বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৩৯:৩৯

একে একে ধরা পড়ছে নাসিরনগর হামলার হোতারা

একে একে ধরা পড়ছে নাসিরনগর হামলার হোতারা

জাবেদ রহিম বিজন : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনার হোতারা ধরা পড়ছে পুলিশের হাতে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। সর্বশেষ ঘটনার অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে শহরের কালাইশ্রীপাড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরপর গতকাল দুপুরে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানিয়ে তাকে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পেশ করা হয়। অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সফিকুল ইসলামের আদালত তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জাহাঙ্গীর হরিপুরের আল আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক। ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি তার দোকান থেকে আপলোড করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ।

যদিও তার দোকানের দু’টি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের বিশেষজ্ঞ পরীক্ষায় এমন আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তার দোকানের আরেকটি কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। ঘটনার পরপরই পুলিশ জাহাঙ্গীরের দোকানটি সিলগালা করে দেয়। এর আগের রাতে গ্রেপ্তার করা হয় হরিপুর ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি হাজী মো. বিল্লাল হোসেনকে।

বিল্লাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। নাসিরনগরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১০১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে মোট ৮টি। সর্বশেষ ঘটনার সময় রসরাজের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের অভিযোগে তার ভাই দয়াময় দাস বাদী হয়ে ২৭শে নভেম্বর থানায় একটি মামলা করেছেন।

এরমধ্যে একটি মামলার ৪ জন সাক্ষী ও ৩ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা নিজেদের ঘটনার সঙ্গে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন এবং জড়িত অন্যদের নাম প্রকাশ করেন। পুলিশ জানায়-তাদের বক্তব্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম বেরিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীর আলম, হাজী বিল্লাল হোসেন ছাড়াও গ্রেপ্তার করা হয়েছে হিরা মোল্লা, সুজন পাঠান ও ডালিমকে। তারা সবাই নাসিরনগর হামলার গুরুত্বপূণ আসামি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সেই ছবিটি রসরাজের মোবাইল থেকে আপলোড হয়নি: ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা নিয়ে নাসিরনগরে যে তাণ্ডব হয়েছে সেই ছবি হরিপুরের রসরাজ দাশের মোবাইল থেকে আপলোড হয়নি। তবে তার একাউন্ট ব্যবহার হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ঘটনার পর তারা রসরাজের মোবাইল ফোনটি জব্দ করে পরীক্ষার জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনে বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় তারা এই মতামত পান। এতে বলা হয়, ছবিটি রসরাজের মোবাইল থেকে আপলোড হয়নি। অন্য কোথাও থেকে তা আপলোড হয়েছে।

পুলিশ বলছে রসরাজের মোবাইল থেকে ছবি আপলোড করা না হলেও ছবিটি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টে দেয়া হয়েছে। এর দায় সে এড়াতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কেউ আপলোড করার কথা স্বীকার না করছে।  জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন রসরাজের ফেসবুকের পাসওয়ার্ড জানতো আরো কয়েকজন। তাদের কারো মাধ্যমেও এটি হয়ে থাকতে পারে।  

এদিকে স্থানীয় হরিপুর বাজারের আল আমিন সাইভার ক্যাফে থেকে ঘটনার পর কম্পিউটারের দু’টি হার্ডডিস্ক জব্দ করেছিলো পুলিশ। সেগুলো পরীক্ষা করেও ছবি আপলোড করার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছেন- কম্পিউটারের ঐ দোকানটিতে কম্পিউটার ছিলো ৩ টি। এরমধ্যে দু’টির হার্ডডিস্ক তারা পেয়েছেন। আরেকটি কম্পিউটারের মনিটর পাওয়া গেলেও হার্ডডিস্কটি পাওয়া যায়নি। এটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি। এই দোকানের মালিক জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ছবি আপলোড করার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে গত ২৯শে অক্টোবর রসরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়। এর জের ধরে পরদিন ৩০শে অক্টোবর নাসিরনগর ও হরিপুরে তাণ্ডব চালানো হয়। রসরাজ কারাগারে রয়েছে। তার পক্ষের আইনজীবীরা  ইতিপূর্বে আদালতে তার জামিন আবেদন করলেও তার জামিন হয়নি।

তবে আগামী ১লা ডিসেম্বর তার জামিন শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন রসরাজের আইনজীবী সৈয়দ মোহাম্মদ জামাল। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা এডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মদ জামাল, কাজী মাসুদ আহমেদ, লিটন দেব, মো. নাসির মিয়া ও অসীম কুমার বর্ধন প্রমুখ আইনজীবী রসরাজের পক্ষে আদালতে লড়ছেন।

আদালতে যা বলেছেন হাজী বিল্লাল হোসেন:  নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া হাজী বিল্লাল হোসেন (৩৫) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওইদিন সোমবার বিকালে বিল্লাল হোসেন অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বিল্লাল হোসেন নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি। তিনি হরিপুর ইউনিয়নের পালবাড়ী এলাকার তাজ উদ্দিনের ছেলে।

পুলিশ জানায়, হাজী বিল্লাল হোসেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলার অন্যতম হোতা। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন ঘটনার দিন সে এলাকায় ছিলো। ফেসবুকে ছবিটি দেখে তার মন খারাপ হয়। এর প্রতিবাদে সমাবেশের কথা শুনে তিনি তার ইটভাটার ট্রাক এবং বাইরে থেকে লোক আনার জন্যে আরো কয়েকটি ট্রাক ভাড়া করে দেন। জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে তিনি এগুলো ভাড়া করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের পর বিজ্ঞ আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এর আগে রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আশুগঞ্জ থেকে হাজী বিল্লাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়- গ্রেপ্তারকৃত হীরা মোল্লাও নিজের গাড়ি এবং বাইরে থেকে গাড়ি ভাড়া করে দেন সমাবেশে লোক নেয়ার জন্যে। ডালিম গাড়িভাড়াসহ বিভিন্ন কাজে মোটরসাইকেল নিয়ে ছোটাছুটি করেছে। আর সুজন পাঠান জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৬৪ ধারায় যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তাদের অনেকেই সুজনের নাম বলেছেন।  

উল্লেখ্য, ফেসবুকে পবিত্র কাবা শরীফ নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র পোস্ট দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৩০শে অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদর ও হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে হামলা হয়। এ সময় দুষ্কৃতকারীরা উপজেলার অন্তত ১০টি মন্দির ও অর্ধশত ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এরপর কয়েক দফায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ির পাকঘর, গোয়ালঘর ও জাল রাখার ঘরে আগুন দেয়া হয়। এমজমিন

৩০ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে