বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৭, ০১:১৭:০০

একটা ভুলের জন্য জেদে বলি ৩টি প্রাণ!

একটা ভুলের জন্য জেদে বলি ৩টি প্রাণ!

নিউজ ডেস্ক : চাপা স্বভাবের আনিকা (২৫) ছিলেন খুবই জেদি। নিজের সুখ-দুঃখের কথা কারো সঙ্গে তেমন ভাগাভাগি করতেন না। নিজেই জ্বলতেন অভিমানের আগুনে। নিজের মনে জেদ পুষে ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। তার স্বজন ও পরিচিতদের প্রায় সবার ধারণা ‘অবশেষে অবুঝ দু’শিশু সন্তান মরিয়ম ওরফে শামীমা (৫) ও আব্দুল্লাহ (৩)কে গলা কেটে আনিকা নিজেও গলায় ফাঁস দিয়ে সেই জেদের বলি হলেন।’

স্বামী শামীম হোসেনের সঙ্গে তুচ্ছ রাগারাগি ও গালাগালির পর গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে একটি চিরকুট লিখে রেখে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আত্মহনন করেন তিনি।

গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিন লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে আনিকার মা নাদিরা বেগম মেয়ে ও নাতি-নাতনির লাশ গ্রহণ করেন। এর আগে ওই দিন দুপুরে তিনি বাদী হয়ে শামীমকে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে দারুসসালাম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আর ঘটনার পর থেকে শামীম থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। বুধবার রাত বা আজ বৃহস্পতিবার সকালে নওগাঁয় আনিকার গ্রামের বাড়িতে লাশ দাফনের কথা রয়েছে।
 
এদিকে হত্যাকাণ্ডের আগে আনিকার রেখে যাওয়া চিরকুটেও ফুটে উঠে তার জেদের স্বভাব। দীর্ঘ ও অগোছালো বাক্যে চিরকুটে লেখা ছিল, ‘শামীম তোমার একটা ভুলের জন্য এত বড় ঘটনা। তুমি ভেবেছো আমি শুধু শুনবো। না। তুমি সবার কথা ভাবো, আমাদের কথা ভাবো। আমি সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি। থাকবো না। পৃথিবী ছেড়ে। আর বলেছিলাম না। আমি যেখানে ওরাও সেখানে। একটাই কষ্ট-মা, ভাইবোন, নানি আর অনেকের মুখ দেখতে  পেলাম না। ছেলেমেয়ে নিয়ে গেলাম। সবাই ভালো থাকো, মা আমি এই দুই হাত দিয়ে ওদের খাইয়েছি, তেল দিছি। আর আজ আমি সেই হাত দিয়ে মারলাম। আমাকে তোমরা মাফ করে দেও। আমাদের কপালে এ ছিল। ওরা দুইজন নিষ্পাপ। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। ইতি-আনিকা-শামিমা-আব্দুল্লাহ।  

আনিকার ফুফাতো ভাই রাশিদুল গতকাল দারুস সালাম থানায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বোন খুবই জেদি ছিল। জেদের বশেই দু’শিশুকে জবাই করে সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। শামীমের সঙ্গে তার কোনো সমস্যার কথা সে তেমন একটা বলতো না।’

ঘটনার পর থেকে গতকাল বুধবার ঘটনাস্থল, বাসা-মালিকের বাড়ি ও স্বামী শামীম হোসেনের কর্মস্থল বেড়িবাঁধের সেলুন ও থানায় অন্তত অর্ধশতাধিক লোকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের প্রায় সবাই আনিকার জেদই এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ও আত্মহত্যার কারণ হতে পারে বলে জানান।

ওই বাসার দারোয়ান লিটনের বরাত দিয়ে বাসা মালিক মো. আবু সাঈদের স্ত্রী উম্মে সালমা বলেন, গতরাতে তাদের মধ্যে একটু ঝগড়া হয়। সকালে আবার ঝগড়া হয়। এর জের ধরেই এ কাণ্ড ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘আনিকা চাপা স্বভাবের ছিল। বেশ জেদিও ছিল।’

তাদের প্রতিবেশী মৌসুমী বেগম বলেন, আমরা ৯ পরিবারের লোকজন তাদের বাসার সামনের চুলায় প্রতিদিন দু’বেলা রান্নাবান্না করি। আনিকার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো। আমাদের সঙ্গে মিশতো। কিন্তু তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলতো না। অপর প্রতিবেশী শিউলী আক্তার বলেন, তাদের মধ্যে তেমন ঝগড়া হতো না। আনিকা আমাদের সঙ্গে মিশলেও তার ভালোমন্দের কথা বলতো না। দুপুরের দিকে প্রায় সময় দরজা বন্ধ করে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ঘুমাতো। শামীমের বোন মুন্নি বেগম বলেন, ভাই ও ভাবী দু’জনেই ভালো ছিল। তাদের মধ্যে ভালোবাসাও ছিল। ভাবী সন্তানদের সব সময় আগলে রাখতেন।

স্বজন, প্রতিবেশী ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সোমবার সকালে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছুটা বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর যথারীতি উভয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শামীম স্ত্রীকে বলেন, ‘মুখ কালো করছো কেন?’ জবাবে আনিকা বলেন, ‘সকালবেলা উঠেই আবার শুরু করছো? ঘুম থেকে কার মুখ দেইখ্যা উঠো (গালি বাচক শব্দ)’। এ কথার জবাবে শামীমও গালি দিয়ে বলেন, ‘তোর মার...মুখ দেইখ্যা উঠছি।’

এরপর শামীম বাসি ভাত আমি খাই না বলে শুধু পানি খেয়ে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে যান। কিছুটা দূরে দিয়াবাড়ী বেড়িবাঁধে গিয়ে তার সেলুন খুলেন। সকাল সাড়ে ১১টার পর দোকান বন্ধ করে আরো ৭-৮ জন সমবয়সীর সঙ্গে শহীদ সোহরাওয়াদী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জনসভায় যান। সেখানে বিকালে তার বন্ধুদের মোবাইলে এ ঘটনার খবর দেন সবুজ নামে অপর এক বন্ধু। তখন তার সঙ্গে যাওয়া রাজু, তুষার, মোস্তাফিজ তাকে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা হন।

বন্ধুরা তার কাছে এ ঘটনার কথা চেপে গিয়ে বলেন ‘স্ত্রী-সন্তানদের মারধর করেছে তাই তাকে বাসায় যেতে বলেছে।’ তখন শামীম তার বন্ধুদেরকে স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি ও গালাগালির ওই বর্ণনা দেন বলে জানান তারা। একই কথা জানান থানা পুলিশ এবং প্রতিবেশীরাও। আর ঘটনার দিন বাসার কাছে এসে এই হত্যাকাণ্ড জানার পর কান্নাকাটিতে শামীম পাগলপ্রায় হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

শামীম হোসেন গোপালগঞ্জের মোকসুদপুর থানার ভাবরাশুর গ্রামের মো. ইয়াছিন হোসেনের ছেলে। প্রায় একযুগ আগে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার নবগ্রাম এলাকার মৃত আইনুলের মেয়ে আনিকার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর তাদের কোল জুড়ে আসে ওই দু’সন্তান। দীর্ঘদিন ধরে তারা ঢাকায়। ২০১৫ সালের ১লা জুলাই তারা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবু সাঈদের ওই টিনশেড বাসার রান্নার চুলার পাশের কক্ষটিতে ভাড়ায় উঠেন।

আর ছয় মাস আগে বেড়িবাঁধে মনোয়ার হোসেনের দোকান ভাড়া নিয়ে ওই সেলুন খুলে। এর মধ্যে গত এক মাস ধরে বুকের বামপাশে ব্যথা ও জ্বরের কারণে শামীম অনেক সময় দোকানও খুলতে পারেননি। এছাড়া অভাব-অনটন নিয়েও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল বলে জানা গেছে। স্বামীর সঙ্গে জেদ করে কয়েকবার তিনি সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িও চলে যান বলে জানা গেছে। আর সর্বশেষ করুণ পরিণতি সবাইকে কাঁদিয়ে গেল।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ গ্রহণ করেন আনিকার মা নাদিরা। এরপর লাশ নিয়ে তিনি নওগাঁয় নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন।

নিহত আনিকার আত্মীয় সোহাগ বলেন, মধ্যরাতে তাদের নওগাঁয় পৌঁছানোর কথা। রাতে বা সকালে জানাজা হতে পারে। এরপর স্থানীয় কবরস্থানে মা ও দু’সন্তানের লাশ দাফন করা হবে।

দারুসসালাম থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুকুল আলম বলেন, তুচ্ছ ঘটনা থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে। উভয়ের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শামীম বলেন, ‘তুই গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে পারোস না’। এই বলে বাসা থেকে বের হয়ে যান তিনি। শামীমসহ উভয়পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের বর্ণনা অনুযায়ী মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা মামলার একমাত্র আসামি শামীমকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে একই থানার উপ-পরিদর্শক মো. নওশের আলীর ওপর। তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে তদন্তের ভার পেয়েছি। এরপরই তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। এমজমিন

১২ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে