শনিবার, ০২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৭:১৯:২৯

বিশ্বমানবতার সর্বোত্তম সুহৃদ মুহাম্মদ (সা.)

বিশ্বমানবতার সর্বোত্তম সুহৃদ মুহাম্মদ (সা.)

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: পৃথিবীর গতিপথ যখনই অন্ধকারপানে ছুটে চলেছে তখনই তাকে সত্য, ন্যায় আর আলোকের পথে পরিচালিত করতে নবী-রাসুল হিসেবে যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন অসংখ্য মহামানব। বিশ্ব-স্রষ্টা প্রেরিত মহামানবদের এই নিস্কলুষ ও পুণ্যার্থী কাফেলার সর্বশ্রেষ্ঠ দিকপালের নাম বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.). যার শুভাগমনের ফলে মানবেতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট যুগটি সবদিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।

সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানের ঝাণ্ডা নিয়ে মানব সমাজে প্রেরিত মহাপুরুষদের সবাই কোনো না কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল অথবা নির্দিষ্ট ভাষাভাষীর জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন ইতিহাসের একমাত্র নবী ও রাসুল (সা.), যিনি সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। প্রাচ্য-প্রতীচ্য, সাদা-কালো আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানবজাতির কল্যাণেই তার আবির্ভাব।

বিশ্বের একমাত্র নির্ভুল মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ঘোষিত হয়েছে- ইয়া আইয়ুহান্নাস ইন্নি রাসূলুল্লাহি ইলাইকুম জামিআ। অর্থাৎ হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের সবার জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। তাই তিনি কোনো অঞ্চলভিত্তিক অথবা কোনো নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি; বরং মহান সত্তার পক্ষ থেকে সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য করুণার প্রতীক হিসেবে তাকে ঘোষণা করা হয়েছে।

তিনি হলেন মানবতার সবচেয়ে পরম সুহৃদ, সর্বোত্তম বন্ধু ও অজ্ঞতা-অন্ধকারের বিপরীতে জ্ঞানালোকের জাজ্বল্যমান এক দীপশিখা। শুধু মুখের কথায় নয়, তিনি বাস্তবে তার ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান-প্রজ্ঞা আর সুমহান আদর্শের বদৌলতে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এক বিশ্বকে শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, কল্যাণ আর সুবিচারের আলোকমালায় উদ্ভাসিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম সুহৃদ হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)।

জন্ম থেকে ওফাত অবধি রাসুলের (সা.) কাজকর্ম, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, দিকদর্শন, নীতিবিধান, ইশারা-ইঙ্গিত, নীরবতা অবলম্বন, পানাহার, প্রাত্যহিক জীবনপঞ্জি- সবকিছুই মানবতার কল্যাণে উৎসর্গীকৃত। পৃথিবীতে আসার প্রেক্ষাপট খুবই শিক্ষণীয়, জন্ম তার শিহরণ জাগানিয়া নানা ঘটনা ও অলৌকিকত্বে ভরপুর, কর্মে তার সাফল্য আর কৃতিত্বে চিরভাস্বর; জ্ঞান-গুণ, মহিমা, সৌন্দর্যে তিনি অতুলনীয়; আদর্শের সর্বোত্তম নজির স্থাপনে তিনি অনবদ্য; চারিত্রিক মাধুর্য আর অনন্য ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যে তিনি সব দৃষ্টান্তের ঊর্ধ্বে এবং পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠত্বের রেকর্ড গড়ার ক্ষেত্রে সর্বকালের সব মানুষকে ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন এক উচ্চতায়, যা অতিক্রম করা কস্মিনকালেও কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।

অনুসারী, শিষ্য ও উম্মতের প্রতি মমত্ববোধ- যে কোনো ভাবাবেগকে হার মানিয়ে দেয়। ত্যাগ ও সর্বপ্রকার কষ্ট-যাতনা, ভোগেরও সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত তিনি। জন্ম নিলেন অন্ধকার যুগে, বর্বর এক জনগোষ্ঠীর মাঝে, জন্মের আগেই হারালেন পিতাকে, জন্মের পর মাতাকেও বিদায় জানালেন, ভরণপোষণ আর দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া দাদাকেও আর বেশিদিন পাননি। তারপরে অভিভাবকত্বের মমত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন যে চাচা, তাকেও হারালেন। বিদুষী ও মহীয়সী যে নারীর আশ্রয়ে রচনা করেছিলেন দাম্পত্য ও ভালোবাসার পরম বন্ধন; সেটিও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

এভাবে ধারাবাহিক প্রিয়জন হারানোর বেদনা আর চরম অসহায়ত্ব নিয়ে তাকে মাতৃভূমির দুষ্টচক্রের সর্বপ্রকার অসহ্য প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। এরই মাঝে অজ্ঞ-পাষণ্ড সমাজে তিনি অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়ে সবার প্রিয় পাত্র হয়েছেন। কখনও ভূষিত হয়েছেন নানা অভিধায়, কখনও প্রলোভনের শিকারও হতে হয়েছে; কিন্তু পার্থিব ভোগ-বিলাস আর লোভ-লালসা তার জীবন-দর্শনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কৈশোর ও যৌবনে সমসাময়িক দুর্দশা লাঘবে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন, হতাশ হয়ে যাননি। কখনও শান্তি সংঘ আবার কখনও বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ বা সমাধানের মাধ্যমে সবার নজর কেড়েছেন এবং মানুষজনের কাছে সততা-বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। মানুষ তথা সৃষ্ট জীবের কল্যাণ কামনার পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি।

মহান স্রষ্টার একত্ববাদ, রিসালাত আর মহাসত্যের দিকে যখনই মানুষকে আহ্বান করেছেন, তখনই প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্ম্য তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ জলাঞ্জলির ভয়ে তৎকালীন সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তারাই তার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। তাকে নিষ্ফ্ক্রিয় করতে ও তার কাজ থেকে তাকে নিবৃত্ত করতে সব ধরনের প্রয়াসই সমাজপতিরা চালাতে থাকে। মন্ত্রণালয় গৃহে, পরামর্শ সভার মাধ্যমে পৃথিবী থেকেই চিরতরে তাকে বিদায় করে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। অত্যাচার, নির্যাতন আর কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রই তাকে মহাসত্যের পথ থেকে নিষ্ফ্ক্রিয় বা নিবৃত্ত রাখতে পারেনি; বরং ক্রমান্বয়ে একত্ববাদের মহিমা আরও ছড়িয়ে পড়তে থাকে; দিজ্ঞ্বিদিক সম্প্রসারিত হতে থাকে।

মুহাম্মদকে (সা.) প্রিয় মাতৃভূমির মায়া পরিত্যাগ করতে হয়। হিজরতের মাধ্যমে ইয়াসরিব তথা মদিনায় নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়নে আরও দুর্বার গতিতে তিনি অভীষ্টপানে অগ্রসর হতে থাকেন। নানা কৌশল, চুক্তি, চক্রান্ত মোকাবেলা এমনকি যুদ্ধের দামামাও বাজাতে হয়। সাফল্যের পাশাপাশি শিক্ষণীয় পরাজয়ও বরণ করতে হয় কখনও, তবে সবকিছুই মহান প্রভুর ইচ্ছামাফিক আর তার সদয় সহযোগিতায় সম্পন্ন হতে থাকে। ইতিমধ্যে নানা দেশে, বহু সমাজে তার খ্যাতি, মুজেজা, ন্যায়বিচার আর উত্তম আদর্শের কথা ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা দলে দলে ইসলামের কল্যাণের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সব বাধা-প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটতে থাকে। সর্বত্র তাওহিদের জয়গান উচ্চকিত হতে থাকে।

সুদৃঢ় নেতৃত্ব আর অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে উদারতা আর মহানুভবতার সর্বোত্তম নজির স্থাপন করেন তিনি। কারও প্রতি নূ্যনতম প্রতিশোধপরায়ণতা তার মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি। সব মানুষকে একই কালেমার মূলমন্ত্রে আবদ্ধ করেন। চরম শত্রুরাও পরম বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতদিনে তার নবুয়তি মিশন সাফল্যের বনলতায় আচ্ছন্ন হয় এবং পরম প্রভুর ইচ্ছারও বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। তাই তো অবতীর্ণ হয়- 'আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিমাতি ওয়া রাদিতু লাকুল ইসলামা দিনা।' অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের ওপর তোমাদের জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম; তোমাদের ওপর প্রতিশ্রুত সব অনুগ্রহ সম্পন্ন করে দিলাম; আর তোমাদের জন্য জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকেই সাব্যস্ত করে দিলাম।

ইসলাম মানে শান্তি। মহান প্রভুর পক্ষ থেকে তার সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুলের (সা.) মাধ্যমে মানুষ ও মানবতার জন্য যে জীবন বিধান প্রবর্তিত হয়েছে, তাই হলো ইসলাম, বাস্তব জীবনে যা সত্যিকার অর্থেই প্রকৃত শান্তি এনে দিতে পারে। ইসলামের আবির্ভাবই হয়েছে সর্বপ্রকার অশান্তি দূরীকরণের মাধ্যমে স্বস্তি ও নিরাপত্তাদায়ক প্রকৃত শান্তি বিধানের লক্ষ্যে। অশান্ত মরুময় ও বর্বর আরব সমাজ ইসলামের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেই সেই ঈপ্সিত শান্তির সন্ধান ও নিশ্চয়তা লাভ করেছিল।

ঝঞ্ঝাবিক্ষুুব্ধ ও সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠা একটি বৃহত্তর অঞ্চল, সমাজ ও জনগোষ্ঠী ইসলামের কল্যাণেই মানবজীবনে অপরিহার্য শান্তি-সাফল্যের অমিয় সুধা পান করতে সক্ষম হয়েছিল। আর সেই ইসলামের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও সর্বোত্তম নমুনা হলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.); যিনি তার গোটা জীবনকেই মানবতার খেদমতে নিয়োজিত ও উৎসর্গ করেছিলেন।

আজকের আধুনিক বিশ্ব সমসাময়িক নানা জটিলতা আর বহুবিধ সমস্যা নিরসনে মহানবীর (সা.) অনুপম জীবনাদর্শকে অনুসরণ করে কাঙ্ক্ষিত শান্তি অর্জন করতে পারে। জর্জ বার্নার্ড শ সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই বলেছেন- 'আজকের সমস্যা-সংকুল বিশ্ব যদি তার এই জগৎ-সংসারের সমুদয় দায়দায়িত্ব মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) হাতে অর্পণ করে, তবে সব সমস্যারই সঠিক ও আশাব্যঞ্জক সমাধান হয়ে যাবে।' পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে- 'লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা'।

অর্থাৎ তোমাদের জন্য তোমাদের রাসুলের (সা.) জীবনের ভেতরেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ সেই মহানবীর (সা.) সর্বোত্তম আদর্শকে অনুধাবন, অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে প্রত্যাশিত শান্তি ও সফলতার বাতিঘর প্রজ্বলিত করব- আজকের মিলাদুন্নবীর (সা.) পবিত্র দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে