মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১৮, ০৯:২১:৩৯

পুলিশের বাসা থেকে চুরি করা অস্ত্রে পুলিশকে হত্যা!

পুলিশের বাসা থেকে চুরি করা অস্ত্রে পুলিশকে হত্যা!

নুরুজ্জামান লাবু : রাজধানীর মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায় দুই পুলিশ সার্জেন্টের চুরি করা নাইন এমএম পিস্তল দিয়েই ডিবির অভিযানিক দলের ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই দুটি পিস্তল উদ্ধার করতেই সোমবার রাতে পীরেরবাগের ওই বাসায় অভিযান চালানো হয়।

অভিযানের আগ মুহুর্তে দোতলার ছাদে সন্ত্রাসীদের বাসাটি দেখতে পরিদর্শক জালাল উদ্দিন ওরফে জাহাঙ্গীর দুই ভবনের কার্নিশ বেয়ে ওপরে উঠেছিলেন। বিষয়টি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা প্রথমে ইট দিয়ে জালাল উদ্দিনের মাথায় আঘাত করে। তারপর মাথা বরাবর দুই রাউন্ড গুলি করে।

এসময় জালাল উদ্দিন কার্নিশের রড থেকে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে যান। ডিবির সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। অন্তত আধ ঘণ্টা গোলাগুলির পর অভিযানিক দলের এসি শাহাদাত হোসেন সুমা একজন এসআইকে সঙ্গে নিয়ে জালাল উদ্দিনকে উদ্ধার করেন। কিন্তু, হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান পরিদর্শক জালাল উদ্দিন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে গেলে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ করে গুলি করে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ওই বাসায় অভিযান চালানো হচ্ছিল। পলাতক সন্ত্রাসীদের ধরতে ডিবির একাধিক টিম অভিযান শুরু করেছে।’

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগের ২৯৯/৯/১/এ নম্বর বাসার চতুর্থ তলায় বসবাসরত দুই সার্জেন্ট মামুনুর রশীদ ও সোহেল রানার সরকারি দুটি অস্ত্র চুরি হয়। বাসার পেছনের গ্রিল কেটে ঘরে ঢুকে দুটি অস্ত্র এবং দুটি মোবাইল নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরদিন এ ঘটনায় মিরপুর থানায় মামলা দায়ের হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের পল্লবী জোনাল টিম অস্ত্র দুটি উদ্ধারে অনুসন্ধান শুরু কে।

ডিবি পশ্চিমের একজন কর্মকর্তা জানান,সম্প্রতি তারা তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় এই চক্রের এক হোতাকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করেন। তার নাম মাইনুদ্দিন। পরে মাইনুদ্দিনের দেওয়া তথের ভিত্তিতে মধ্য পীরেরবাগের ১০৫/১/এ নম্বর বাসাটি শনাক্ত করেন। ওই বাসার তৃতীয় তলায় হাসান ও মানিক নামে দুই সন্ত্রাসী থাকে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানতে পারেন।

পরে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডিবি পশ্চিমের পল্লবী জোনাল টিমের ১০-১২ জন সদস্য ওই বাসায় অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। প্রথমে তারা রেকি করতে যায়। দুই বাসার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা দিয়ে জানালার কার্নিশ বেয়ে ইন্সপেক্টর জালাল উদ্দিন ওপরের দিকে ওঠেন। একতলার কার্নিশে দাঁড়ানো মাত্রই সন্ত্রাসীরা তার মাথায় প্রথমে ইট দিয়ে আঘাত করে। মাথা বরাবর গুলিও করে দুই রাউন্ড। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশও পাল্টা গুলি চালাতে থাকে।

পরিদর্শক জালাল ‘আমাকে বাঁচান স্যার’ বলে চিৎকার করে নিচের দিকে ঝুলে পড়েন। ডিবির কর্মকর্তারা জানান,গোলাগুলি চলার সময় জালাল উদ্দিন বেশ কিছু সময় ছাদের কার্নিশে ঝুলে ছিল। ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে থাকার কারণে পুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করতে পারছিলেন না।

পরে টিম লিডার শাহাদাত হোসেন সুমা একজন এসআইকে সঙ্গে নিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ডিবির টিমের সঙ্গে থানা পুলিশ ও সোয়াট টিমের সদস্যরা যোগ দিলে তিন তলার টিনশেড বাসায় অভিযান চালিয়ে হাসান ও মানিকের স্ত্রী এবং শিশু সন্তানদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাসানের নিজের বাসায় অভিযান শেষে তার স্ত্রীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয় পাশের উত্তর পীরেরবাগের কামালের দোকানের পাশে মা-বোনের বাসায়।

হাসানের বোন আমেনা ও বোনের স্বামী শাহ আলম পুলিশকে জানায়, পুলিশকে হত্যার পর হাসান তাদের বাসায় পালিয়ে আসে। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর সে আবার চলে যায়। পুলিশ হাসানের মা, বোন ও বোনের স্বামীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন,‘আমরা সন্ত্রাসীদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি। সন্ত্রাসীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। আশা করছি খুব শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।’

মঙ্গলবার সরেজমিন মধ্য পীরেরবাগের ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, যেখানে পরিদর্শক জালাল উদ্দিন ওরফে জাহাঙ্গীরের লাশ ঝুলে ছিল সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। বাসার সামনে এবং পেছনে পুলিশের দুটি দল পাহারা দিচ্ছে।

ওই ভবনের নিচতলার বাসিন্দা রুমানা ইয়াসমিন জানান, তারা জানতো হাসান ভাঙারির ব্যবসা করতো। দোতালার ছাদের দুটি টিনশেড কক্ষ হাসান সাড়ে ৭ হাজার টাকা ভাড়ায় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতো। আর পাশের একটি কক্ষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতো নজরুল ইসলাম নামে এক গাড়িচালক।

প্রায় ২৫ বছর ধরে ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে অবস্থান করা রুমানা ইয়াসমিন জানান, এই বাড়ির মালিক হেলাল উদ্দিন ও লাভলী বেগম নামে এক দম্পতি। তারা দুজনই মারা যাওয়ার পর তাদের ছোট মেয়ে লিজা বাড়িটি দেখাশোনা করে।

যোগাযোগ করা হলে লিজা জানিয়েছেন, ৪-৫ মাস আগে হাসানের মা বাসাটি ভাড়া নেয়। প্রথমে তারা একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল। পরে নতুন আরেকটি কক্ষ করা হলে সেটিও ভাড়া নেয় সে। আর হাসানের পাশের অপর কক্ষটিতে নজরুল ইসলাম নামে এক গাড়িচালক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতো বলে জানান তিনি।

চুরি-ছিনতাইয়ে অভ্যস্ত, ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতেও

মঙ্গলবার সরেজমিন মধ্য পীরেরবাগ এলাকায় হাসানের বাড়ির প্রতিবেশী ও তার মায়ের বাসার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে হাসান অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। শুকনা ও ফর্সা চেহেরার হাসান দেখতে সুন্দর হলেও চুরি ছিনতাইয়ের কারণে একাধিকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।

উত্তর পীরেরবাগের কামালের দোকানের পাশের একটি গলির শেষ মাথায় একটি খালি প্লটে থাকেন হাসানের মা, বোন ও বোন জামাই। সরেজমিন ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসার মধ্যে নানারকম পুরোনো জিনিসপত্র এবং খালি বোতল দিয়ে ঠাসা। ঘরের ভেতর কবুতর এবং বাইরে মুরগির ছোট ছোট খাঁচা।

সোমবার মধ্যরাতে এবং মঙ্গলবার দিকে ওই বাসার বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে কিনা খোঁজ করে দেখে পুলিশ সদস্যরা। সেখানে দায়িত্বরত ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, বাসাটা এমন যে যেকোনও জায়গায় অস্ত্র লুকিয়ে রাখলেও স্বীকারোক্তি ছাড়া উদ্ধার সম্ভব নয়।

ওই বাসার প্রতিবেশী শিপন জানান, বাসাটিতে হাসানের পরিবার প্রায় ৩০ বছর ধরে থাকে। এনায়েতুল ইসলাম নামে লালবাগের এক বাসিন্দা এই প্লটের মালিক। হাসানের জন্ম এখানেই। বড়ও হয়েছে এখানে। বিয়ের পর সে আলাদা বাসা নিয়ে থাকা শুরু করে।

শিপন জানান, হাসানেরা তিন ভাই দুই বোন। বড় ভাই ফরিদ গাজীপুরে থাকে। মেজ ভাইয়ের নাম হোসেন। হাসান সবার ছোট। হাসান ছোটবেলা থেকেই নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে তিনি শুনেছেন। এমনকি একাধিকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করেছিল। আর হাসানের দুই বোনের একজন আমেনা তার স্বামী শাহ আলমকে নিয়ে একসময় এই বাসায় থাকতো। আর আরেক বোন কুলসুম বিদেশে থাকে।

আরেক প্রতিবেশী মোশারাফ জানান, হাসান একাধিক বিয়েও করেছে। কখনো সে ড্রাইভারি, কখনো ভাঙারির ব্যবসা করতো বলে তিনি শুনেছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। সে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিশতো কম। তার মেলামেশা ছিল খারাপ লোকজনের সঙ্গে। এক সময় সেও খারাপ পথে চলে যায় বলে শুনেছেন তিনি। বাংলা ট্রিবিউন

এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে