নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলামোটর থেকে মগবাজার যাওয়ার পথে ডানদিকে কুইন্স গার্ডেন টাওয়ার। এরই আটতলায় মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেনস হেলথ। ঢুকেই একজন নার্সকে পেলাম। বললেন, ‘একটু বসুন। ম্যাডাম কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।’ ভাবলাম এই ফাঁকে ঘুরে দেখি। রিসিপশন পার হওয়ার পর ডানদিকে অনেক বেড। রোগীদের কেউ শুয়ে আছেন, কেউ বা বসে। একজন যেমন ফরিদা বেগম। ৪০ হবে বয়স। খুলনায় বাড়ি। তাঁর স্বামী হাঁপানির রোগী। বিছানায় দিন কাটান। মেয়ে আছে একটি।
ফরিদাই সংসার চালান। মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। ফিস্টুলায় ভুগছেন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। এলাকারই একজনের কাছ থেকে হাসপাতালের খবর পেয়েছিলেন। তারপর গত ৩ মে এসে ভর্তি হয়েছেন। বললেন, ‘সারা দিন কাজ করি। প্রস্রাব-পায়খানা করার জায়গা পাই না। সেই ভয়ে খাইছিও কম কম। এখন এখানে আসছি। ম্যাডাম বলেছেন, অপারেশন করলে ভালো হয়ে যাবে।’ ফরিদার পাশের বেডে ছিলেন সাহারা খাতুন।
দুই দিন আগে তাঁর সফল অপারেশন হয়েছে। বললেন, ‘এখন আরাম লাগছে। মঙ্গলবার ছুটি দিয়ে দেবে।’ ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বাড়ি সাহারার। স্বামী বেঁচে নেই। তিনিও খবর পেয়েছিলেন প্রতিবেশী একজনের কাছ থেকে। নওগাঁর নার্গিস আক্তারের ঘটনা কিছুটা ভিন্ন।
একটি বেসরকারি হাসপাতালে জরায়ুর অপারেশন করিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হয়নি। পরে সার্জনের পরামর্শেই এখানে এসেছেন। নার্গিসের সঙ্গে কথা বলার সময়ই এলেন ডা. তাহসিন ইসলাম। বললেন, ‘নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ডিউটি থাকে। তারপর এখানে চলে আসি। চাইলে এই সময়টায় চেম্বার করতে পারতাম। কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য মন টানে।’
ডা. তাহসিন আরো বললেন, ‘এখানে যাদের দেখছেন, এরা সবাই প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী। যোনিপথ, মূত্রাশয় ও মলদ্বারের মাঝখানে অস্বাভাবিকভাবে ছিদ্র হলে তাকে ফিস্টুলা বলে। এর ফলে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রস্রাব-পায়খানা বের হয়ে আসে। আর প্রস্রাব-পায়খানার দুর্গন্ধের কারণে আশপাশের মানুষও কাছে ভেড়ে না।
যাদের এই রোগ হয় তারা মলমূত্র বেগ সামলাতে পারে না এবং নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। অল্প বয়সে সন্তান ধারণ, অপুষ্টি ও অদক্ষ ধাত্রীর হাতে প্রসব ইত্যাদি কারণে ফিস্টুলা হতে পারে। জরিপ বলছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব নারীদেরই এ রোগ বেশি হয়।’ এরই মধ্যে চলে এসেছেন ম্যাডাম ডা. সায়েবা আক্তার।
রোগীর হাসিতে তাঁর খুশি
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারের শুরুও ডা. সায়েবার হাত ধরেই। সেটা ১৯৯৫ সাল। সায়েবা বললেন, ইন্টার্নি করার সময়ই অনেক কয়েকজন ফিস্টুলা রোগী দেখেছি।
অনেকেই স্বামী পরিত্যক্ত হয়েছেন, সমাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এই রোগের কারণেই। শারীরিক কষ্ট তো আছেই। সে থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল তাঁদের জন্য কিছু করার। একসময় ফিস্টুলার ওপর প্রশিক্ষণ নিতে ইথিওপিয়া গেলাম। দেশে ফিরে ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার খোলার উদ্যোগ নিলাম। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর সরকারের সাড়া মেলে। সেখানে অনেক দিন কাজ করেছি। তারপর অবসরে যাওয়ার পর এটি গড়ে তুলি। রোগীদের মুখে হাসি দেখলে আমার ভালো লাগে।’
ইচ্ছা ছিল নিজস্ব জায়গায় গড়ে তুলবেন হাসপাতালটি। এ জন্য আশুলিয়ায় দুইবার জায়গাও কিনেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তা হাতছাড়া হয়ে যায়।
পরে ভাবলেন, জায়গা কিনে হাসপাতাল চালু করতে অনেক সময় লেগে যাবে। তাই ভাড়া জায়গায়ই শুরু করলেন। অবসরের পর প্রায় ৫০ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সব টাকা খরচ করেছেন এখানে। ২০১২ সালে এর যাত্রা শুরু। সায়েবার স্বামী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর কবিরও চিকিৎসক। তিনি এবং শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা দিয়েছেন।
যেমন এই চিকিৎসালয়
মোট চার হাজার বর্গফুট জায়গা। ২২টি শয্যা। আছে একটি অপারেশন থিয়েটার, সেমিনার রুম একটি ডাক্তারদের বসার কক্ষ। নার্স আছেন ছয়জন। কাউন্সিলর একজন। তিনজন মেডিক্যাল অফিসার ছাড়াও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন মোট আটজন।
হাসপাতালটির সুপারভাইজার নিতাই চন্দ্র কর্মকার জানালেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ লাইনস হাসপাতাল ও নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা এসে রোগী দেখে যান। মাসে ২৫ থেকে ৩০টার মতো অপারেশন হয়। রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার—এই তিন দিন চলে অপারেশন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দুই-তিনজন ডাক্তার রোগী দেখেন।
বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। যাঁদের অপারেশন করা লাগবে তাঁদের ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ আর পরামর্শও দেওয়া হয়। অনুদাননির্ভর এ হাসপাতাল। হাসপাতালের নামে একটি জাকাত ফান্ড আছে। সেখান থেকেও কিছু টাকা আসে।
যাঁরা চিকিৎসা সেবা পান
বিশেষায়িত এই হাসপাতালে মূলত নারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। শুধু ফিস্টুলা নয়, মায়েদের প্রসব-পরবর্তী অন্যান্য সমস্যা যেমন—জরায়ু নেমে যাওয়া, যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়া ও যোনিপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিকিৎসাও এখানে হয়ে থাকে। অধ্যাপক সায়েবা বললেন, ‘এটি সম্পূর্ণ দাতব্য চিকিৎসালয়। এখানে রোগীর চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া সবই বিনা মূল্যে। এ ছাড়া কারো যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যাতায়াতের খরচটাও আমরা বহন করি।’
আকলিমা এখন ভালো আছে
ভোলার আইচা গ্রামে বাড়ি আকলিমার। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। প্রথম বছরেই বাড়িতে একটা মৃত সন্তান প্রসব করে সে। প্রসবের পর টের পায় যে প্রস্রাব আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু তখনো তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।
অবস্থা খারাপের দিকে গেলে এক প্রতিবেশী তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিন্তু স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ তাঁর সঙ্গে আসেনি। মোট চারবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয় আকলিমাকে। প্রথমবার ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারে এবং পরের তিনবার অপারেশন হয় মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেন হেলথে। আকলিমার স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে।
ভাইয়েরাও সে রকম খোঁজখবর নেয় না। তিনি এখন মামসের পেশেন্ট কেয়ার স্টাফ। থাকা-খাওয়া সবই এখানে। আকলিমা বললেন, ‘আমি যে একটা মানুষ, আমারও যে মূল্য আছে আগে কখনো বুঝিনি। ভালো থাকা তো পরের ব্যাপার, বেঁচে থাকারই কোনো আশা ছিল না আমার। এখন বেশ ভালো আছি।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শুধু চিকিৎসা সেবা নয়, দরিদ্র রোগীদের পুনর্বাসনেও কাজ করতে চান ডা. সায়েবা। কারো কাছ থেকে জমি পেলে নিজস্ব ভবনে হাসপাতালটি স্থানান্তর করতে চান। বললেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ফিস্টুলামুক্ত বাংলাদেশ। এ জন্য একটি ডেলিভারি সেন্টার খুলতে চাই। সেখানে রোগীদের সেবার পাশাপাশি নবীন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারব। কারণ, ঠিকমতো প্রসবের ব্যবস্থা করা গেলে বেশির ভাগই ফিস্টুলা নির্মূল সম্ভব।’
ঠিকানা : কুইন্স গার্ডেন টাওয়ার, অষ্টমতলা, ১৫ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা।
সূত্র : কালের কণ্ঠ
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস