রবিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:২৩:৩১

নবীনগরে আওয়ামী লীগ নেত্রী খুনের নেপথ্যে...

নবীনগরে আওয়ামী লীগ নেত্রী খুনের নেপথ্যে...

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে : বিরোধেই ডুবে ছিলেন নবীনগর আওয়ামী লীগের নেত্রী স্বপ্না আক্তার। ইউপি নির্বাচন, বাজার কমিটি, স্কুল পরিচালনা কমিটি সবখানেই আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ছিলেন তিনি। এলাকার মাদক ব্যবসার দেনদরবারেও জড়িত তার নাম।

থানাতেও ছিলো তার প্রভাব। মামলা মোকদ্দমার তদবির করতেন। সেখানে বিভিন্ন সালিশ-দেনদরবারেও অংশ নিতেন। এতে কেউ কেউ শিকার হন হয়রানির। এসব নানা কারণে তার শত্রুর তালিকা বেড়েছে। তাদেরই কোনো একটি পক্ষ ঘাতক হয়ে উঠেছে তার। এসব বিষয় সামনে রেখেই চলছে পুলিশের তদন্ত।

তবে পরিবারের লোকজন বলছেন এলাকায় মাদক ব্যবসায় বাধা হওয়ার কারণেই খুন করা হয়েছে তাকে। নবীনগর পুলিশ জানিয়েছে সন্দেহভাজনদের ধরতে তাদের ৪টি টিম বাইরে কাজ করছে। বুধবার রাত ৯টার দিকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক স্বপ্না আক্তার (৪০)কে। তার লাশের ময়নাতদন্ত করে জেলা সদর হাসপাতালের ৩ সদস্যের একটি চিকিৎসকদল।

তাদের একজন ডাক্তার রানা নূর শামস জানান-মাথার বাম পাশে কানের ওপরে গুলির স্পষ্ট জখম পাওয়া গেছে। গুলিটি বের করে আমরা পুলিশের হাতে দিয়েছি। বাকি অন্যান্য জখম মাইনর। সেগুলো মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। তিনি মারা গেছেন গুলিতেই। আর গুলি করা হয়েছে খুব কাছ থেকে। তার ধারণা এটা পেশাদার কিলারের কাজ।
 
ঘটনার রাতেই তার ছোট ভাই আমীর হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে যাদের সঙ্গে স্বপ্নার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিরোধ আছে এমন ৬-৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা হচ্ছে বাঙ্গরা উত্তরপাড়ার আপন, বিল্লাল, নাহিদ, মেরকুটার যুবলীগ নেতা আলমগীর এবং চারিপাড়ার সাঈদ ও নাজিম উদ্দিন। এছাড়া হুড়ুয়া গ্রামের সিএনজি অটোরিকশা চালক জাহাঙ্গীরের নামও সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এরা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অপকর্মের হোতা বলে উল্লেখ করে এজাহারে বলা হয় তাদের সঙ্গে নিহত স্বপ্না আক্তারের মতবিরোধ চলছিল। অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের দিয়ে এরা স্বপ্নাকে খুন করিয়েছে বলে পরিবারের ধারণা। তাদের মধ্যে সিএনজিচালক জাহাঙ্গীরকে ওই রাতেই আটক করে পুলিশ। তাকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ওইদিন রাতে সাতমোড়া ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন থেকে ফিরে বাঙ্গরা বাজারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা খুন করে স্বপ্নাকে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান-সাতমোড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সম্মেলনে যোগ দিতে বুধবার বিকালে নবীনগর থেকে স্বপ্নাসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের ১০ জন নেতা দুটি সিএনজি অটোরিকশায় করে সেখানে যান। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সম্মেলন শেষ করে দশমৌজা গ্রাম থেকে ফেরার পথে স্বপ্না জিনদপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে যান বাঙ্গুরা বাজারে যাবেন বলে। এরপর আরেকটি সিএনজি অটোরিকশায় বাঙ্গুরা বাজার যাওয়ার পথে খুনের ঘটনাটি ঘটে। তার নিথর দেহ ফেলে রাখা হয় নবীনগর কোম্পানীগঞ্জ সড়কের ওপর।

কি কারণে নৃশংসভাবে স্বপ্নাকে এভাবে হত্যা করা হলো? হত্যাকারী কারা? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না এখনো। তবে নানা পক্ষের সঙ্গে স্বপ্নার বিরোধ প্রধান আলোচনা হয়ে উঠেছে নবীনগরে। এই বিরোধেরই বলি হয়েছেন তিনি। এমনটাই বলাবলি হচ্ছে।

উপজেলা ও জিনোদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আবদুর রউফের বিপক্ষে অবস্থান নেন স্বপ্না। সেসময় স্বপ্না প্রকাশ্যে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহিমের পক্ষে অবস্থান নেন। এঘটনায় তখন থেকে আবদুর রউফের পক্ষের লোকজনের সঙ্গে স্বপ্নার বিরোধ সৃষ্টি হয়।

ওই নির্বাচনে জিনোদপুর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান সংরক্ষিত নারী সদস্য মেরকুটা গ্রামের নারগিস আক্তারের বিপক্ষে পরশ আক্তার নামে নিজের এক লোককে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামান স্বপ্না। উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, ২০১৬ সালে জিনোদপুর ইউনিয়নের ১৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করে উপজেলা আওয়ামী লীগ।

সেসময় স্বপ্না অধিকাংশ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে নিজের পছন্দের লোকজনকে বসাতে একক প্রভাব খাটান। বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে স্বপ্নার পছন্দের লোকজনই সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বপ্না নিজের গ্রাম চারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।

একবছর আগে জিনোদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদকে সভাপতি করে বাঙ্গরা বাজার পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। ওই সময় স্বপ্না আক্তার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী রবিউল আউয়ালকে সভাপতি করে পাল্টা কমিটি দেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, স্বপ্নার বিরুদ্ধে নিজ দল এবং অন্য দলের একটা গ্রুপ সক্রিয় ছিল। তারাই মিলিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্বপ্না উপজেলা আওয়ামী লীগে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগে যোগদানের এক বছরের মধ্যেই উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক করা হয় তাকে। নিজের ইউনিয়নসহ উপজেলা আওয়ামী লীগে নারী নেত্রী হিসেবে তার একক আধিপত্য ছিল।

এবিষয়ে জিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রউফ বলেন, আমার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বপ্না আরেক প্রার্থীর নির্বাচন করেছিলো এটা ঠিক আছে। বিষয়টি উপজেলা আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীরাও জানেন। এখন তার সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে তাই বলে এভাবে হত্যা করবে। এটা একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা।

হত্যা মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই আমীর হোসেন বলেন- তার বোনকে মাদক ব্যবসায়ীরাই হত্যা করেছে। তিনি মাদকের বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান করিয়েছেন এলাকায়। তিনি বলেন এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। এর আগেও স্বপ্নাকে একবার অ্যাটাক করা হয়েছিল।

নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসলাম সিকদার বলেন- এজাহারে যাদের নাম বলা হয়েছে তারা এলাকায় নেই। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। তিনি জানান- মাদক ব্যবসা, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে স্বপ্না আক্তারের সঙ্গে অনেকের বিরোধ ছিলো। সেসব বিষয়কে সামনে রেখেই আমরা তদন্ত করছি।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে