মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:১০:৪৯

ওপারে স্বামী আর এপারে স্ত্রী মিলে ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদ

ওপারে স্বামী আর এপারে স্ত্রী মিলে ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদ

রোকনুজ্জামান পিয়াস : ওপারে স্বামী আর এপারে স্ত্রী। এই দুয়ে মিলে গড়ে তুলেছেন ভয়াবহ প্রতারণার ফাঁদ ও মানবপাচারের বিশাল সিন্ডিকেট। স্বামী বাকির আলীর অবস্থান লিবিয়ায় আর স্ত্রী নাজনীন থাকেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পিতার বাড়িতে। বাকির আলী লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অপরহরণ করে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে। আর দাবিকৃত টাকা ভিকটিমের স্বজনদের কাছ থেকে বিকাশ নম্বরের মাধ্যমে আদায় করে স্ত্রী নাজনীন।

পরে সেই সে টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয় অপহরণচক্রের অন্যান্য সদস্যের পরিবার-পরিজনের কাছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছে দেশটিতে অবস্থানরত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থানার কাঁচপুর গ্রামের রউফ ওরফে রুপ মিয়ার ছেলে বাকির আলী নিয়ন্ত্রিত লিবিয়ার বাংলাদেশি অপহরণকারী সিন্ডিকেট। বর্তমান তার কব্জায় রয়েছে শতাধিক বাংলাদেশি। তাদের জিম্মি রেখে চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন।

সম্প্রতি বাকিরের স্ত্রী নাজনীনসহ এই সিন্ডিকেটের ৬ পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাকিরসহ তার চক্রের অন্যান্য অপহরণকারীরা। পিবিআই সূত্র জানায়, তারা সেখানে বাকিরের জিম্মায় থাকা অপহৃত বাংলাদেশিদের উদ্ধার ও চক্রের অন্যান্য সদস্যকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পিবিআই জানায়, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে চক্রের দেশীয় ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর লিবিয়ায় মানবপাচারের ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে। গতকাল আদালতে গ্রেপ্তারকৃতরা জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে মুক্তিপণের লাখ লাখ টাকা লেনদেনের কথা স্বীকার করেছে তারা। পিবিআই সূত্র জানায়, লিবিয়ায় অপহৃত দুই অপহৃতের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা ব্যাপক অনুসন্ধান চালায়।

 অনুসন্ধানে তারা লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের অপহরণের ভয়াবহ তথ্য পায়। সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের অপহরণ করে বাংলাদেশেরই একটি চক্র। কখনো সরাসরি অপহরণ করে। আবার কখনো ইতালি বা ইউরোপের কোনো উন্নত দেশে পাঠানোর কথা বলে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে গিয়ে জিম্মি করে। ইতালি পাঠানোর কথা বলে ভিকটিমের কাছ থেকেও তার অর্থ আদায় করে।

এরপর জিম্মি করার পর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। সেগুলোর ভিডিওচিত্র ধারণ করে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। বাকির এমন একটি চক্রের মূল হোতা। সে সেখানে বাংলাদেশিদের অপহরণ করে জিম্মি করে। এরপর নির্যাতন। পরে নির্যাতনের ভিডিও জিম্মির পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দাবি করে মোটা অঙ্কের টাকা। একজন জিম্মির কাছে একবার নয়, বরং একাধিকবার মুক্তিপণ আদায় করে।

 পিবিআই সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তারা জানতে পেরেছেন এই চক্রটি এর আগেও বাংলাদেশিদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। বর্তমানে তার জিম্মায় এখনো শতাধিক বাংলাদেশি রয়েছে। এদিকে গতকাল আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেপ্তারকৃত এই আসামিরা। জবানবন্দিতে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে।

সূত্র জানিয়েছে, অপহরণচক্রের মূল হোতা বাকিরের স্ত্রী নাজনীন বেগম জবানবন্দিতে বলেন, তার স্বামী গত ৬ বছর আগে মিশরে যায়। এর কয়েক মাস পর লিবিয়া যায়। লিবিয়ায় গিয়ে প্রথমদিকে বাকির কোনো টাকা পাঠাতো না। ফোনে কথা হতো দু’চার মাস পরপর। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সে পিতার বাড়িতে থাকতো। গত ২৫-৩০শে জুলাইয়ের মধ্যে কামাল নামে এক ব্যক্তির বিকাশ অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা পাঠায়। ওই টাকা তার স্বামী আরো কিছু নম্বরে পাঠাতে বলে। কিছু টাকা অন্য অ্যাকাউন্ট থেকেও পাঠায়।

গ্রেপ্তারকৃত বিকাশ এজেন্ট কামাল তার জবানবন্দিতে বলেন, তার কিশোরগঞ্জ জেলায় ভৈরবপুরে রুপা মেডিকেল হল নামে একটি ফার্মেসি আছে। পাশাপাশি একজন বিকাশের এজেন্ট। ফার্মেসির পাশে নাজনীন বেগমের বাড়ি। জবানবন্দিতে সে বলেন, নাজনীন বেগম বলে যে, তার স্বামী লিবিয়া টাকা পাঠাবে। সে অনুযায়ী  গত ২৫শে ১ লাখ ২০ হাজার, ২৭শে জুলাই ২ লাখ ৭০ হাজার, ২৯ ও ৩০শে জুলাই ৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা তার বিকাশে আসে।

এভাবে গত ২৫-৩০শে জুলাই পর্যন্ত তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে ৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা আসে। এরপর ৩১শে জুলাই নাজনীন দোকানে এসে বলে, তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে আরো ১০ লাখ টাকা আসবে। বেবি আক্তার নামে গ্রেপ্তারকৃত আরেক আসামি বেবী আক্তার বলেন, তার স্বামী ইটালী থাকে। তার ননদের স্বামী মো. জাকির হোসেন লিবিয়া প্রবাসী। সে ফোন করে জানায় যে, বিকাশের দোকানদার কাশেমের নিকট ২ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে। টাকাগুলো নিতে বলে।

কাশেমের কাছ ওই টাকা নিয়ে কয়েকদিন পর জাকির হোসেনের কথামতো ১ লাখ ৮৫ হাজার কাশেমকে দেই। আর বাকি ১৫ হাজার টাকা তার বাবাকে দেয়। গ্রেপ্তারকৃত বিকাশ এজেন্ট আবুল কাশেম তার জবানবন্দিতে এসব কথা স্বীকার করেছে। নূরুল হক নামে আরেক আসামি জবানবন্দিতে বলেন, তার ছোট ভাই কবির হোসেন ওরফে হুমায়ুন কবির লিবিয়া থাকে। গত ২৫শে জুলাই সে বিকাশ এজেন্ট মামুনের কাছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠায়।

এরমধ্যে ৮৬ হাজার টাকা কয়েকটি নাম্বারে বিকাশ করি। বিকাশ এজেন্ট মামুন মিয়া জবানবন্দিতে বলেন, নরসিংদী জেলায় রায়পুরা থানার শিবপুর বাজারে সে বিকাশের ব্যবসা করে। জবানবন্দিতে সে তার অ্যাকাউন্টে টাকা আসার কথা স্বীকার করেন। ঢাকা মেট্রো পিবিআইয়ের এসআই জুয়েল মিঞা জানান,  বাকিরের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা হাসিনা বেগম নামে এক নারীর স্বামীও অপহৃত হয়ে তার জিম্মায় রয়েছে।

এ ধরনের প্রায় শতাধিক ভিকটিম তার জিম্মায় রয়েছে বলে পিবিআইয়ের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে। এদিকে ঢাকা মহানগর পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, শুধু বাকিরের সিন্ডিকেটই নয়, দেশব্যাপী এ ধরনের অনেক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তারা সেসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের ধরতেও অভিযান চালাচ্ছেন। এছাড়া লিবিয়ায় জিম্মিদের উদ্ধারেও তারা কাজ করছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা। এমজমিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে