বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ০১:০৭:৩৭

এরা ভারতের আন্দামানের বিশেষ নাগরিক, জেনে নিন তাদের গল্প

এরা ভারতের আন্দামানের বিশেষ নাগরিক, জেনে নিন তাদের গল্প

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: আমরা যখন চাঁদে ও মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি। ইন্টারনেটের বদলে পুরে দুনিয়া একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে, তখন আমাদের সমসাময়িক হয়েও তাদের দূরত্ব লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে।  এরা ভারতের বিশেষ নাগরিক, জেনে নিন তাদের গল্প। প্রকৃতির অংশ হয়ে তারা বেঁচে আছে একই ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে আন্দামানের গভীর জঙ্গলে। জারোয়া জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যায় তারা মাত্র ৩৫০-৪০০ জন।

নৃতত্ত্ববিদগণ অনুমান করেন, প্রায় ৬৫-৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার কোনো গহীন জঙ্গল থেকে যে কোন কারণে বা যেকোন ভাবে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তারা আসে আন্দামানে। আফ্রিকা থেকে আন্দামান এই হাজার হাজার মাইল পথ তারা কি ভাবে পাড়ি দিয়ে ছিল, তাদের সংখ্যা তখন কত ছিল তার কোন তথ্য নেই কারও কাছে।

হাজার হাজার বছর ধরে তারা বাস করছে একই ভাবে। আধুনিক মানুষের পোশাক -পরিচ্ছদ তাদের কাছে অজানা, অচেনা! জঙ্গলে গাছের পাতা বা ছাল দিয়ে বানানো তাদের পরিধান , অধিকাংশ সময়ে তারা পোশাক পড়তে অপছন্দ করে। তারা শিকারী। বন্য শূকর, হরিণ, লিজার্ড এবং সামুদ্রিক মাছ এবং কচ্ছপ শিকার করে খায়। সভ্য জগৎ ও তার সভ্য মানুষদের তারা পছন্দ করে না, তীর-ধনুক নিয়ে তেড়ে যায়।

জারোয়ারা বাস করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, প্রায় ৯০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত আন্দামান দ্বীপের জারোয়া সংরক্ষিত বন। আন্দামান দ্বীপের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আছে এর প্রধান শহর পোর্ট-ব্লেয়ার। এটি ভারতীয় নেভির একটি ঘাঁটি। বেশ কয়েক বছর আগে আন্দামান প্রশাসন এখানে নির্বুদ্ধিতার চরম পরিচয় দেয়। উন্নয়নের নামে পোর্ট-ব্লেয়ার এবং উত্তর আন্দামান মধ্যে তৈরি করে এক সংযোগকারী রাস্তা আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড যার, প্রায় ৬০ কি. মি গেছে জারোয়া সংরক্ষিত বনের ভিতর দিয়ে।

এই ট্রাঙ্ক রোডই বিপর্যয় নিয়ে আসে জারোয়াদের আদিম, প্রাকৃতিক জীবনে। ট্যুরিস্টর ধেয়ে আসে ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে অসংখ্য ট্যুর-অপারেটর। তারা চালু করে জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্টে জঙ্গল-সাফারি। ট্যুরিস্টরা আসে তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের সঙ্গে নেশা করার সামগ্রী এবং মানষিক বিকৃতি নিয়ে। অভিযোগ ওঠে জারোয়া শোষণের, তাদের নেশা করানোর, খাদ্যের বিনিময়ে তাদের নাচ করানোর এবং শ্লীলতাহানীর। প্রমাদ গোনেন পরিবেশবিদরা।

আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড এবং জঙ্গল-সাফারি বন্ধ করার জন্য মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে ২০১৩ সালে। কোর্ট জঙ্গল সাফারি বন্ধ করে, ট্যুরিস্টদের জারোয়াদের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক এমনকি জঙ্গলে তাদের ফটো তোলা বেআইনি ঘোষিত হয়। ট্রাঙ্ক রোড বন্ধ হয় না , পুলিশ পাহারায় দিনে ষাটটি গাড়ী এই রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেয়। জারোয়াদের সাথে ট্যুরিস্ট বা বহিরাগতদের কোন রকম ইন্টারঅ্যাকশন এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সভ্য সমাজ বিতর্ক উঠে। তাদেরকে কী ওই ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত, যে ভাবে তারা ৭০ হাজার বছর ধরে আছে? না তাদের সভ্য সমাজের অংশীদারি করা দরকার। তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, শিক্ষার আলো, আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া উচিত না সংরক্ষিত বনে আদিম জীবনই ভাল। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই বিতর্কে কোন সহমত নেই।

পৃথিবীর বেশিরভাগ মানবাধিকার সংগঠন ও নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘এরা যে ভাবে আছে, সে ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত।’ অভিজ্ঞতা বলে আধুনিক সভ্য জগৎ এবং মানুষের সাথে তাদের সংযোগ এই আদিম জনজাতিদের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে অসংখ্য আদিম জনজাতি এর ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কয়েক বছর আগে আন্দামান প্রশাসন এই আদিম জনজাতিদের ভবিষৎ পরিকল্পনা ঠিক করতে এক আন্তর্জার্তিক সম্মেলনের আয়োজন করে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ নৃতত্ত্ববিদ, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকগণ অংশগ্রহণ করেন।

সেখানে নির্ধারিত হয় যে, জারোয়াদের সভ্য জগতের সাথে সম্পর্কে উৎসাহিত করা উচিত কিন্তু সেটা কি ভাবে, কতটা সময় নিয়ে এবং সভ্য জগতের সঙ্গে কতটা যুক্ত হবে সেটা জারোয়ারাই ঠিক করবে। সরকারের তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কোন জায়গা নেই। ভারত সরকার এই মতামত গ্রহণ করে।

বর্তমানে জারোয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে জওহরলাল নেহেরু একদা বলেছিলেন, আমি এ আদিমদের কখনোই চিড়িয়াখানায় দেখতে চাই না। আবার সভ্যদের মতো চলুক, তাও না। ওরা থাকুক ওদের মতো সুখে, শান্তিতে।
এমটিনিউজ২৪.কম/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে