শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৭, ০৬:৫৫:৫০

জেনে নিন তাবলিগ জামাতের ছয়টি মূলনীতি

জেনে নিন তাবলিগ জামাতের ছয়টি মূলনীতি

ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান বর্তমান জমানায় দাওয়াত ও তাবলিগের নামে সারা বিশ্বে যে ঈমানি আন্দোলন চলছে, তার তাত্ত্বিক ভিত ‘ছয় ছিফত’। তা অর্জন করতে প্রতিনিয়ত পাঁচ কাজ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত থাকা সাথিদের জন্য জরুরি করা হয়েছে।
ছয় ছিফত হলো—১. ঈমান. ২. নামাজ. ৩ ইলম ও জিকির, ৪. একরামুল মুসলিমিন. ৫. ইখলাসে নিয়ত, ৬. দাওয়াত ও তাবলিগ।

আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিরা নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তাঁরা নবী (সা.)-এর সুহবতে থেকে এ গুণগুলো অর্জন করেছিলেন। এসব গুণের কারণেই তাঁদের দ্বীনের ওপর চলা সহজ হয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনেও কেউ যদি এ ছিফত বা গুণগুলো অর্জন করার চেষ্টা করে, তাহলে দ্বীনের ওপর চলা তার জন্যও সহজ হয়ে যাবে। গুণগুলো অর্জন করার জন্য মেহনত ও আমল করতে হবে।

এর মধ্যে প্রথম ছিফত বা গুণ হলো ঈমান। ঈমান হলো এমন এক জিনিস, যা না থাকলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। ঈমানের মূল ভিত হলো কালেমা। যার সাধারণ অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, আর মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসুল। কালেমার মূল তাত্পর্য হলো, আমরা দুই চোখে যা কিছু দেখি বা না দেখি, আল্লাহ ছাড়া সবই মাখলুক। মাখলুক কিছুই করতে পারে না আল্লাহ ছাড়া, আল্লাহ সব কিছু করতে পারেন মাখলুক ছাড়া। আর হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর তরিকায় দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি ও সফলতা।

এ কালেমার লাভ হলো, যে কেউ অন্তরে এখলাসের সঙ্গে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলে, তখন এ কালেমার জন্য নিশ্চিতরূপে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। (তিরমিজি ও মুন্তাখাব হাদিস, দারুল কিতাব, ঢাকা, ২০১০, পৃষ্ঠা ২০—গ্রন্থে উদ্ধৃত)

অন্য একটি হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, তোমরা নিজেদের ঈমানকে তাজা করতে থাকো। কেউ একজন তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমরা নিজেদের ঈমানকে কিভাবে তাজা করব? তিনি বললেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বেশি বেশি বলতে থাকো। (মুসনাদে আহমদ, তাবারানি, তারগিব শরিফের হাদিস, মুন্তাখাব হাদিস পূর্বোক্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ২০)

বলা হয়, মুসলিমদের ঈমান আছে, আর এ জন্যই সে মুসলিম। কিন্তু বর্তমান জমানায় মুসলিমদের ঈমান এত দুর্বল অবস্থানে আছে যে তার সে ঈমান তাকে মসজিদে নিয়ে আসতে পারছে না। সে দুর্বল ঈমান তাকে নবী (সা.)-এর সুন্নতের ওপর চালাতে পারছে না। তাই তাবলিগের জামাতের একটি মূল কাজ হলো ঈমানের দাওয়াত দেওয়া। মুসলিমদের কাছে ঈমানের দাওয়াত আর অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত।

ছিফতের দ্বিতীয় বিষয়টি নামাজ। নামাজ হলো আল্লাহর থেকে চেয়ে নেওয়ার একটি মাধ্যম। হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম নামাজেরই হিসাব নেওয়া হবে। রাসুলে পাক (সা.) যেভাবে নামাজ পড়েছেন এবং যেভাবে তাঁর সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন, ঠিক সেভাবে নামাজ আদায় করার এক যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা। সুরা ইবরাহিমে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং রাসুল (সা.)-কে বলছেন, ‘আমার ঈমানদার বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন নামাজের পাবন্দি (অনুসরণ) করে। (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩১)

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) জীবনে শেষ অসিয়ত করেছেন যে নামাজ, নামাজ এবং নিজ গোলাম ও অধীনদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো। (আবু দাউদ শরিফ)

একজন মুসলিম কিভাবে নিজের জীবনে নামাজকে অর্জন করবে, সে ফরজ নামাজগুলো জামাতের সঙ্গে নিয়মিত আদায় করবে, ওয়াজিব ও সুন্নতের অনুসরণ করবে, নফল নামাজ বেশি বেশি আদায় করবে এবং উমরি কাজা (অনেক পুরনো দিন থেকে ছেড়ে দেওয়া) নামাজ আদায় করবে।

তৃতীয় ছিফত বা গুণ হলো ইলম ও জিকির। উভয় একই নম্বরের স্তরে রয়েছে। ইলম হলো আল্লাহর হুকুমগুলো জানা এবং নবী (সা.)-এর তরিকা অনুযায়ী সেগুলো মেনে চলা। পবিত্র কোরআনে নবী (সা.)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘বলে দিন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৯)

হাদিস শরিফে আছে, একজন আলেমের মৃত্যু অপেক্ষা একটি গোত্রের মৃত্যু অতি নগণ্য ব্যাপার। (বায়হাকি শরিফ)। এসব নানা দিক বিবেচনায় ইসলামে ইলম শিক্ষার বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইলম দুই প্রকার। এক প্রকার ফাজায়েলে ইলম। কোন আমল করলে কী কী লাভ হবে, তা হলো ফাজায়েলে ইলম। এগুলো বিভিন্ন তালিমের মজলিশ ও ফাজায়েলে কিতাব থেকে জেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মাসায়েলে ইলম জানতে হবে হক্কানি আলিমদের কাছে গিয়ে। মাসালা-মাসায়েল কখনোই মুফতি-আলিমদের ছাড়া চর্চা না করা।

আর জিকির হলো, সর্বাবস্থায় মনের মধ্যে আল্লাহ পাকের ধ্যান ও খেয়াল পয়দা করা। জিকিরের বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধিমানরা শয়নে ও উপবেশনে ও দণ্ডায়মান অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। ’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)

আবু হুরায়রা (রা.) নবী (সা.)  থেকে বলেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, যখন আমার বান্দা আমাকে স্মরণ করে এবং তার ঠোঁট আমার স্মরণে (জিকিরে) নড়াচড়া করতে থাকে, তখন আমি তার সঙ্গে থাকি। (ইবনে মাজাহ)

এ জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা আল্লাহ তাআলার জিকির করা। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে তিন তাসবিহ, সোবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, দরুদ শরিফ ও ইস্তিগফার পাঠ করা। এ ছাড়া নির্দিষ্ট স্থানে মাসনুন দোয়া পাঠ করা।

চতুর্থ ছিফাতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একরামুল মুসলিমিন, মুসলমান ভাইয়ের উপকার করা। এটা হলো, মোয়ামেলাত-মোয়াশেরাত—অর্থাৎ লেনদেন, আচার-ব্যবহারও। সমাজে মানুষের মর্যাদা জেনে সে অনুযায়ী তার সঙ্গে ব্যবহার করা। বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ ও আলিমদের সম্মান এর অন্তর্ভুক্ত।

মুসলমানদের আচার-ব্যবহার যেমন ভালো করতে হবে, তেমনি লেনদেনে একেবারে সাফ (ট্রান্সপারেন্ট) থাকতে হবে। হজরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে যেসব নসিহত করেছিলেন তা পবিত্র কোরআনে উদ্ধৃত করা হয়েছে। লোকমান (আ.) বলেছেন, ‘হে বৎস! মানুষের সঙ্গে অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার কোরো না এবং মাটির ওপর দম্ভভরে চলো না। আল্লাহ তাআলা দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তুমি নিজ চলনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিম্ন স্বরে কথা বলো, শোরগোল কোরো না। (উচ্চ আওয়াজে কথা বলা যদি কোনো ভালো গুণ হতো, তবে গাধার আওয়াজ ভালো হতো) সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ আওয়াজ হচ্ছে গাধার আওয়াজ। (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৮-১৯)

পঞ্চম ছিফত, ইখলাসে নিয়ত—অর্থাৎ নিয়তকে সহি-শুদ্ধ করে নেওয়া। আমরা যেসব কাজ করি বা না করি, সবই আল্লাহর খুশির জন্য হতে হবে। ইমাম বুখারি তাঁর হাদিস সংকলনে সহি নিয়তের বিষয়টি এক নম্বর হাদিসে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ইবনে আব্বাস (রা.) রাসুলে পাক (সা.)-কে উদ্ধৃত করে বলেন, যে ব্যক্তি নেক কাজের নিয়ত করল, (অতঃপর কোনো কারণে) করতে পারল না, তার জন্যও আল্লাহ তাআলা একটি পূর্ণ নেকি লিখে দেন। (বুখরি শরিফ)

ষষ্ঠ ছিফত হিসেবে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজটি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর দেওয়া জান ও মাল এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে শেখা। আমরা অনেক সময় আড্ডা ও নানা রকম ভুল পথে নিজের অর্থ ও সময় ব্যবহার করে ফেলি। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি আমরা জান, মাল ও সময়ের সঠিক ব্যবহারটি শিখতে পারতাম, তাহলে একটি মাত্র এ জীবন, যা মানুষ পায় মাত্র একটিবারই, তার সঠিক ব্যবহার সম্ভব হতো। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, (যারা) নিজের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট সহ্য করেছে, তারাই ঈমানে সত্যবাদী। (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৫)

হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল অথবা এক বিকেল দুনিয়া ও দুনিয়ার ভেতর যা রয়েছে, তা অপেক্ষা উত্তম। (বুখারি শরিফ)

এ ছয়টি ছিফতের ওপর মেহনত করে আমল করার জন্য তাবলিগ জামাত বিশেষভাবে তাগিদ দেয়। বলা হয়, কেউ এ বিষয়ের জন্য আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে মেহনত করলে দ্বীনের ওপর চলা তার জন্য সহজ হয়। এ জন্য জীবনে প্রথমে তিন চিল্লা (চার মাস) একটানা সময় লাগিয়ে এ কাজটি শেখার চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।-কালের কন্ঠ
১৪ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে