রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০২:১৯:৩৯

সেফ জোনে সমাধান নেই, আনান কমিশনের রিপোর্টেও সমস্যা আছে

সেফ জোনে সমাধান নেই, আনান কমিশনের রিপোর্টেও সমস্যা আছে

সাইফ নাসির : রোহিঙ্গাদের ওপর ক্রমাগত অত্যাচার নিপীড়নের মুখে তারা কিভাবে আবার মিয়ানমার ফিরে যাবে এবং নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে সেখানে বসবাস করতে পারবে তা নিয়ে চিন্তিত বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহল। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়, তারপরও জাতিগত নিপীড়ন শুরু হলে পরিস্থিতি আগের মতোই দাঁড়াবে এমন অাশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে দেয়া তার ভাষণে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে প্রশ্ন রয়েছে ‘সেফ জোন’ সত্যিই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে কি না?

এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া ডিভিশনের ফেলো রিচার্ড ওয়ার সংস্থার নিয়মিত ব্রিফিং এ শুক্রবার এই বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন  । তিনি বলেছেন,জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনীর তদারকিতে ‘সেফ জোন’ পরিচালিত হলেও সেটি শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে কি না সে ব্যাপারে সংশয় আছে।

এইচআরডব্লিউ শ্রীলংকা এবং বসনিয়া হারজেগোবিনার ‘সেফ জোন’ এর  উদাহরণ তুলে ধরে বলেছে, বসনিয়া হারজেগোবিনায় জাতিসংঘের শান্তি রক্ষিবাহিনীর তদারকিতে সেফ জোন গঠন করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে সার্ব বাহিনী সেখানে হামলা চালিয়ে নারী শিশুসহ ৭ হাজার সাধারন বসনিয়ানকে হত্যা করেছে। অসংখ্য নারী সেখানে ধর্ষনের শিকার হয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, শ্রীলংকায়ও  ‘সেফ জোন’ গঠিত হয়েছিলো যেটি পরবর্তীতে ‘কিলিং জোনে’ পরিণত হয় । প্রতিবেদনে বলা হয় শ্রীলংকার ‘সেফ জোনে’ সেনাবাহিনী গোলা নিক্ষেপ করেছিলো যাতে বিপুল সংখ্যক সাধারন শ্রীলংকান প্রাণ হারায়।  সেখানে কি পরিমান সাধারন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে তার সংখ্যা পর্যন্ত জানা যায় নি।

এইচআরডব্লিউ বলছে, ‘সেফ জোন’ যেহেতু একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত থাকবে, সেটি  আসলে রিফিউজি ক্যাম্প এর বেশি কিছু হবে না।

এদিকে আনান কমিশনকে কাজ করতে দেয়ার মিয়ানমারের প্রধান শর্ত ছিলো রিপোর্টে কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি লেখা যাবে না। এই শর্ত মেনে রোহিঙ্গাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করে আনান কমিশন। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি জাতিগত সমস্যা না হয়ে মুসলিম ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে রিপোর্ট করে আনান কমিশন।

ফলে কফি আনানের যে রিপোর্টকে ভিত্তি করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে, সেই রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। মিয়ানমার সরকারও বলছে, এঁরা রোহিঙ্গা নয়-বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কফি আনানের রিপোর্টেও রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি না থাকায় শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ব্যহত হতে পারে।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অস্থিরতা, সংকট সমাধানের জন্য একটি সুপারিশমালা প্রণয়নের করার জন্য ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অং সান সু চি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ফাউন্ডেশনকে প্রস্তাব দেয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘কফি আনান ফাউন্ডেশন’ সু চি’র প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরে ফাউন্ডেশন এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘এডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’ গঠন করা হয়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এই কমিশনের প্রধান ব্যক্তি হলেও কমিশনের অধিকাংশ সদস্যই মিয়ানমারের প্রতিনিধি।

জানা যায়, কফি আনানের নেতৃত্বে কমিশন গঠন করে দিয়ে সু চি একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, রিপোর্টে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। কফি আনান সেই কথা রেখেছেন। তিনি পুরো রিপোর্টে কোথাও রোহিঙ্গা বা বাঙালী শব্দটি ব্যবহার করেননি।  রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দাদের কফি আনানের রিপোর্টে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘মুসলমান’ হিসেবে। ফলে উপদেষ্টা কমিটির সামনে সমস্যাটি রোহিঙ্গা হিসেবে থাকেনি, হয়ে গেছে বৌদ্ধ সরকারের সাথে মুসলমানদের সমস্য।

কফি আনান তার রিপোর্টে এই তথ্য স্বীকারও  করেছেন। রিপোর্টেই বলা হয়েছে, ‘স্টেট কাউন্সিলের অনুরোধ হিসেবে এই রিপোর্টে বাঙালি এবং রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি, তার পরিবর্তে ‘মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, রাখাইনের মুসলমান সম্প্রদায় ব্যবহার করা হয়েছে। ‘

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইনের অধিবাসীরা নিজেদের রোহিঙ্গা হিসেবেই পরিচয় দেয়। আর মিয়ানমার তাদের কখনোই রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার করেনি। মিয়ানমার সরকারের চোখে- এরা ‘বহিরাগত, অবৈধ অধিবাসী, মূলত বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ঢুকে পড়া। ‘ফলে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি, ভোটাধিকার দেয়নি এমনকি চলাচলের স্বাধীনতাও দেয়নি।

আনান কমিশনের হাত ধরে এই সমস্যা সমাধান করতে হলে এ নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশ। কারণ জাতিগত সমস্যা আর ধর্মীয় সমস্যা সমাধানের হিসেব নিকেষ একটু আলাদা। যার সুবিধা নিতে পারে মিয়ানমার। হয়তো এই সুবিধাটুকু পাওয়ার জন্যই মিয়ানমার আনান কমিশনকেও এমন শর্ত দিয়ে থাকতে পারে।

তথ্যসুত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলা ট্রিবিউন
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে