সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:২১:৪০

সন্তানদের সামনেই শামিলার কাপড় খুলে ৩ বর্মি সেনা একের পর এক...

সন্তানদের সামনেই শামিলার কাপড় খুলে ৩ বর্মি সেনা একের পর এক...

মোহাম্মদ আবুল হোসেন : মিয়ানমারের সেনারা অকস্মাৎ হামলে পড়ে শামিলার (২৫) ঘরে। তার সন্তানদের সামনে খুলে নেয় তার কাপড়। শুরু করে (প্রচার অযোগ্য শব্দ)। একের পর এক সেনাসদস্য তার ওপর নরপিশাচের মতো হামলে পড়ে। রক্তাক্ত করে শামিলাকে।

সন্তানের আর্তনাদ, শামিলার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু নরপিশাচদের মনকে টলাতে পারেনি তা। সন্তানদের সামনে রক্তাক্ত শামিলাকে ফেলে এক পর্যায়ে চলে যায় হায়েনার দল। এ অবস্থায় শামিলা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার শরীর থেকে তখনও ঝরছে রক্ত।

সন্তানদের সামনে মুখ দেখাতে পারছেন না। কখনো মনে হয় আত্মহত্যা করতে। কিন্তু পারেন না ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশে চলে আসবেন। রক্তাক্ত শামিলা হাঁটা শুরু করেন। তিন দিন হাঁটেন। তারপর পৌঁছেন বাংলাদেশে। শামিলার এমন নির্মমতা তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

এতে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন তার ওপর চালানো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্য নামধারী কিছু নরপিশাচের অত্যাচারের কথা। এমন অত্যাচারের শিকার হয়েছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীদের অনেকে। তারা পালিয়ে বাংলাদেশে এলেও আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ছে না। সম্বিত ফিরে পেলেই তাদের চোখে ভেসে উঠছে সেই পৈশাচিকতার কথা।

অমনি অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তারা। সম্ভমহানীর শিকার হওয়া নারীদের কেউ মুখ খুলছেন। কেউ নীরবে গুমরে কাঁদছেন। যারা মুখ খুলছেন তারা বলছেন, তাদেরকে সম্ভমহানী করেছে মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা। তাদের গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল। এভাবে যে তথ্যগুলো বেরিয়ে আসছে তা একটি বিশাল বরফের চাঁইয়ের এক কোণা মাত্র। এর বাইরে রয়ে গেছে ভয়াবহ সব কাহিনী।

শামিলা বলেছেন, আমার ঘরে হানা দেয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের তিনজনে মিলে পর্যায়ক্রমে আমাকে (প্রচার অযোগ্য শব্দ) করে। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কোলে ৬ বছর বয়সী শিশুর দিকে তাকিয়ে তার কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, সন্তানদের সামনে আমাকে এভাবে (প্রচার অযোগ্য শব্দ) করে তারা চলে যায়। এরপর আমি আর ডানে বামে না তাকিয়ে বাড়িতে থাকা দু’সন্তানকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। দূরে দেখতে পাই পিঁপড়ার সারির মতো মানুষের ঢল। তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের উদ্দেশে হাঁটছেন। আমিও তাদের অনুসরণ করতে থাকি। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলেন না তার স্বামী। বাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে পা বাড়ানোর পর থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি শামিলার। তিনি জানেন না তার স্বামী কেমন আছেন। অন্য তিন সন্তান কোথায় এখন।

শামিলা বলেন, সেনারা যখন বাড়িতে আমার ওপর হামলা চালায় তখন ওই তিন সন্তান বাড়ির বাইরে খেলছিল। সেনা বাহিনীর ওই নরপিশাচরা চলে যাওয়ার পর তাদের আর দেখতে পাইনি। তারা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল! এমনই নৃশংসতার শিকার রোহিঙ্গা নারীরা। মিয়ানমারে শারীরিক সহিংসতাসহ সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ শরণার্থী শিবিরগুলোতে তদন্ত করছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।

শারিরীক সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রামিলা প্যাটেন বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের চালানো অভিযানের বিষয়ে তিনি ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন। সেখানকার জীবিত মানুষগুলো শারিরীক সহিংসতার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন।

তারা বলেছেন, এটাকে রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ২৫শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর রাষ্ট্রহীন চার লাখ ২৯ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে নারীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিস্মিত বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। তাদের বেশির ভাগই একই রকম শারিরীক নির্যাতনের শিকার। তাদের কাহিনী একই রকম।

তারা বলছেন, স্বামী ও পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাড়ির বাইরে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী জোর করে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এরপর সন্তানদের সামনে একের পর এক তাদের (প্রচার অযোগ্য শব্দ) করে। লেদা শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক এজেন্সি পরিচালিত একটি ক্লিনিকে কাজ করেন নওরিন তাসনুভা। তিনি এ পর্যন্ত বেশ কিছু নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, যাদের চিকিৎসা দিয়েছি তারা বেশির ভাগই বলেছেন তাদের (প্রচার অযোগ্য শব্দ) করার আগে প্রহার করা হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, এসব নারীর অনেকের শরীরে ক্ষতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। থেঁতলে দেয়া হয়েছে শরীর। বুকের ওপর কামড়ানো হয়েছে। গোপনাঙ্গেও এমন নির্যাতন করা হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন সহিংসতার পর এমন চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন নওরিন।

তিনি বলেছেন, এখনও বহু নারী তাদের কাহিনী আমাদের জানাননি। সামনের দিনগুলোতে আরো নারীকে চিকিৎসা দেয়া হবে। হয়তো তখন বেরিয়ে আসবে আরো একই রকম নির্যাতনের কথা। তিনি বলেন, অনেক পরিবার নারী সদস্যের এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতির কথা অন্যদের কাছে শেয়ার করতে চাইছেন না। তারা নিজেদের মান সম্মানের ভয় করেন।

অক্টোবরে এমন সহিংসতার পর নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পরিকল্পিত, পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার বাংলাদেশে যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন তার মধ্যে সম্ভ্রমহানী শিকার এবং তারপর জীবিত নারীর সংখ্যা দৃশ্যত আগের চেয়ে অনেক কম।

উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা যায়, যুবতীদের সম্ভ্রম নষ্ট করার শেষে নগ্ন করে হত্যা করা হচ্ছে। জীবিত অবস্থায় তাদের হাত, পা এমনকি গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে। অনেক যুবতীকে একেবারে নগ্ন করে উপরে গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ফলে তাদের বেশির ভাগকেই (প্রচার অযোগ্য শব্দ) শেষে হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক এজিন্সির লিঙ্গগত সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মকর্তা আইরিন লোরিয়া বলেছেন, এখন যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছে সময়টা কঠিন, লড়াইয়ের। তিনি বলেছেন, এবার যেভাবে সম্ভ্রম নষ্ট করা হচ্ছে দৃশ্যত তা অন্য সময়ের তুলনায় ভিন্ন। এর আগে সম্ভ্রম নষ্টকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সম্ভ্রম নষ্ট শেষে নারীটিকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটানো হতো। তাকে অপমান করা হতো।

তবে এবার তাদের বাইরে নেয়া হচ্ছে না। রাখাইন থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার এক সপ্তাহ পরে লেদা শরণার্থী শিবিরের ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন আয়েশা (২০)। তিনি বলেছেন, বুথিডাং শহরের পাশেই তার গ্রাম। যখন সেখানে সেনাবাহিনী হামলা চালায় তার বাড়ির আশপাশের সবাই পালিয়ে যান। আয়েশা বলেন, সেদিন সকাল ৮টার দিকে সেনারা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। এ সময় ভয়ে মানুষ যে যেদিকে পারে পালাতে তাকে। কিন্তু আমার ঘরে ছিল ছোট্ট বাচ্চা।

প্রথমে তাকে সেবাযত্ন করতে মন দিই আমি। এ সময় সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ৫ জন সদস্য আমার ঘরে প্রবেশ করে। তাদের একজন আমার সম্ভ্রম নষ্ট করে। এ সময় অন্যরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করতে থাকে। রোহিঙ্গা পুরুষদের পেলে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এমন খবর রটে যাওয়ার পর তার স্বামী আগেই গ্রাম ছেড়েছেন। তারপর স্বামীর সঙ্গে তার আর কোনো সাক্ষাত বা যোগাযোগ হয়নি।

কেউ কেউ বলেছেন, তিনি পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু এখনও তাদের সাক্ষাৎ হয়নি। আয়েশা আশায় বুক বাঁধছেন- শিগগিরই তার সঙ্গে দেখা হবে তার। তবে এক্ষেত্রে শামিলার অবস্থা আরো করুণ। তিনি বলেন, আমি জানি না আমার স্বামী ও অন্য তিন শিশু কোথায় আছে। সবার কাছে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছি। কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না। তাই তিনি জানেন না তারা বেঁচে আছে না কি হত্যা করা হয়েছে। এমজমিন

বিঃদ্র : সম্ভ্রমহানীর শিকার নারীদের প্রকৃত নাম ও ছবি প্রচার এমটিনিউজের সম্পাদকীয় নীতিমালা বর্হিভূত হওয়ায়। এই সকল রোহিঙ্গা নারীদের রুপক নাম ব্যবহার হয়েছে। তাদের প্রকৃত নাম প্রচার করা হয়নি।
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে