বৃহস্পতিবার, ০৪ অক্টোবর, ২০১৮, ০৫:২৭:২৪

'তোর জন্য আমি যৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি'

'তোর জন্য আমি যৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি'

‘প্রাইভেটে গেলে স্যার আমাকে বলে, তুই আমার সব থেকে প্রিয় ছাত্রী। তোকে দেখলে আমার মনে হয় যেন আমি আবারও ক্লাস নাইনে ভর্তি হই। তোর জন্য আমি যৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি।’ ইংরেজি শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী।

যেখানে গড়ে উঠেছে যৌন হয়রানিকারীদের সিন্ডিকেট। কয়েকজন শিক্ষক স্কুল ও কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ অপকর্মে সহায়তা করছেন কয়েকজন নারী শিক্ষক। সম্প্রতি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের (ডিসি) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

দিনের পর দিন এমন অপকর্ম ঘটে আসার বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করা হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ কারণেই গত ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের (ডিসি) প্রতিবেদন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপে এ তথ্য জানা গেছে।

ডিসির প্রতিবেদনটি পরদিন ২ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে সেদিনই প্রতিবেদনটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ বছরের পর বছর কর্মরত শিক্ষকদের অবিলম্বে অন্যত্র বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি দোষী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালকের রুটিন দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক শামসুল হুদা বলেন, টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের পাঠানো একটি প্রতিবেদন আমরা পেয়েছি। সেখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে আসে।

তিনি বলেন, কেউ যখন কোনো অপরাধ করেন তখন তার সামাজিক পরিচয় মুখ্য থাকে না। তার প্রধান পরিচয় সে অপরাধী। আমরা কোনো অপরাধীর পক্ষ নেব না। জেলা প্রশাসক সার্বিক বিষয় তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রতিবেদন এবং ঘটনার প্রাথমিক প্রতিবেদনের আলোকে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব।

জানা গেছে, বিন্দুবাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ে ২ হাজারের বেশি ছাত্রী আছেন। তাদের পড়ানোর জন্য আছেন মোট ৫২ জন শিক্ষক। এর মধ্যে ২৫ জন নারী। প্রতিষ্ঠানটিতে এক বছর ধরে কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। মো. আল আমিন তালুকদার নামে একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।

ডিসি খান মো. নুরুল আমিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খোদ প্রধান শিক্ষকসহ কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যেত যে, তারা (শিক্ষক) ছাত্রীদের প্রাইভেট ও কোচিংয়ে বাধ্য করতেন। যারা কথা শুনতো না তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। পরীক্ষায় কম নম্বর দিতেন। যৌন হয়রানি করতেন। লোক-লজ্জার ভয়ে কোমলমতি ছাত্রীরা মুখ বুঝে সহ্য করতো। কিন্তু গত ১ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে কয়েকশ’ ছাত্রী ও তাদের অভিভাবক ওই বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক এসএম সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে স্কুল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে। প্রতিবেদনে যৌন হয়রানির শিকার বেশ কয়েকজন ছাত্রীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, বিক্ষোভকালে অভিভাবক-ছাত্রীরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ লম্পট শিক্ষকদের তাৎক্ষণিক বদলি ও শাস্তির দাবি করেন। জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এছাড়া সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত শিক্ষককে দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠান।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন শিক্ষক সংঘবদ্ধভাবেই কোচিং ও টিউশন বাণিজ্য করেন। বিশেষ করে স্থানীয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের জোরপূর্বক কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি, হয়রানির অভিযোগ বেশি। যারা কোচিং-প্রাইভেটে পড়ে, তাদের কাউকে কাউকে এবং যারা না পড়ে তাদের ক্লাসরুমে অশালীন কথাবার্তা, মন্তব্য, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছিলেন বর্তমান কারাগারে থাকা সাইদুর রহমানসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।

ঘটনার পরদিন ২ অক্টোবর টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন ওই স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তখন তারা কয়েকজন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করেন। এ সময় তারা বলেন, যৌন হয়রানিতে অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক সাইদুর রহমানকে সহায়তাকারী ও রক্ষাকারী ছিলেন শিক্ষক এ্যানি সুরাইয়া, হাবিবুর রহমান, মাকসুদা রানা ও প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার। এসব শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ডিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাইদুর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রীদের জোরপূর্বক কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট পড়তে চাপ সৃষ্টি ও হয়রানি করতেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আল মামুন তালুকদারও এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ভুক্তভোগী ছাত্রীরা এ বিষয়ে বার বার তার কাছে অভিযোগ করলেও তিনি তা আমলে নেননি।

বরং ওইসব ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন তিনি। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা খানম স্থানীয় হওয়ায় বিশেষ করে তার দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে ঐতিহ্যবাহী বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টির এ দৈন্য-দশা। প্রতিষ্ঠানটিতে চরম অব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলাহীনতার কারণে একশ্রেণির চরিত্রহীন ও দুর্নীতিবাজ শিক্ষক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছেন।

প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাত্রীদের (হাতে লেখা) কয়েকটি অভিযোগপত্র সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে এক ছাত্রী লিখেছে, ‘প্রাইভেটে গেলে স্যার আমাকে বলে, তুই আমার সব থেকে প্রিয় ছাত্রী। তোকে দেখলে আমার মনে হয় যেন আমি আবারও ক্লাস নাইনে ভর্তি হই। তোর জন্য আমি যৌবন ফিরে পাওয়ার ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি।’ ফেসবুকে অশ্লীল মেসেজ পাঠানোর কথা উল্লেখ করে এ ছাত্রী আরও লিখেছে , উল্লিখিত ইংরেজির শিক্ষক পর্ন সিনেমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন।

আরেক ছাত্রী লিখেছে, উল্লিখিত শিক্ষক তার মাকে নিয়ে অশ্রাব্য কথাবার্তা বলতেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘তোর বাবা তোর মাকে সুখ দিতে পারে না।’

অপর এক ছাত্রী লিখেছে, তার সঙ্গে উল্লিখিত শিক্ষক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে-এমন নানা অভিযোগ ছাত্রীদের।-জাগো নিউজ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে