মঙ্গলবার, ০৮ মে, ২০১৮, ১০:২০:৪৭

গল্পটা হতে পারত অন্যরকম

গল্পটা হতে পারত অন্যরকম

মাদারীপুর থেকে: দুঃখ-কষ্ট অভাব-অনটনে যাদের জীবন তাদের ইচ্ছার মূল্য কে দিবে? বড় হতে হলে মানুষের মত মানুষ হতে হয়। সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে কবিতা ও মোহনা। কিন্ত সংসারে অভাব-অনটন, মা ছাড়া নেই তেমন কোন শক্ত খুঁটি। মামা বাড়িতে মানুষ। প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে দুই বোন। তাদের ইচ্ছা ডাক্তার হয়ে দেশের সেবা করা আর দেশের উন্নায়নে নিজের শিক্ষা বিলিয়ে দেয়া। তবে অর্থনৈতিক বাধার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়ও রয়েছে দুই বোনের। এ ব্যাপারে সার্বিক সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন এমএল উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, শিবচর উপজেলা সমিতি, উপজেলা শিক্ষা অফিসসহ মাদারীপুর জেলা প্রশাসক।

৯ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু হয়। তখন ওদের বয়স মাত্র ৭ বছর। তবে এর আগে তাদের জীবন ছিল অন্যরকম, বাবা মারা না গেলে আজ সংবাদটি হতে পারতো অন্য রকম। দুই মেধাবী ছাত্রীর বাবা মৃত আব্দুল কাদের ছিল সৌদি আরব প্রবাসী। এই দুই মেধাবী সন্তানসহ তিন সন্তানের জম্ম সৌদি আরবে হয়। তবে তিন বছরের মাথায় সপরিবারে চলে আসেন বাংলাদেশে। এর আগে মা বাবা ওমরা হজ্ব পালন করেন। বাবা আ.কাদের কিছুদিন দেশে থাকার পর আবার প্রবাসে চলে যান। জীবন অনেক ভালোই কাটছিল। ছিল না কোন অভাব অনটন। এরপর আবার তিন বছর পর দেশের আসার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় আ.কাদেরের মৃত্যু হয়। থমকে যায় সংসারে সচল চাকা, আর্থিক অনটনের সংসারে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার সাহস ওদের মায়ের প্রথম অবস্থাতে না হলেও লেখাপড়ার প্রতি দূর্বার টান ও স্বপ্ন জয়ের মানসিকতাই লেখাপড়া চালিয়ে যাবার শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওদের মনে। একমাত্র ‘লেখাপড়া করতেই হবে’ এই ধারণা মনে পুষে বাবার বাড়ী কালামৃধা ইউনিয়নের গ্রাম আটরাভারসা থেকে নানা বাড়ি দত্তপাড়া ইউনিয়ন গ্রাম গুয়াগাছিয়া মায়ের সাথে এসে আশ্রয় নেয় তারা।
বাবার আদর কতটুকু পেয়েছে তা তাদের মনে থাকলেও তেমন খেয়াল নেই। মায়ের ক্লান্তিহীন চেষ্টা, বাড়ীর পাশের জমিতে শাক-শবজি, তাছাড়া বাবার রেখে যাওয়া কিছু কৃষি জমিতে চাষাবাদ করে ফসল বিক্রির টাকা ও স্কুল কমিটি, স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগীতা, ছোট মামার আর্থিক সহযোগীতা এবং নিজের অদম্য মানসিকতাকে সম্বল করে এগিয়ে যাচ্ছে দুই বোন। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কথা রেখেছে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার উৎরাইল এমএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর জিপিএ ৫ পাওয়া এই দুই বোন। এর আগে একই বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ ৫ অর্জন করে তারা।

মা কল্পনা বেগম বলেন, অভাব-অনটনের সংসারে টানাপড়েন লেগে থাকলেও তা নিয়ে কখনোই মন খারাপ করেনি এই দুই বোন। ভালো পোশাকের জন্য মাকে চাপ দেয়নি। সামর্থ অনুযায়ী যা পেয়েছে তাতেই ছিল সন্তুষ্টি। তবে লক্ষ্য ছিল ভালো রেজাল্ট করার মধ্য দিয়ে জীবনে ভালো কিছুর দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্য থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে জিপিএ ৫ ও বৃত্তিপ্রাপ্তি ওদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। এরপর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাতেও সকল বিষয়ে ৮০ নম্বর নিয়ে জিপিএ ৫ পায় এই দুই শিক্ষার্থী। স্বপ্নটা বেড়ে যায় আরো। এসএসসিতে একই ধারা বজায় রেখে ভালো একটা কলেজে লেখাপড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কবিতা-মোহনা। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৮ সনের এসএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করে স্বপ্ন জয়ের ধাপে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো।

এই দুই মেয়েকে স্কুল কমিটি, স্কুলের শিক্ষকরা ও আমার ছোট ভাই আবুল হোসেন আর্থিক, মানসিকভাবে সহযোগীতা করেছে। তবে জিপিএ ৫ পেয়েও যেন স্বতঃস্ফুর্ততা নেই দুই বোনের মনে। ভালো একটি কলেজে ভর্তি হতে পারবে কিনা এই শংকায় আনন্দ চুপসে আছে। ভালো কোন কলেজে পড়ানোর মতো আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা তাদের নেই।

মেধাবী শিক্ষার্থী কবিতার ইচ্ছা ঢাকার ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া। স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। আর ডাক্তার হবার ইচ্ছা থেকেই সায়েন্স নিয়ে পড়া। সে জানায়, শহরে পড়ানোর মতো আর্থিক অবস্থা আমাদের নেই! তবে চেষ্টা করে যাবো। বাকিটা আল্লাহর উপর।

অপর মেধাবী ছাত্রী (ছোট বোন) মোহনা বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে আমাদের নিয়ে মায়ের যুদ্ধ। আমরা ভালো কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া করে যাচ্ছি। এইএইচএসিতে ভালো রেজাল্ট করে আমিও ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা। অর্থনৈতিক বাধার কাছে যেন হেরে না যাই, এজন্য সকলের কাছে দোয়া চাই।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আশরাফুল আলম বলেন, ওরা মেধাবী এবং দরিদ্র। এই কারণেই বিদ্যালয়ের বেতন, টিউশন ফি, ফরম পূরনের টাকাসহ বিভিন্ন সময়ে এই দুইবোনকে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। এখনোও ভাল কলেজে ভর্তি হতে সার্বিক সহযোগীতা করবো। আমি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিকে জানিয়েছি তারা সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছে।

উৎরাইল এমএল উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি সভাপতি ও শিবচর উপজেলা সমিতি সাবেক সভাপতি মোসলেম আলম চৌধুরী বলেন, আমাদের দুটি কমিটি থেকেই তাদের উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হতে যে টাকা লাগবে সেটা দেবো। তাছাড়া তাদের মাসিক একটি টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কমিটির পক্ষ থেকে তাদের সাফল্য কামনা করছি।

শিবচর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, আমাদের উপজেলা শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে সর্বত্বাক সহযোগীতা করার চেষ্টা করবো। তাছাড়া জেলা পরিষদে দরখাস্ত করলে আমি একটি বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেবো।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ও দুই বোনের স্বপ্নপূরণে সার্বিক সহযোগীতা করব।
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে