শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:০৯:৩৫

মিরাজের পথ ধরেই এগিয়েছে বিজ্ঞান

মিরাজের পথ ধরেই এগিয়েছে বিজ্ঞান

মুহাম্মদ ফরহাদ হোসেন: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তী জীবনে ইস্রা ও মিরাজ এমন এক অনন্য সাধারণ ঘটনা যা তাঁর নবুয়ত ও রিসালতকে বিশ্বজুড়ে দীপ্যমান করে তুলেছে। ইহজাগতিক এবং পরজাগতিক বিষয়াবলি বিশেষ করে ঈমান, সালাত, জান্নাত ও জাহান্নামের বাস্তবিক উদাহরণ মিরাজের মাধ্যমেই প্রস্ফুটিত হয়েছে।

ইস্রা ও মিরাজ বিষয়ে কোরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে : ‘পবিত্রতা তাঁরই জন্য যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদ-ই হারাম থেকে মসজিদ-ই আকসা পর্যন্ত যার আশপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনগুলো দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি শুনেন, দেখেন’-(সুরা বনি ইসরাইল : ১)।

অন্যত্র বলা হয়েছে : ‘ওই প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্র মুহাম্মদের শপথ, যখন তিনি মিরাজ থেকে অবতরণ করেন’। ‘অতঃপর ওই জ্যোতি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর নূরের কাছাকাছি হলেন। অতঃপর নেমে এলো। অতঃপর আল্লাহর নূর ও এ মাহবুবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইল; বরং তদপেক্ষাও কম এ -(সুরা আন নাজম : ১, ৮ ও ৯)।

আয়াতগুলো হুজুরের সশরীরে মিরাজ হওয়ার প্রামাণিক দলিল যা নবুয়ত প্রকাশের একাদশ সালে প্রায় ৬২১ খ্রিস্টাব্দে ২৭ রজব সোমবার শেষরাতে জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিধায় বলতে হচ্ছে, স্বপ্নযোগে মিরাজ ইতিপূর্বে ও পরে বহুবার সংঘটিত হয়েছে যা কোরআনিকভাবেই প্রমাণিত।

সূরা বনি ইসরাইলে বর্ণিত আয়াতের শাব্দিক অর্থ ‘সোবহানাল্লাজী’ এবং ‘আবদিহ’ দ্বারা সশরীরে মিরাজই প্রমাণ হয়। কেননা, স্বপ্নযোগে মিরাজ হলে ‘সোবহানাল্লাজী’ ব্যবহার হতো না কিংবা তৎকালীন কাফের সম্প্রদায়ও এ নিয়ে শোরগোল করত না।

আবার কোরআনে বর্ণিত ‘আব্দ’ দিয়ে রুহ এবং শরীর উভয়ের সমন্বয়কে বোঝানো হয়। আরবি গ্রামার অনুযায়ী ইস্রা হল বা’বে ফেল (ক্রিয়া) যার অর্থ ‘রাত্রিকালে চলা’ বা ‘নৈশভ্রমণ’। আর মিরাজ হল ইসমে আ’লা (করণবাচ্য বাচক বিশেষ্য) যার অর্থ ‘সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠা’। প্রকৃত অর্থে এটির মর্মার্থ হল ‘ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা’।

ইস্রা ও মিরাজসংক্রান্ত ঘটনা তৎকালীন আরব সমাজ, সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িসহ পরবর্তীকালের মুজতাহিদ ইমাম, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, সুফি সাধক ও বিজ্ঞানমনস্কদের মাঝে আলোচনা ও গবেষণার বিষয় ছিল।

হজরত উম্মে হানী বিনতে আবি তালেব (রা.) যিনি ইসরার স্থান সম্পর্কে প্রথম অবহিতকারী, হজরত আয়শা সিদ্দীকা (রা.), হজরত আব্বাস (রা.)সহ অন্তত ৪৫ সাহাবি থেকে ইসরা ও মিরাজের ঘটনা বর্ণিত আছে। বুখারি ও মুসলিমের মতো হাদিসগ্রন্থে এবং বিশ্বের বড় বড় তাফসির গ্রন্থ বিশেষত তাফসিরে মাযহারি, তাফসিরে কুরতুবী, তাফসিরে দুররে মানসুর, খারাইসুল কুবরা, হুজ্জাতুল্লাহিল বালীগা ও অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক বিশেষত আয যুরকানী, ইমাম ইবনে কাসীর তার আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থে এবং অনেক মুসলিম কবি ও লেখক বিশেষত মহাকবি ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবালের ‘জাবিদনামা’ গ্রন্থে ইসরা ও মিরাজ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। মুসলমানদের আরবি গ্রন্থাবলী অনুবাদ করে অনেক অমুসলিম বিদগ্ধ পণ্ডিতও মিরাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন। ইতালির বিখ্যাত কবি দাস্তে (১২৬৫-১৩২১ খ্রি.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ La Divina Comedia রচনা করেছেন।

ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) কোরআন হাদিস গবেষণা করে রায় দিয়েছেন, ‘ওয়াল হাক্কু, আন্নাহু আলাইহিস সালাম ইসরা ইয়াকজাতা লা মানাম’ অর্থাৎ বিশুদ্ধ মত হল, রাসূল (সা.)-এর ইসরা জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে, নিদ্রা অবস্থায় নয়’।

ইসলামের মূল উৎস কোরআনের বর্ণনায় এ কথা প্রমাণিত হয়েছে, মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ইস্রার ঘটনা অকাট্য ও নিশ্চিত। কাজেই এর অস্বীকারকারী কাফের। আর অপর উৎস হাদিসের বর্ণনামতে, আসমানি মিরাজের অস্বীকারকারী গোমরাহ। বহু মুসলমান এমনকি অনেক আলেম ওলামাও সন্দেহ করে যে, এত অল্প সময়ে পার্থিব ও মহাজাগতিক বাধাবিপত্তি দূর করে মিরাজ কি আদৌ সম্ভব? এ বিষয়ে আমরা একটি অপরিহার্য আলোচনা পেশ করতে পারি।

বিজ্ঞানীরা বিশেষত আলবার্ট আইনস্টাইন তার Theory of Relativity গ্রন্থে বলেন সময় (Time) আদৌ কোনো সুনির্দিষ্ট (Fixed) বিষয় নয়। এটি গতির ওপর নির্ভর করে। আলোর গতিতে (প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল) চললে সময় স্থির হয়ে যায়।

আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চললে সময় পেছনের দিকে ধাবিত হয় অর্থাৎ রবিবারের পর শনিবার, অতঃপর শুক্রবার .. প্রক্রিয়ায় আসবে। সাম্প্রতিক কালের আলোচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিন্স তার A brife history of time গ্রন্থে বলেন, Time doesnt move। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড পি ফেইনম্যান সময় প্রসঙ্গে বলেন, We physicists work with time every day but we dont ask me what is time. It is just too difficult. আবার আধুনিক বিজ্ঞান এটাও বলছে, কোনো বস্তুকে যদি সেকেন্ডে ৭ মাইলের বেশি বেগে উপরের দিকে ধাবিত করা যায় তবে তা মধ্যাকর্ষণ শক্তি (Escaped Velocity) ভেদ করে তা মহাকাশের দিকে প্রবলবেগে ছুটতে পারে। উল্লেখ্য, মিরাজে ব্যবহৃত বাহন বোরাকের (যার অর্থ বিদ্যুৎ) গতি ছিল আলোর গতির চেয়ে বেশি।

আমরা দৈনন্দিন ঘড়ির কাঁটায় যে সময় দেখি তা আসলে আমাদের নিজস্ব হিসাব কিতাব। বলা প্রাসঙ্গিক, সময় আল্লাহ পাকের একটি নিজস্ব সিফাত বা গুণ। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা সময়কে গালি দিও না, আল্লাহ পাক নিজেই সময়। পরকালের তুলনায় এসময় নিতান্তই আপেক্ষিক বিষয়।

এতে বোঝা যায়, বিজ্ঞানের সঙ্গে কোরআন কিংবা মিরাজ কিংবা রাসূল (সা.)-এর উক্তির কোনো তফাৎ নেই, বরং বিজ্ঞানকেই পথ দেখিয়েছে মিরাজ। ইফরি গ্যাগরিন, নীল আমস্ট্রং মহাজাগতিক বাধা ভেদ করে চন্দ্রাভিযানে যাওয়ার ঘটনা যদি কল্পকাহিনী না হয় তবে মহাকালের মহানায়ক মুহাম্মদ (সা.)-এর ইসরা ও মিরাজের ঘটনা কল্পকাহিনী হবে কেন?

বিজ্ঞান ছাড়াও ইসরা ও মিরাজের সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর নবুয়ত, রিসালত, ঈমান, সালাত, জান্নাত ও জাহান্নামের অনন্য সম্পর্ক আছে। সবচেয়ে বড় কথা, পার্থিব আদেশ সংবলিত মিরাজের সবক আজ মুসলিম উম্মার জন্য এক অপরিহার্য বিষয়। যেমন : ১. শিরিক করো না। ২. মাতা-পিতাকে সম্মান করো। ৩. প্রাপকের প্রাপ্য পরিশোধ করো এবং মিসকিন ও দরিদ্রদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। ৪. অপচয় করোনা না, কৃপণতা করো না। ৫. সন্তান হত্যা করো না। ৬. ব্যাভিচারের কাছেও যেয় না। ৭. অন্যায়ভাবে কাকেও হত্যা করে না। ৮. ইয়াতিমের মাল বিশ্বস্ততার সঙ্গে হিফাজত করো। ৯. প্রতিশ্রুতি পালন করো। ১০. মাপে কম দিও না। ১১. যে বিষয়ে তোমার কোনো প্রমাণ নেই, তাকে অনুসরণ করো না। এবং ১২. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা করো না।

আমরা বলতে চাই, বিজ্ঞানময় মিরাজ অনুসন্ধান পিয়াসু মু’মিন ও বিজ্ঞানীদের অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান দিয়েছে।

মিরাজের ঘটনা উপলব্ধি করতে হলে আধুনিক বিজ্ঞানীদেরই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পরিহার করে অধিকতর সিদ্ধান্তে আসতে হবে। একচুল পরিমাণ সন্দেহ নেই, সে সিদ্ধান্ত হবে নিশ্চিতভাবেই বিজ্ঞানময় কোরআনিক সিদ্ধান্ত। মিরাজের পথ ধরেই যখন বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও নভোচারিরা চলতে শিখবে তখনই রাব্বুল আ’লামিন ও রাহমাতুল্লিল আ’লামিনের ইসরা ও মিরাজসংক্রান্ত চির রহস্যের দুয়ার আগামী প্রজন্মের কাছে উদঘাটন সম্ভব হবে।-যুগান্তর
লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
২১ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে