রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:৪৭:০৬

নাড়ি না কেঁটেই সদ্যোজাতকে নিয়ে পালানোর সেই বিভীষিকার বর্ণনা দিলেন রোহিঙ্গা মা

নাড়ি না কেঁটেই সদ্যোজাতকে নিয়ে পালানোর সেই বিভীষিকার বর্ণনা দিলেন রোহিঙ্গা মা

নিউজ ডেস্ক : পেছনে সেনাবাহিনী। বন্দুক তাক করা। চারদিকে শোরগোল। আগুন জ্বলছে এখানে-ওখানে। এমনই এক বিভীষিকার ভেতর দিয়ে প্রাণপণে ছুটছেন হামিদা। সঙ্গে তার স্বামী ও ৬ সন্তান। হামিদা অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক এর কয়েক মুহূর্ত আগে সন্তান প্রসব করেছেন তিনি।

তখনও কাটা হয় নি আমবিলিক্যাল কর্ড নামের নাড়ি। এই নাড়ির সঙ্গেই সন্তান যুক্ত থাকে মায়ের সঙ্গে। সেই অবস্থায় সন্তান নিয়ে ছুটছেন হামিদা। সামনে ঘন জঙ্গল। তবু শুনতে পান পেছনে সেনাদের গুলির শব্দ। নিরুপায় হয়ে তিনি সেই অবস্থায়ই ছুটতে থাকেন। এমন অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা তিনি শেয়ার করেছেন লন্ডনের অনলাইন দ্য ডেইলি মেইলকে।

হামিদা (৩০) রাখাইনের মংডুতে কাউচোং গ্রামের বাসিন্দা। ২রা সেপ্টেম্বর তিনি তখন ঘরে। অন্তঃসত্ত্বা সময়ের শেষ দিকে। অর্থাৎ সন্তান প্রসবের সময় এসে গেছে। এমন সময় তিনি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। তারপরই শোরগোল। চিৎকার। চেঁচামেচি।

হামিদা বলেন, দাঙ্গাকারীরা আমাদের গ্রামে আগ্রাসন চালায়। তারা আমাদের লক্ষ্য করে রকেট লঞ্চার ছোড়ে। আমাদের পিছু নেয়। এমনকি আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে। ভয়ে আমরা দৌড়াতে থাকি। তারপর, তারা আমাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। সব পুড়ে যেতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখায় মাটির সঙ্গে মিশে যায় সবকিছু।

তখনও আমার সন্তান প্রসব হয়নি। যেকোনো সময়, যেকোনো দিন সে পৃথিবীতে আসতে পারে। এমন অবস্থায় স্বামী ও ৬ সন্তানকে নিয়ে বনের ভেতর পালিয়ে যাই। পালিয়ে যাই মানে পালাতে বাধ্য হই। বনের ভেতরেই আত্মগোপন করে থাকি আমরা। এভাবে কেটে যায় ৪৮ ঘণ্টা। এরপরই প্রথম প্রসব বেদনা অনুভব করতে থাকি।

সাংবাদিক ক্যাথলিন প্রিয়র লিখেছেন, ভয়াবহ রকম ঘটনা ঘটে এর পরেই। হামিদা বুঝতে পারেন তার সন্তান পৃথিবীতে আসা শুরু করেছে। কিন্তু তার তখন করার কিছুই ছিল না। না ছিল একটি চাদর। না ছিল সন্তানদের থেকে আড়াল করার মতো কোনো ব্যবস্থা। তাই বাধ্য হয়েই বনের ভেতর মাটিতে শুয়ে পড়েন হামিদা।

প্রসব বেদনা আরো তীব্র হতে থাকে। তিন ঘণ্টা কষ্ট করার পর একটি সুস্থ ছেলে প্রসব করেন তিনি। হামিদা তখনও স্বস্তি পাননি। তিনি বুক ভরে দম টানার সুযোগ পাননি। এমনকি কাটা হয়নি সন্তানের নাভির সঙ্গে যুক্ত নাড়ি। এমন সময় বনের ভেতর হট্টগোলের শব্দ পান তিনি। হামিদার মনে হয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে। এবার তাদের নিস্তার নেই।

তাই ওই অবস্থায় সন্তান আর নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদ থেকে ছুটতে শুরু করেন হামিদা। তখনও প্রসবকালীন রক্ত ঝরছে তার শরীর থেকে। সেই অবস্থায় ছুটছেন তিনি। নাড়ি না কাটা সন্তান নিয়ে ছুটতে থাকেন তিনি। হামিদা বলেন, তখনও সন্তানের নাড়ি কাটা হয়নি। এমন অবস্থায় একজন নারী কী জন্য ছুটতে থাকেন, পালানোর চেষ্টা করেন- একবার ভাবুন। হামলাকারীরা আমাদের পিছু নিয়েছে।

তারা আমাদের ধরতে চেষ্টা করছে। আমি জানি তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। ছুরি ছিল। ব্যথায় আমার তখন জীবন যায় যায় অবস্থা। কিন্তু আমার কী-ই বা করার ছিল? যদি তারা ধরতে পারে তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে। এমনকি নবজাতককেও মেরে ফেলবে। তাই সর্বশক্তি সঞ্চয় করে ছুটতে থাকি। হামিদা জানেন না তিনি এভাবে কত পথ হেঁটেছেন। ব্যথায় তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

সারা শরীর কাবু হয়ে যায়। কোনোমতে নবজাতককে দু’হাতে ধরে তিনি প্রার্থনা করেন আল্লাহর দরবারে। এই বিপদ থেকে মুক্তি চান। অনেকক্ষণ চলার পর হামিদার পরিবার আবার একটি বিশ্রামে যায়। এ সময় তার স্বামী দুই খণ্ড বাঁশ ব্যবহার করেন। সঙ্গে থাকা দা ব্যবহার করে তার ধার ধারালো করেন। তা দিয়ে সন্তানের নাড়ি কেটে দুজনকে আলাদা করেন।

চূড়ান্তভাবে পৃথিবীতে মা ও সন্তান একের শরীর থেকে অন্যে আলাদা হয়ে যান। এ অবস্থায় আরো তিনদিন বনের ভেতর অবস্থান করেন হামিদা। সেখানেই তিনি ও তার স্বামী নবজাতকের নাম রাখেন হোসেন শাহেব। সঙ্গে তাদের কোনো খাবার নেই। নেই পান করার মতো পানি। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে তারা পা বাড়ান বাংলাদেশের দিকে।

হামিদা বলেন, এ সময়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে মাটিতেই ঘুমিয়েছি। কোনো খাবার ছিল না। সন্তানরা ক্ষুধায় কাঁদছিল। দু’দিন হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই নাফ নদীর পাড়ে। সেখানে এক নৌকাওয়ালা আমাদের দেখেন। তার মাঝে দয়ামায়া জেগে ওঠে। আমাদের কোনো টাকাপয়সা না নিয়ে নদী পার করে দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়।

তিনি আমাদের তার বাড়িতে থাকতে বলেন। আমাদের প্রথম খাবার দেন। কয়েক দিনের মধ্যে সেই ছিল আমাদের প্রথম খাবার খাওয়া। তার বাড়িতেই আমরা দুই রাত কাটিয়ে দিই। এরপর হামিদার পরিবার যাত্রা শুরু করে ঘুমধুম শরণার্থী শিবিরের দিকে। সেখানে কমপক্ষে ৫০ হাজার শরণার্থী অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছেন।

হামিদার স্বামী সেখানে কিছু বাঁশ, তারপুলিন কিনেছেন। কিনেছেন রান্নার জন্য কয়েকটি পাতিল। হামিদা বলেন, আমরা এখানে থাকতে চাই না। এখানে কোনো শান্তি নেই। সুখ নেই। ১৫ দিন বয়সী শিশুসন্তানের দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

বলেন, আমাদের চলে আসতেই হয়েছে। তা না হলে ওরা আমাদের মেরে ফেলতো। ওদিকে তার হাতের ওপর ছোট্ট হোসেন শাহেবকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এই শিশুটি এত ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের যে, সে কাঁদতে পারছে না।

হামিদা বলেন, সে ক্ষুধার্ত। কিন্তু কী করবো। দুধ নেই। আমরা কয়েক দিন খেতে পাইনি। ফলে এমন প্রতিকূলতায় তার শরীর ভেঙে পড়ছে। হামিদার অন্য শিশুরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা খাবার চায়। কিন্তু তাদের মুখে তুলে দেয়ার মতো কিছু নেই ঘরে।

ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে শুনে সেখানে গিয়েছেন তার স্বামী। কিছু খাবার ও পানি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু হামিদা জানেন সবার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তাই তিনি ভেবে নিয়েছেন তাকে আরো একটা রাত অন্তত না খেয়েই ঘুমাতে হবে। এমজমিন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে