বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৫৫:৫৯

১৫৮ বছর আগের ছোট্ট পাঠশালাটি যেভাবে হয়ে উঠল একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

১৫৮ বছর আগের ছোট্ট পাঠশালাটি যেভাবে হয়ে উঠল একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

আশরাফুল ইসলাম : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) হলো দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যার শুরুটা হয়েছিল ১৫৮ বছর আগে একটি পাঠশালা দিয়ে।

কালের পরিক্রমায় সেই পাঠশালা থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ  অতঃপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমন ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়েই পথ চলছে দেশের স্বনামধন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কথা। শিক্ষানুরাগী ব্রজসুন্দর মিত্র, অনাথবন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায় ও দীননাথ সেন যৌথ প্রচেষ্টায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি পাঠশালার যাত্রা শুরু করেন। পাঠশালাটির নাম দেন ব্রাহ্ম স্কুল। সেই ১৮৫৮ সালের ব্রাহ্ম স্কুল কালের স্রোতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পেরিয়ে ২০০৫ সালে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। যার নাম দেওয়া হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল পরিচালনার ভার ১৮৭২ সালে গ্রহণ করেন বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী। তিনি এর নাম বদলে তার পিতার নামে রাখেন ‘জগন্নাথ স্কুল’।

১৮৮৪ সালে এটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজের মর্যাদা লাভ করে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর জগন্নাথ কলেজই রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই ঢাকাবাসীর উদ্দেশে তার বিখ্যাত ভাষণটি দেন। ঢাকায় এসে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম বক্তৃতা এই কলেজেই দিয়েছিলেন। সে সময় এটিই ছিল ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি কলেজ।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নিউমার্কেট এলাকায় জগন্নাথের সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ শতাংশ বই দান করা হয়।

জগন্নাথ কলেজে আই এ, আইএসসি, স্নাতক (পাস) শ্রেণি ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হয়। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কলেজটিকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। পুরান ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারিকরণ করা হয়।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রার অল্প কয়েক বছরেই বিশেষত ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চ শিক্ষার্থীদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়।

গৌরব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এবার ১ যুগে পদার্পণ করছে। আর ব্রাহ্মস্কুলের সেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫৮ বছরে পা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত এর ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বহন করেছে। ২০১১ সালে এটি প্রকৃত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা অর্জন করে।

বর্তমানে সাড়ে ৫ শতাধিক শিক্ষক, সাড়ে ৪ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছয়টি অনুষদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৩৬টি বিভাগ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অন্তর্গত বিবিএ এবং এমবিএ প্রোগ্রাম এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনকারী একদল শিক্ষক নিষ্ঠার সঙ্গে এই অনুষদে অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এ ছাড়াও খুব কম সময়ের মধ্যে এই অনুষদের বিভাগগুলো উচ্চতর গবেষণা তথা এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছে।

সাবেক জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) কয়েকটি হল, হোস্টেল ও ডরমেটরি ছিল। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের আবাসিক হলের জন্য একাধিকবার আন্দোলন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান উপাচার্য হল নির্মাণের জন্য জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

বর্তমানে ২০ তলা বিশিষ্ট একটি ছাত্রীহলের কাজ চলছে, একাডেমিক ভবনের ২০ তলা ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ চলছে। এ ছাড়া একটি ছাত্রহল ও একাডেমিক ভবন প্রস্তাবিত রয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ রফিকউদ্দিন (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকেরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র, কাজী মোতাহের হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত ও নুরুল মোমেন, শিক্ষাবিদ ও গবেষক আনিসুজ্জামান, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী সাঁতারু ব্রজেন দাস প্রমুখ এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

বর্তমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদের একাধিক সদস্যও এ প্রতিষ্ঠানেরই ছাত্র ছিলেন। -রাইজিংবিডি।
২০ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে