মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০১৭, ০৩:৫৯:৩১

কোম্পনীগঞ্জে বন্ধ হচ্ছে না অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন

কোম্পনীগঞ্জে বন্ধ হচ্ছে না অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন

সিলেট ব্যুরো: সিলেট থেকে ছত্রিশ কিলোমিটার দূরে ভোলাগঞ্জ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অতুলনীয়। কয়েক দশক থেকেই প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসছেন এখানকার সৌন্দর্য অবলোকন করতে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত ভোলাগঞ্জ প্রসিদ্ধ দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি বলে। জিরো পয়েন্টের ডানপাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ধলাই নদী।

এক সময় ভোলাগঞ্জের এ পয়েন্টে প্রাকৃতিকভাবেই উত্তোলন করা হতো ভোলাগঞ্জের বিখ্যাত সাদা পাথর। যা ছড়িয়ে যেত সারা দেশের নির্মাণ ব্যবসায়ীদের কাছে। পাথর আহরণের কাজে নিয়েজিত থাকতেন এলাকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ।

কিন্তু এখন সে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হাত থেকে পাথর আহরণের কাজ চলে গেছে প্রভাবশালীদের কাছে। এক সময় যাদের কিছুই ছিল না, এখন তাঁরা কোটি কোটি টাকার মালিক। ধলাই নদীর চারদিকে কেবলই বিকট শব্দ। এ শব্দে প্রকম্পিত ধলাই নদীর আকাশ-বাতাস। এ শব্দ বোমা মেশিনের। ৬ থেকে ১২ সিলিন্ডারের শক্তিশালী স্যালো মেশিন নদীর বুকে বসিয়ে ৫০ থেকে ১৫০ ফুট গভীর থেকে তুলে আনা হচ্ছে বিভিন্ন সাইজের পাথর। কয়েকশ বোমা মেশিনের গগনবিদারি শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আর এভাবে পাথর তুলে প্রতিটি মেশিন মালিক দিনে কমপক্ষে ২ লক্ষ টাকার মালিক হচ্ছেন। আর আগে যারা প্রাকৃতিক উপায়ে পাথর তুলতেন, তাঁরা এখন ওই সব মেশিন মালিকের কর্মচারী হয়ে কাজ করছেন।

বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলায় ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রতিনিয়ত গতি পরিবর্তন করে স্রোত হারাচ্ছে নদী। প্রতি বছর গতি হারিয়ে নতুন পথে বাঁক নিচ্ছে ধলাই নদী। প্রায় ২০০ শক্তিশালী বোমা মেশিনের বিকট শব্দে নদী নিঃশেষ হওয়ার এ কান্না মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। শারপিন টিলা বন্ধ হওয়ার পর পাথরখেকো সিন্ডিকেটরা উপজেলার অন্তত ৬টি স্থানে বেপরোয়াভাবে পাথর লুটপাট চালিয়েছে। ৫০-১৫০ ফুট গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের সময় কিছু দিন আগে মাঝেরগাঁও এলাকায় এক শ্রমিক টিলা ধ্বসে মারা গেছে।

পাশাপাশি বাংকার পূর্বপার ,হাজির দানিয়া ,ভাঙ্গারপার, কালাইরাগ, লালপাথরসহ কয়েকটি এলাকায় অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেট পাথর লুটপাট চলছে। স্থলভাগে কয়েক ফুট নিচে দেবে যাচ্ছে পাথর সমৃদ্ধ এলাকা। এসব এলাকার পাথর উত্তোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাড়ুয়া, কলাবাড়ি কালাইরাগের কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি । তাদের নেতৃত্বে গত কয়েক দিনে নতুন করে ধলাই নদীতে ৫০/৬০টি বোমা মেশিন নামানো হয়েছে। এই বোমা মেশিন খুবই আধুনিক। এগুলো মাটির নিচে প্রায় ১৫০ ফুট গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করতে সক্ষম হয়। এছাড়া কালাপাথর এলাকা ধলাই নদীর তীরবর্তী অঞ্চল। গেলো কয়েক বছর ওই এলাকায় অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপথ হারিয়ে গেছে। আর নদী এলাকা স্থলপথের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। এতে গোটা এলাকাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কোম্পানীগঞ্জের কালাইরাগ পাথর সমৃদ্ধ এলাকা। অনেক আগে গোটা কালাইরাগজুড়ে বসতি ছিল। সংখ্যালঘুদের বসবাস ছিল এলাকায়। ছিলেন আদিবাসীরাও। কিন্তু শতাধিক ঘরবাড়ি ধ্বংস করে পাথর উত্তোলনের ফলে কালাইরাগ এখন বিরানভূমি।
তাদেও হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কবরস্থান পর্যন্ত । চোখে দেখলেই মনে হয় খুবলে খাওয়া হয়েছে পুরো এলাকা। ওই এলাকার কয়েক দিন ধরে অবাধে পাথর উত্তোলন চলছে। এর ফলে শাহ আরপিন টিলার মতো কালাইরাগেও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন এলাকার লোকজন।

২০০৯ সালে বোমা মেশিন ব্যবহৃত হওয়ার পর থেকেই চলছে এ দুর্যোগ। মাঝে মাঝে নামমাত্র অভিযান চললেও আবার শুরু হয় পাথর আহরণ।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সীমান্তবর্তী দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চল, যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও প্রভাবশালীদের একচ্ছত্র আধিপত্য পরিণত হয়েছে এক লুটপাটের রাজ্যে। দেশের কেউই জানেন না এখানকার প্রকৃত খবর। এর ফলে বোমা মেশিনে আটকা পড়া নিরীহ শ্রমিকের জীবন ও অঙ্গহানি, বানের জলে ভেসে যাওয়া শ্রমিকদের দুঃখগাথাও থেকে যায় সকলের অজান্তে। এতে প্রতি বছর শত শত শ্রমিক দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও তার খোঁজ রাখেন না কেউ।

কালাইরাগ সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুকেশ চন্দ্র দাশ জানান, শব্দদূষণ ও ধুলাবালির কারণে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটছে। বোমা মেশিনের বড় বড় গর্ত স্কুলের নিকটবর্তী হওয়ায় ঝুঁকির মুখে ছাত্রছাত্রীরা ।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে বোমা মেশিন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছিল সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০০৯ সালের ১ জুলাই বোমা মেশিন অপসারণের আদেশ জারি করা হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয় জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় সচিবকে। তবে ২০১৬ সালের শেষের কিছু দিন সেই নির্দেশ পালিত হলেও আবার মাথাচারা দিয়ে উঠেছে সেই পাথরখেকো সিন্ডিকেট ।

এ ব্যাপারে কোম্পনীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল লাইছ জানান, বোমা মেশিন ও পাথর উত্তোলনের বিষয়ে প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে । নিয়মিত অভিযান পরিচলনা হচ্ছে এবং অভিযান আরও জোরদার করতে জেলা হতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেয়োগ দেয়া হয়েছে । কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি ।
২১ মার্চ ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে