরোপ করা হয়।

এ নিয়ে বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কারণ কবি গিয়োম সএপিলিনেয়ার পিকাসোকে গোপনে বলেন, তাঁর কাছে মোনালিসার ছবিটি রয়েছে এবং সেটা বিক্রি করা হবে। পিকাসো যথারীতি ছবিটি কিনে নেন। পরে পুলিশে খবর পেলে পিকাসো এবং কবি গিয়োওকে গ্রেপ্তার করে। মজার ব্যাপার হলো, সেটি আসল মোনালিসা ছিল না। এটা প্রমাণিত হওয়ার পর পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়।

চুরি হওয়ার দুই বছর পর ১৯১৩ সালে ঘটনা অন্যরকম এক মোড় নেয় । নভেম্বরের এক সকালে আলফ্রোডা গ্যারি মোনালিসা কিনার একটি প্রস্তাব পান। তিনি একজন ইতালিয়ান আর্ট ডিলার। তিনি তাঁর বন্ধু ‘উফিজি গ্যালারি’ এর কিউরেটর গিওভানি পোগিকে কথাটা জানান। তারা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত দেন যে, প্যারিসের পত্রলেখকের সাথে যোগাযোগ করবেন।

পত্রলেখকের নাম ভিনসেনজো পেরুগুয়ে । তাঁর সাথে দেখা করার পর এই পত্রলেখক তাদেরকে খাটের নিচ থেকে মোনালিসার মূল ছবিটি বের করে দেখান এবং ৫ লাখ লিও দাবি করেন। ছবিটি এতো সময় ধরে লুকিয়ে রাখতে রাখতে তিনি আসলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন । ছবিটি দেখার পরপরই গ্যারি লুভর মিউজিয়ামে খবর পৌছে দেন।

১৫ দিনের মধ্যেই ভিনসেনজো ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। মামলা চলতে থাকে। অবশেষে ৭ মাস পর ভিনসেনজো মুক্তিও পেয়ে যান। ইতালির সকল শহরে তখন ছবিটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে আবার ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ছবিটি ফেরত নিয়ে যায়। শত বছর পর আজ আবারও ল্যুভর থেকে বের হচ্ছেন মোনালিসা। ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর ঘুরে আবার ফিরে আসবেন ল্যুভরে-এমনটাই জানালেন দেশটির সংস্কৃতিমন্ত্রী ফ্রান্সিস নিশিয়েন।

সূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান ডটকম

এমটিনিউজ২৪/এম.জে/ এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে