সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:০১:২০

ফের স্রোতের মত ঢুকছে রোহিঙ্গা, সীমান্তে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা জড়ো

ফের স্রোতের মত ঢুকছে রোহিঙ্গা, সীমান্তে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা জড়ো

মহিউদ্দিন অদুল : উখিয়ার পুঠিবুনিয়া সীমান্ত। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আসছিলেন দল বেঁধে। শনিবার রাত থেকেই তারা নাফ নদ পার হচ্ছিলেন। সকাল পর্যন্ত চলছিল তা। আগের রাত থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ওই এক সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েই অন্তত ১০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জানান তারা।

সীমান্তে আরো অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ওপারে জড়ো হয়েছে। তারাও নৌকায় পার হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের প্রায় অধিকাংশই বুথেডংয়ের বাসিন্দা। বুথেডং ও রাথেডং টাউনশিপের লোকজনই বেশি। প্রথম দিকে শহরতলি ও কাছের অনেক গ্রামের বাসিন্দাদের সরতে দেয়নি মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। শেষে তারাও রক্ষা পায়নি। গত এক দেড় সপ্তাহ আগের নৃশংসতায় তারা গ্রাম ছেড়েছে বলে জানালেন।
 
এমনই একটি জনপদ রাখাইন রাজ্যের বুথেডং টাউনশিপের খিয়াম্বু লামার পাড়া। এ রোহিঙ্গা পল্লীটির পাশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বোহা ক্যাম্প। গত ২৫শে আগস্ট নৃশংসতা শুরুর ২২ দিনেও তার ছোঁয়া লাগেনি গ্রামটিতে। অক্ষত ছিল ঘরবাড়ি। সেনা সদস্যরাও নিরীহ গ্রামবাসীকে সান্ত্বনা দিয়ে আটকে রাখে। তার আড়ালেই চলছিল সবাইকে একসঙ্গে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র।

গ্রামবাসী তা বুঝতেই দুজনকে বলি হতে হলো। হত্যা করা হয় আবুল কালাম (৫০) ও কানাবদিয়াকে (৪০)। এ ঘটনা ১৬ই সেপ্টেম্বরের। পরদিন সেনা সদস্যরা তল্লাশির নামে গ্রামবাসীর মাধ্যমে ঘরের ভেতর মাটি খুঁড়ায়। সেখানে নিজেরাই গুলি ও গুলির খোসা রেখে দেয়। এরপর জঙ্গি তৎপরতার প্রমাণ হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে গ্রামবাসীকে। কয়েকজন গ্রামবাসীকে নিয়ে ছবি করে মিথ্যা প্রমাণ সাজায়। এমন ফাঁদ পাতার পর অবশেষে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর রাতেই সেনা সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গ্রাম ছাড়ে আড়াই হাজার মানুষ।

যাত্রা পথে তারা আরো কয়েকটি গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে যান। পথে মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে দল ভারি করেন। এর মধ্যে রয়েছে গোপী, চওপ্রাং, প্রাংচি, বৈদ্যপাড়া, বাদানাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের লোকজন। ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে তাদের দলের লোক সংখ্যা। রোববার তারা মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছে। নৌকায় নাফ নদী পার হয়। পুঠিবুনিয়া দিয়ে এদেশে ঢুকে। পুঠিবুনিয়া সীমান্তে গতকাল এ দলের বেশ কয়েকজন এভাবে মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে আসার কথা জানান।

পরিবার নিয়ে সে দলে রয়েছেন বুথেডং টাউনশিপের খিয়াম্বু লামার পাড়ার রোহিঙ্গা যুবক রফিক, মৌলানা তৈয়ব, মোহাম্মদ ছলিম ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা হাফেজ ইউনুচ। তারা বলেন, গত ২৫শে আগস্ট থেকে বিভিন্ন জায়গায় মিয়ানমার সেনা ও রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের জবাই ও গুলি করে মারতে শুরু করে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তার কিছু কিছু খবর আসছিল।

এ অবস্থায় মিয়ানমার সেনা সদস্যরা মিটিং ডেকে আমাদের বলে যে, ‘তোমরা আমাদের কৃষক। আমাদের কাছের মানুষ। আমাদের সঙ্গে থাক। তোমরা আমাদের সঙ্গে ভালোভাবে থাকলে আমরাও তোমাদের সঙ্গে ভালোভাবে থাকবো। কারও কোনো ক্ষতি হবে না। তোমরা কেউ পাড়ার বাইরে যাবে না। এখানেই থাকবে।’

তারা এই কথা বলার পর আমরা এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। ঘর থেকে বের হতে পারছি না। বাজারে যেতে পারছি না। ঘরে খাবারও শেষ হয়ে গেছে। দু’সপ্তাহে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৬ই সেপ্টেম্বর সকালে গরু চরাতে গেলে বন্দুকের নলের মুখে আবুল কালাম ও কানাবদিয়াকে  ডেকে নেয়। তারপর তাদের স্থানীয় কিয়াংয়ের চত্বরে নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। লাশ পাশের পাহাড়ি ঝিরির পাশে একটির উপর অপরটি রেখে মাটি চাপা দেয়। পরে গিয়ে সেই লাশের ছবি তুলে আনি।

এই প্রতিবেদককে মোবাইলে সেই ছবি দেখান তাদের একজন। এ অবস্থায় গত ১৬ই আগস্ট রাতের আঁধারে ২০টি পরিবার গ্রাম ছাড়ে। এ খবর পেয়ে যায় বর্মী সেনা সদস্যরা। পরদিন ১১০ জন বর্মী সেনা সদস্য এসে গ্রামবাসীদের দিয়ে কয়েকটি খালি ঘরে খনন করায়। এরপর একটি ঘরে খুঁড়া গর্তে তারা নিজেদের ব্যবহৃত কিছু গুলির খোসা রেখে দিয়ে ছবি করে। আর গ্রামবাসীকে বলে তোমরা জঙ্গিদের সহায়তা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপর কাউকে এলাকা না ছাড়ার জন্য কড়া নির্দেশ দেয়।

তারা বলেন, পরদিন ১৮ই সেপ্টেম্বর আমাদের গ্রামে নির্বিচারে মানুষ হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পারি। রাখাইনের আরো বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রামেও তারা একই কৌশলে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে গণহত্যা চালায়। তাই আমরা ওই রাতে গ্রাম ছাড়ি। আমাদের গ্রামে ৪০৪ ঘরে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। ২০ ঘর আগেই গ্রাম ছেড়েছিল। বাকি দুই সহস্রাধিক মানুষ ওই রাতে গ্রাম ছাড়ি।

তারা আরো বলেন, রাতেই আমরা সারেকুণ্ডায় আসি। সেখানে কিছু ঘর পোড়া ও কিছু পোড়া হয়নি। খালী ঘরগুলোতে ওই রাত কাটাই। পরদিন ১৮ই সেপ্টেম্বর সকালে বৈদ্যপাড়ায় যাই। সেখানে মসজিদে পাঁচজনের ক্ষতবিক্ষত লাশ চোখে পড়ে। পরদিন ১৯শে সেপ্টেম্বর আমরা চঁ’চরে আসি। ততক্ষণে আমাদের দলের লোক ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ৯জন সেনা সদস্য সেখানে অস্ত্রের মুখে আমাদের স্বর্ণ, টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন লুট করে।

ছেনোয়ারা নামে পনের বছর বয়সের এক মেয়ের সর্বাঙ্গ হাতিয়েছে। তখন আমরা দীর্ঘ সারি দাঁড়িয়ে পড়ে দলভারি করে এক সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ সামনে আগালে তারা পথ ছেড়ে দেয়। সেদিন আমরা বুদাইসং পৌঁছি। ঝড়-বৃষ্টিতে পড়ি। ততক্ষণে আমাদের দলে লোক সংখ্যা ৮ হাজার। সেখানে দু’রাত কাটাই। তারপর ২১শে সেপ্টেম্বর রাতে রওয়ানা দিই। আসি মংডুর ডিয়লতলীতে।

মধ্যরাতে পৌঁছার পর সেখানে রাত কাটাই। সেখানে আমরা আমাদের অন্তত দ্বিগুণ লোকের সঙ্গে জড়ো হই। এরপর গত ২২শে সেপ্টেম্বর পৌঁছি বর্ডারের কাছে। সেখানে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি ঘাটে নৌকা ৪০টির বেশি নয়। তাই জটলা বাড়ছে। পরদিন ২৩শে সেপ্টেম্বর রাত থেকে নৌকা পার হতে শুরু করি।

সেই দলের একজন আব্দুস ছফুর। প্যারালাইজড আক্রান্ত স্ত্রী আয়েশা খাতুনকে পিঠে বেঁধে নিয়ে পথ চলছিলেন। কয়েকদিনের উপস ছফুর একটু জোর পাওয়ার জন্য লাঠি ধরে চলছিলেন। আবার সেই লাঠি ধরে হাঁটছে তার মেয়ে সুপাইরাও (১০)। বড় ছেলে আবদুল্লাহর (১৩) কোলে দু’বছরের বোন জান্নাত।

একে অপরের হাত ধরে হাঁটছে আজিদা (৫) ও আবদুর রহমান (৫)। বাবা-মা’র সঙ্গে তাদের মধ্যেও স্বস্তি এসেছে এপারে পার হওয়ার পর। ছফুর বলেন, পাড়ায় আমার শ্বশুর আলী হোসেনসহ দু’জনকে জবাই করে দেয়ার পর আমরা জীবন বাঁচাতে ঘর ছেড়েছি। এমজমিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে