শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:১৭:৪৬

সন্ধ্যা থেকেই বুকটা ধড়ফড় করছিল, সেই ভয়াল রাত আজো কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে

সন্ধ্যা থেকেই বুকটা ধড়ফড় করছিল, সেই ভয়াল রাত আজো কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাকে

রংপুর : অন্যান্য দিনের চেয়ে সেদিন সন্ধ্যাটা যেন কেমন ছিল। বিকেল থেকেই খবর আসছে স্থানীয় বিহারীদের যোগসাজসে আশেপাশের গ্রামে লুটপাট চলছে। থমথমে পরিস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে ঘরে বসেই সন্ধ্যাটা কাটছিল তার। তখন থেকেই বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করছিল।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন সাড়ে ১০টা। হঠাৎ বুটের খটখট শব্দ। দরজা খুলতেই উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি হায়েনাদের দল এগিয়ে এলো দরজার কাছে। অজানা আতংকে মায়ের পিছনে মুখ লুকাতে গিয়েও রেহাই মিললো না। মাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে টেনে-হেঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল বাড়ির পাশে কলা বাগানে। ২৫ মার্চ ১৯৭১। বয়স তখন সতেরো। নিয়তি যেন বড়ই অসহায় হয়ে উঠলো সেই রাতটাতে।
 
গল্পটা সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনা রংপুরের তাজহাট ক্যান্টনম্যান্ট কলোনীর আয়শা বেগমের। স্বাধীনতার এতদিন পরেও ভুলতে না পারা সেই ভয়াল রাতটার কথা আজ অবধি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। পাশবিক নির্যাতনের সেই ক্ষত শুকায়নি মনে-শরীরে। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙে এখনো। কখনো বা নির্ঘুমে রাত ভোর হয়ে যায় তার।

গত ৪৫ বছরের নির্ঘুম রাত কাটানোর লুকানো কষ্টগুলো যেন অঝোরে ঝরছিল আজ। শাড়ির আঁচোলে চোখের জল মুছতে মুছতে আয়শা জানান, কলা বাগান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তাজহাট জমিদার বাড়ির ক্যাম্পে। এরপর সেখানেও চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। মনে হয়েছিল এটাই বুঝি আজ তার জীবনের শেষ রাত। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

কতক্ষণ জ্ঞান হারা ছিলেন তা জানেন না। তখনও ভোর হয়নি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে পিপাসার্ত-ভয়ার্ত আয়শা পালিয়ে আসেন ক্যাম্প থেকে। তবে সে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। বড়ভাই ইউনূস আলীসহ প্রতিবেশী বরজাহান আলী রাস্তায় তাকে দেখে নিয়ে যান মাহিগঞ্জ বাজারে চিকিৎসকের কাছে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ওই পথ দিয়েই নানা, নানী, মামা ও বড়ভাইসহ ভারতে যাবার জন্য রওয়ানা দেন। পাঁচদিন পর ৩০ মার্চ ভারতের কুচবিহার এলাকার সুবাশপল্লি শরনার্থী শিবিরে অবশেষে আশ্রয় মেলে তাদের।

আয়শা জানান, শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার পর সেখানে যুদ্ধের জন্য আসা প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য রান্নার কাজ করতে থাকেন। এদিকে বড়ভাই সেখানেই প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে চলে যান। এভাবেই কাটে প্রায় ৯ মাস। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে।

এর কিছুদিন পরে বিয়ে হয় কুড়িগ্রাম এলাকার মুক্তিযোদ্ধা রজব আলীর সঙ্গে। বিয়ের প্রায় ১২ বছর পর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে বড় ছেলে আশরাফুল (৩০) অটোরিকশা চালিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর ছোট ছেলে আরিফুল (২৫) প্রতিবেশী প্রভাবশালীদের খপ্পরে পড়ে মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্বামী রজব আলীও এখন আর সঙ্গে থাকেন না। গত দশ বছর আগে কুড়িগ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছেন তিনি।

তাজহাট এলাকায় রাস্তার ধারে সরকারি (খাস) জমিতে বাড়ি বানিয়ে কোনো রকমে জীবন করছেন বীরাঙ্গনা আয়শা।

বিজয়ের এ মাসেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া আয়শা বেগম নতুন করে যেন বিজয়ের স্বাদ পেলেন। শেষ জীবনে তাই আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই তার।

আয়শা বলেন, ছেলের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার আর তাদের বসবাসের জন্য স্থায়ী জমির ব্যবস্থা করাটাই এখন দাবি তার। এজন্য সংশ্লিষ্ট মহলের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি। -জাগো নিউজ।
১০ ডিসেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে