বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:৩৫:১৯

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আকুতি ‘আমাদের নিয়ে যাও’

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আকুতি ‘আমাদের নিয়ে যাও’

এলেক্স ক্রফোর্ড : আমরা মিয়ানমারে হাজারো অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বঞ্চনা দেখেছি। তাদের মধ্যে রয়েছে এমন নারী যাদের হাড়ের সঙ্গে চামড়া লেগে গেছে, সদ্য জন্ম নেয়া শিশুকে মারা যাওয়ার জন্য সমুদ্র সৈকতে ফেলে দেয়া হচ্ছে।

আপনি যে মুহূর্তে এই প্রতিবেদনটি পড়ছেন, ঠিক সে মুহূর্তে রাখাইনে বিশাল আকারের ভয়ংকর একটি মানবিক সংকট চলছে। কিন্তু এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় তেমন কোনো চেষ্টাই করছে না।

এটি আরো প্রমাণ করে যে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য এর নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করছে।আমরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে একটি মাছ ধরা নৌকায় মিয়ানমারের উদ্দেশে রওনা দেই।

আমরা যাত্রাপথের বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছি না- কেননা, এতে করে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সেই পথ বন্ধ করে দিতে পারে। আমাদের নৌকা মওংদাও জেলার দাং খালি সওর সৈকতে গিয়ে থামে। সেখানে আগে থেকেই বহু মানুষ জমা হয়েছিল- সাহায্য চাইছিল।

তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, অপুষ্টিতে ভোগা এক বৃদ্ধা। খাবারের অভাবে তিনি এতটাই শীর্ণকায় ছিলেন যে, ঠিকঠাকমতন দাঁড়াতেও পারছিলেন না। এ ছাড়া সেখানে গর্বভতী নারীও ছিল। তাদের মধ্যে একজনের নাড়ি পর্যন্ত কাটা হয়নি। আরেকজনের পেট ফুলে গেছে খাবারের অভাবে।

তারা আমাদের বারবার বলছিল, কিভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে তাদের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দিয়েছে, তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদেরকে পালাতে বাধ্য করেছে। একজন তরুণ বলেন, তারা আমাদের হত্যা করছে, আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করছে, আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করছে। তারা প্রায় দুই মাস ধরে ওই সৈকতে আটকা পড়ে আছে।

তারা বলেছে, সামরিক বাহিনী সৈকতের বাইরের অঞ্চলে স্থলবোমা পুঁতে রেখেছে- যাতে করে তারা ফেরত না যেতে পারে। সবকিছু হারিয়ে তারা এখন সাহায্যের অপেক্ষায় কিন্তু সাহায্যের দেখা মেলে না। হঠাৎ হঠাৎ বাংলাদেশে থাকা তাদের আত্মীয়রা তাদের এখানে নিয়ে আসার জন্য নৌকা নিয়ে যায়, কোনো একটা দলকে নিয়ে আসে।

কিন্তু সে যাত্রাও বেশ দীর্ঘ আর বিপজ্জনক, বিশেষ করে রাতের সময়। বেশির ভাগ জেলেই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই তারা ওই সৈকতে অপেক্ষা করেই চলেছে। আমরা বহু তরুণকে বাঁশ ও ক্যান দিয়ে দিয়ে ভেলা তৈরির চেষ্টা করতে দেখেছি। ওই ভেলাটি আকারে ৪০ বর্গফুট হবে।

এটি তৈরি করতে তাদের পাঁচদিন লেগেছে। পুরো কাজ শেষ করতে আরো পাঁচদিন লাগতে পারে। এটিতে করেই তারা বাংলাদেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। এটই তাদের বাঁচার মরিয়া চেষ্টার প্রতিফলন। মিয়ানমারে কি ঘটছে বহির্বিশ্বকে তা বোঝাতে আর কি প্রমাণ লাগতে পারে তা কল্পনা করতে কষ্ট হয়।

সামপ্রতিক সহিংসতার তোপে ইতিমধ্যে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখানে এসেও তারা নিরাপদ নয়। ভুগছে অপুষ্টিতে, বাস করছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। আমরা রাখাইনে যেসব রোহিঙ্গাদের দেখেছি তারা হচ্ছে স্থলপথে বাংলাদেশে পালিয়ে না আসতে পারা রোহিঙ্গাদের দল।

এর একটি কারণ হচ্ছে, সামপ্রতিক সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকাগুলোর একটিতে অবস্থান করছে তারা। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে তারাই সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করছে। তার ওপর পথিমধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর কয়েক ডজন চেকপয়েন্ট। সেখান থেকে ফিরে আসার দৃশ্যটি ছিল আরো হৃদয়বিদারক।

সবাই আসতে চাইছিল। একজন জেলেকে চিৎকার করে সবাইকে না করতে হয়েছে। তাতেও কাজ না হলে পরে সবাইকে মেরে নৌকায় ওঠা থেকে বিরত রাখতে হয়েছে। কেউ কেউ আর্তনাদ করে বলেছে, ‘আমাদের নিয়ে যাও, আমাদের নিয়ে যাও।’

আমাদের দিকে বাড়ানো তাদের হাতগুলো ছিল আকুতিতে ভরা। আমি একজন পুরুষকে দেখেছি তার সন্তানকে ওপরে তুলে ধরতে, নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরেকজন তার শিশুকে আমার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। নৌকার মাঝি আমাদের তাড়া দিচ্ছিল জলদি ওঠার জন্য।

তিনি চিন্তিত ছিলেন যে, যেকোনো সময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চলে আসতে পারে। আমরা বিশৃঙ্খলতার মধ্য দিয়েই নৌকায় উঠলাম। নৌকা তীর থেকে অল্প দূরে নোঙর করা ছিল। যাত্রীদেরকে কোমর সমান পানি পার হয়ে নৌকায় উঠতে হয়।

মাঝি বলেন, নৌকায় ১৫ জনের জায়গা আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও আরো অনেক শিশু গাদাগাদি করে তাতে চড়ে বসে। প্রথমে আমরা যে বয়স্ক নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম তিনিও উঠেছিলেন। জড়োসড়ো হয়ে পিঠের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে ছিলেন।

নৌকার নাবিক বিস্কুট ও পানি সরবরাহ করলে সবাই তা গোগ্রাসে খেয়ে নেয়। অনেকের জন্য এটাই ছিল দিনের প্রথম খাবার। ওই বয়স্ক নারী কিছুটা উঁচু হয়ে তাকে পানি দেয়ার জন্য আমাকে ইশারা করল। তিনি একবার ঢোক গেলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। বেশি দুর্বল থাকলে এমনটা হয়।

কয়েক ঘণ্টা পর আমরা বাংলাদেশের আলো দেখতে পেলাম। মাঝি তীর থেকে অল্প দূরে নৌকা নোঙর করে যাত্রীদেরকে দ্রুত নৌকা থেকে নেমে পড়তে বললো। তিনি বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হতে চাননি। তারা শরণার্থীদের বহনকারী নৌকা ধরে সেগুলো পুড়িয়ে দেয়।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই নৌকা থেকে নেমে পড়লো এবং সৈকতের গাছ লক্ষ্য করে তীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো। ওই বয়স্ক নারী পানিতে পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যুবকদের একজন তাকে উদ্ধার করে ও তীর পর্যন্ত নিয়ে আসে। একটি ধানক্ষেতে ছোট যাত্রাবিরতির জন্য থামে সবাই।

এক পরিবার বললো- ‘মনে হচ্ছে আমরা পুনরায় জন্ম গ্রহণ করলাম।’ কিন্তু তাদের চাহনি ও হাবভাবে মনে হচ্ছিল তারা এখনো নির্যাতনের মধ্যেই আছে। সবাই আতঙ্কিত। তারপর তারা তাদের মালপত্র এক জায়গায় জড়ো করলো ও অন্ধকারে অজানার পথে যাত্রা শুরু করলো।

(মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে স্কাই নিউজের প্রতিবেদক এলেক্স ক্রফোর্ড রাখাইনে সফর করেন। সেখান থেকে ফিরে তার রাখাইন অভিজ্ঞতা নিয়ে এক প্রতিবেদন লিখেন। সে প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে কিভাবে রাখাইনের সামরিক বাহিনীর হাতে নৃশংস অত্যাচারের শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।) এমজমিন

এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে