মঙ্গলবার, ০৫ জুন, ২০১৮, ০৮:৩১:০৪

চলে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ পাবনার আহসান উদ্দিন শাহ

চলে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ পাবনার আহসান উদ্দিন শাহ

এক্সক্লুসিভ ডেস্ক: চলে গেলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ’ পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার বিএল বাড়ি গ্রামের বরকত শাহের ছেলে আলহাজ আহসান উদ্দিন শাহ। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টার সময় বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ১২৬ বছর।

আহসান উদ্দিনের ছোট ছেলে সাংবাদিক গোলাম মওলা জানিয়েছে, ২৪ মে বিকালে তিনি স্ট্রোক করেন। এরপর থেকে তার অবস্থা খারাপ। এর আগেও একাধিকবার তিনি স্ট্রোক করেছিলেন। আজ (মঙ্গলবার) বাদ এশা তার জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হবে।

ইন্দোনেশিয়ায় সোদিমেদজো নামের ১৪৬ বছর সবচেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত ‘বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ’ মনে করা হচ্ছিল বাংলাদেশের আহসান উদ্দিন শাহকে।

মৃত্যুর আগে বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন তিনি। অবশ্য গত তিন বছর ধরে তিনি বসে বসে নামাজ আদায় করেন। ১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনও একদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

এ বিষয়ে আহসান উদ্দিনের ছোট ছেলে গোলাম মওলা বলেন, আমার বাবা তার দীর্ঘজীবন পরিক্রমায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির আমূল পরিবর্তন যেমন দেখেছেন, তেমনি তিনটি শতক দেখা এই প্রবীণের জীবদ্দশায় ব্রিটিশশাসিত সরকার, পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের শাসন দেখে যেতে পারেছেন। এই দীর্ঘজীবনের জন্য তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন নিয়ন্ত্রিত জীবন এবং খাদ্যাভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিয়মিত গরুর দুধ পান করতেন। তার প্রিয় খাবার ছিল দুধ কলা ভাত। তিনি নিজেই নিজের খাবার খেতে পারতেন। তিনি গরুর দুধ ছাড়া ভাত খেতে চাইতেন না।

আহসান উদ্দিন শাহ এক স্ত্রী ও ১৪ (সাত ছেলে ও সাত মেয়ে) সন্তানের জনক। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগেই ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ৫ ছেলে ও ৪ মেয়েসহ মোট ৯ সন্তান জন্ম দেন।

স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি আরও ২ ছেলে ও আরও ৩ মেয়েসহ মোট ৫ সন্তানের বাবা হন। সব মিলিয়ে ১৯৮৭ সালে তিনি ১৪ সন্তানের জনক হন।

এর আগে গত বছর মে মাসে ইন্দোনেশিয়ায় সোদিমেদজো নামের ১৪৬ বছর সবচেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিটি মারা গেছেন। ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, পাবনার আহসান উদ্দিন শাহ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। যদিও এর কোনো রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই।

মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে আহসান উদ্দিন শাহের কাছে তার বয়স জানতে চেয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমার বয়স কত হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করা হয় তখন আমার বয়স ছিল ১৮ থেকে ২০ বছরেরও কাছাকাছি।

১৯০৮ সালের দিকে ব্রিটিশশাসিত ভারত সরকার ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির কাজ শুরু করে। তিনি জানান, ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির সময় তিনি ও তার বন্ধুরা সেখানে অনেক আড্ডা দিয়েছেন।

রেললাইনের জন্য যখন মাটিকাটা শুরু হয়, তখন তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে ওই রাস্তার ওপর ডাঙ্গুলি খেলেছেন। সেখানে গরু চরিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ওই সময় আমাদের চোখের সামনে কালো রঙের মহিলারা (নারি শ্রমিকরা) জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তা উঁচু করেছে। তারপর সেখান দিয়ে রেলপথ স্থাপন করা হয়েছে।

জানা গেছে, অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলকাতার সহজ যোগাযোগের কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশশাসিত ভারত সরকার ১৮৮৯ সালে এই অঞ্চলে রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করে।

১৯০৮ সালের দিকে ব্রিটিশশাসিত ভারত সরকার ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরির কাজ শুরু করে। ওই বছরই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভ করে। এর পরের বছর ১৯০৯ সালে পদ্মায় পাকশী এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়।

১৯১০-১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে সেতুরক্ষী বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় পরের বছর ১৯১২ সালে।

এর তিন বছর পরই ১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ১ ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম চালু হয় মালগাড়ি। দুই মাস পরেই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে সেতুর ওপর ডবল রেললাইন দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ যার নামে বর্তমানে সেতুটির নামকরণ।

আহসান উদ্দিন বলেন, ওই ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ কলকাতা বন্দরে মাছ রফতানির জন্য প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে লাহিড়ী মোহনপুর, দিলপাশার, শরৎনগর ও বড়াল-ব্রিজ রেলস্টেশনগুলো চলনবিলের মাছ ও পাট রফতানির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এই বৃদ্ধের বয়স যখন ১০ বছর তখন তার বাবা বরকত শাহ মারা যান। তৃতীয় সন্তান মো. আফজাল হোসেন শাহ্ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আহসান উদ্দিন বলেন, শেখ সাহেবের ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখনই আমি ৮ সন্তানের জনক (৪ মেয়ে ৪ ছেলে)। এছাড়া ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকেই।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহায়তা করেছি। তখন আমার তৃতীয় সন্তান আফজাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে যায়। সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসে। ফিরে এসে ওরা সংঘবদ্ধভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।

এদিকে পাবনা জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢাকা (পিজেএফ)-এর সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলার বাবা আলহাজ্ব আহসান উদ্দিন শাহের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি খায়রুজ্জামান কামাল।

এক বিবৃতিতে তিনি গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করে শোকাহত পরিবারকে ধৈর্য ধারণের আহবান জানিয়েছেন। পিজেএফ নেতৃবৃন্দ মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে শোক-সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এমটিনিউজ২৪.কম/সাবা/আরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে