মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮, ০৪:২৩:০৭

২০ দলীয় জোটে ভাঙন, বেরিয়ে আসছে যে দুটি দল

২০ দলীয় জোটে ভাঙন, বেরিয়ে আসছে যে দুটি দল

নিউজ ডেস্ক: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ যখন পরিসর বাড়াতে উত্তরায় বৈঠকে বসবে, তার ঠিক তিন ঘণ্টা পরই গুলশানের সংবাদ সম্মেলন থেকে ফ্রন্টের অন্যতম প্রধান শরিক বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেবে দুটি অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশ ন্যাপ (নিবন্ধিত) ও এনডিপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন সন্নিকটে, ঠিক এই সময়ে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শরিকদের হারাতে বসেছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) বিকালে ছয় বছরের বেশি সময়ের সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি। তার সঙ্গে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করবেন এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজাও।

মঙ্গলবার বিকাল তিনটার দিকে গুলশানের হোটেল ইম্যানুয়েল-এর ব্যাংকুয়েট হলে সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তারা জোট থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেবেন। একইসঙ্গে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবেন, কেন তারা সম্পর্ক ছিন্ন করতে যাচ্ছেন।

জেবেল রহমাণ গাণি জানিয়েছেন, বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিলেও আপাতত কোনও জোটে শরিক হবেন না। এক্ষেত্রে আরও কিছুদিন তিনি তার দল ও এনডিপির সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

ন্যাপ ও এনডিপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কিনা, তা এখনও অন্ধকারে। অন্যদিকে পর-পর দুই নির্বাচনে অংশ না নিলে আরপিও অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল হবে। এ কারণে দলদুটো চায়, প্রচলিত আইন মেনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে।

জেবেল রহমান গাণির সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট যে, ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় বাংলাদেশ ন্যাপ, এনডিপিসহ তাদের সমমনা আটটি দল। গত ছয় বছরের বেশি সময়ে তারা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অবিচল ছিলেন জোটে। আর বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, গত ১৩ অক্টোবর বিএনপি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ।

ন্যাপ ও এনডিপির নেতারা মনে করেন, এই ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হবে। আর এর মধ্য দিয়ে বিএনপিই মূলত জোটকে বিলুপ্ত করে দিতে চাইছে। যদিও সোমবার (১৫ অক্টোবর) রাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। জোটের সেই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানানো হয়, ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০ দলীয় জোট। একইসঙ্গে ঐক্যফ্রন্টে চারটি দলকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।

জেবেল রহমান গাণি বাংলাদেশ ন্যাপের চতুর্থ চেয়ারম্যান। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে দলটি গঠিত হয়। এরপর ৭৬ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মশিউর রহমান যাদু মিয়া, যিনি গাণির দাদা (বাবার বাবা) । এরপর তার নেতৃত্বেই জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেয় ন্যাপ। এরপর ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ এ ন্যাপ যুক্ত হয়।

জেবেল রহমান গাণি জানান, বিএনপি গঠনের পূর্বে ন্যাপকে স্থগিত করেন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। বিএনপি গঠনের প্রক্রিয়ার সময় ন্যাপের বিভাজন হয়। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যেতে রাজি না হয়ে আলাদা হন নাসের খান ভাসানী, সেটা ছিল একটি ক্ষুদ্র অংশ। মূল ন্যাপ নিয়ে যাদু মিয়া ধানের শীষ প্রতীকের সঙ্গে বিএনপি গঠন করেন।

গাণি বলেন, ‘২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আমার পিতা শফিকুল গণি স্বপন ন্যাপকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ২০০৮ সালে ন্যাপ তার নেতৃত্বেই নিবন্ধন লাভ করে। তার মৃত্যুর পর ২০০৯ সালের আগস্ট ২৩ আগস্ট আমি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ২০১০ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব শুরু করি।’

২০ দলীয় জোটের বৈঠক (ফাইল ফটো)বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে অনেকগুলো কারণ পাওয়া গেছে দলটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে। তাদের ভাষ্য, বিএনপির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ২০ দলীয় জোট থেকে কোনও উদ্যোগ বা সংলাপ করেনি। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করতে গিয়ে ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে আসনের বিষয়ে বিএনপির আলোচনা প্রকাশ্যে এসেছে। এক্ষেত্রে বিএনপির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে ন্যাপের। এছাড়া, বিএনপির পক্ষ থেকে কখনও ন্যাপের চেয়ারম্যানকে সংসদীয় আসন দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত বা সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। ২০১৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ন্যাপ চেয়ারম্যানের নির্বাচনি এলাকা নীলফামারী-১ ( ডোমার-ডিমলা) আসনে বিএনপির সমর্থন চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হন গাণি।

জেবেল রহমান গাণি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আসন চেয়েছিলাম, বিএনপি দেয়নি। বিএনপির কাছে প্রত্যাশাও ছিল অনেক। ন্যাপ তো তাদের সবকিছুর সঙ্গে জড়িত। ধানের শীষের উপহার তারা কিভাবে গ্রহণ করলো। যাদু মিয়ার নামও উচ্চারণ হয় না বিএনপিতে। ভবিষ্যতে বিএনপি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে, এই কামনা করি। কিন্তু বর্তমানে তারা যে রাজনীতি করছে, তার সঙ্গে আমরা দ্বিমত প্রকাশ করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যতবার নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি, সুকৌশলে খালেদা জিয়ার কারাবন্দির কথা তুলে তা থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এখন ঐক্যফ্রন্টে কিভাবে নির্বাচন ও আসন নিয়ে আলোচনা হয়? খুব বেশি দিন নেই নির্বাচনের। অথচ, নির্বাচন নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা নেই। সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে।’

জোট ছেড়ে নতুন কোনও জোটে যাওয়ার চিন্তাভাবনা আছে ন্যাপ ও এনডিপির। এক্ষেত্রে বি. চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট বা অন্য কোনও জোটে দেখা যেতে পারে দল দুটিকে। এ বিষয়ে জেবেল রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে যেকোনও রাজনৈতিক মেরুতে ঐক্যবদ্ধ আপত্তি থাকবে না।’

‘ন্যাপ ও এনডিপি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, আমরা সংবিধানের ঊর্ধ্বে না। আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি থাকতে চাই, তাহলে আইনের অধীনেই থাকতে হবে। এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি, প্রত্যেকটি দল ভোটের মেজাজে চলে গেছে’— নিজের অবস্থানও তুলে ধরেন জেবেল রহমান গাণি।

সদ্য গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে জেবেল রহমান গাণির প্রতিক্রিয়া, ‘আমি ব্লাইন্ডলি ড. কামাল ও ব্যারিস্টার মইনুলদের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারছি না। মইনুল হোসেন নির্বাচন করবেন কিনা, থাকবেন কিনা। এমন অনেকেই আছেন, রাজনৈতিক জোটে সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের আনতে চান। তাহলে আরও অনেক বড় উদার মন নিয়ে করা উচিৎ ছিল। বিএনপির মতো উদার রাজপথের দলকে একজন-দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছে কেন? আমরা অধ্যাপক এমাজউদ্দীনকে দেখতে চেয়েছিলাম। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার পর। তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এমাজউদ্দীন আহমদ। তাহলে ওই সময় তারা কেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্য করেননি? এই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে।’

কী প্রশ্ন আছে, এমন ব্যাখ্যা হয়তো মঙ্গলবার বিকালে সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরবেন জেবেল রহমান গাণি।

সোমবার (১৫ অক্টোবর দিবাগত) রাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকের বিষয়ে জেবেল রহমান গাণি বলেন, ‘আজকে (সোমবার) বৈঠক হলো, অপেক্ষায় ছিলাম। সিদ্ধান্ত ফাইনাল করার আগে দেখি কী বলেন তারা। কিন্তু আমার মহাসচিব গিয়েছিলেন ওই বৈঠকে, আমি কনভিন্স না।’

ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া জানিয়েছেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোট ও চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) জরুরি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।’

একাধিক রাজনৈতিক নেতা জানান, বাংলাদেশ ন্যাপ, এনডিপিসহ আরও কয়েকটি দল একসঙ্গে বিএনপি জোট ত্যাগের কথা আলোচনায় ছিল। যদিও শেষ মুহূর্তে এসে মনোভাব পরিবর্তন করে জোটের এই দুটি শরিক দল। এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার সঙ্গে জেবেল রহমান গাণির সুসম্পর্ক থাকায় শেষ পর্যন্ত তারা এক থাকতে পারছেন বলে জানান কোনও কোনও নেতা।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দীর্ঘদিনের জোটগত সম্পর্ক ত্যাগ করে ইসলামি ঐক্যজোট। এর আগের বছর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিএনপি জোটে ভাঙন ধরিয়ে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। প্রয়াত নীলু ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, ২০ দলের জোটে বিএনপি-জামায়াত সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতো। মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) ন্যাপ ও এনডিপি বেরিয়ে গেলে গত দুই বছরে তৃতীয়বারের মতো ভাঙনের কবলে পড়বে বিএনপি জোট। ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল কলেবরে বেড়ে ১৮ দলীয় জোট হয়। পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে