বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ০৯:২৫:৫৬

খালেদার রায় বিএনপিতে শাপে বর!

খালেদার রায় বিএনপিতে শাপে বর!

সালমান তারেক শাকিল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি আন্দোলনের ফলে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতবিরোধ-দ্বন্দ্ব দূর হয়েছে। গত আট বছরের চলমান অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব ভুলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠছেন।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এতদিন যাবত যে নেতাদের মধ্যে অনৈক্য-বিভেদ ছিল, তারা এখন দলীয় চেয়ারপারসনের কারামুক্তির দাবিতে ‘অহিংস আন্দোলন’ চালিয়ে যাচ্ছেন। দলটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সৃষ্টি করছে নতুন দৃষ্টান্ত।

এছাড়া দলীয় প্রধানের মুক্তি দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের পাশাপাশি স্মারকলিপিসহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলো পালন করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। বিষয়টিকে বিএনপির জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছে হিসেবে দেখছেন দলটির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

খালেদা জিয়ার কারাবন্দির প্রতিবাদে বিএনপির আন্দোলন-কর্মসূচি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলন করতে গিয়ে দল আরও সংগঠিত হয়েছে। সবাই সচেতন হয়েছে। তার কারাবরণ দীর্ঘ হলেও কোনও শঙ্কা নেই। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নেতাকর্মীরা এখন আরও ঐক্যবদ্ধ।’

এদিকে, গত ২৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপির পুরো রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে লন্ডন সফর শেষে খালেদা জিয়া দেশে এসে বিএনপিতে নতুন উদ্যম তৈরি করেন। তাকে দেখতে বিমানবন্দরে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। এছাড়া তার কক্সবাজার সফরে সময় বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ জনতার অভিনন্দন দেখেছেন।

এসব বিষয় মাথায় রেখে নিজের মামলায় ভবিষ্যৎ সামনে রেখে তখন শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা তুলে ধরে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি নতুন নির্দেশনা জারি করেছিলেন খালেদা জিয়া। এরমধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া মূলত জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক রণকৌশল ঠিক করে দিয়েছেন বলে মনে করেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। তাদের মতে, আগামী দিনে এই ধারার প্রধান কৌশল হবে ‘অহিংস প্রতিক্রিয়া’।  

এতদিন বিএনপির যেসব ‘অলস’ নেতাকে কোনও মিছিল-মিটিংয়ে দেখা যায়নি, তারাও এখন দলীয় প্রধানের কারামুক্তি আন্দোলনে নেমে পড়েছেন। জেলায়-জেলায় দীর্ঘদিনের চলে আসা অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে।

যেখানে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দা-কুমড়ো সম্পর্ক ছিল সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর, সেই বিরোধেরও সমাপ্তি ঘটিয়ে তারা উভয়ই নিয়মিত আলোচনায় বসছেন। ঠিক করছেন রাজনৈতিক কৌশল-কর্মসূচি। এছাড়া নিজের ব্যবসা বা চেম্বার রক্ষা করতে সরকারের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ে জড়িয়ে পড়া ব্যবসায়ী-আইনজীবী নেতারাও এখন নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। নারী নেত্রীরাও মিছিলের সামনে আসছেন।      

আগে রাত নয়টার আগে যে কার্যালয় খোলা হতো না, এখন চেয়ারপারসনের সে কার্যালয়ের তালা খোলা হয় প্রতিদিন সকালেই।  রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সর্বশেষ  দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরায় নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে রাজনীতির মাঠে।

তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগই পারে দেশকে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে।’ এটা তিনি বিশ্বাস করেন বলেও জানিয়েছেন। তার এই বক্তব্যে পর্যবেক্ষকদের প্রত্যাশা, দলগুলোর মধ্যে এমন অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে দিতে পারে।

ছাত্রদলের একজন নেতার ভাষ্য, খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ারপারসন। দলীয়  প্রধান  যদি  ঠিক না থাকেন, তাহলে এই দলের কোনও ভিত্তি নেই। আসলে জিয়াউর রহমানের পরিবার মানেই তো বিএনপি। তার দাবি, এমন মন্তব্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা ইতোমধ্যে দেখা গেছে কুমিল্লা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে। গুরুত্বপূর্ণ এই জেলাগুলোয় নেতাদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও এখন সেখানে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বিষয়টি বিএনপির জন্য ‘শাপে বর’ হয়ে এসেছে।

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলা বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে এর চূড়ান্ত ধাপ উন্মোচিত হবে।’

ছাত্রদলের সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলটের দাবি, ‘দলের এই দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। এখন দলে কোনও কোন্দল নেই বললেই চলে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল—সব জায়গায়ই নেতাকর্মীরা একই কাতারে এসে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।’

পাইলট বলেন, ‘গ্রেফতার, হামলা, মামলা সব তুচ্ছ করে নেতাকর্মী-সমর্থকরা আজ সংগঠনের ডাকে এক হয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ সংগঠন মানেই তো দক্ষ সংগঠন। মুষ্ঠিবদ্ধহাতই তো শক্তিশালী হাত। সংগঠনের চলমান কর্মসূচিতে জনসর্মথন, জনসম্পৃক্ততা দিন দিন বাড়ছে, এটা সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে।’

এ বিষয়ে ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার পর দলে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। যেসব বিরোধ-মতপার্থক্য ছিল, সেলো বড় কাজের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেছে। বলতে পারেন, বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের লক্ষ্য, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান, খালেদা জিয়ার মুক্তি।’

কিন্তু খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন,  ‘দীর্ঘায়িত হলেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হবে না। এখানে তো স্বার্থসিদ্ধির উপায় নেই। কেউ দেখে বা কেউ সুযোগসন্ধানী হলেও সেই সুযোগ খুবই কম। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সুযোগসন্ধানীদের মূল্য কমবে। রাজনৈতিক টোপের কোনও আশঙ্কা নেই।’

খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা দিলে, বিএনপি কীভাবে মোকাবিলা করবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘সেটা নিয়ে নীতিগত প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে অশুভ পরিবেশ সৃষ্টি করে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না করে নির্বাচন করলে আবারও দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য হবে না। জোর করে ঘোষণা করে দিলেও হবে? কী হবে তাতে? কর্তৃত্বধর্মী নির্বাচন হলে জনগণের বঞ্চনার বিষয়টি সামনে আসে। তারাই ঠিক করবে, এরকম নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।’ বাংলা ট্রিবিউন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে