শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদ: ওখানকার পিচ এবং কন্ডিশন বিবেচনায় চিরুনি অভিযান চলছে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার এর খোঁজে। কখনো ফরহাদ রেজা, কখনো মুক্তার আলী কিংবা কখনো আবুল হাসান রাজুর মাঝে খোঁজা হচ্ছিলো চির অধরা সেই পেস বোলিং অলরাউন্ডার এর ছায়া।
বিশ্বকাপের আগে শেষ আন্তর্জাতিক সফর খেলতে তখন জিম্বাবুয়ে এলো দেশে। ওয়ানডে-টি২০ এর অধিনায়কত্বের পালাবদলের সিরিজে নতুন একটি নাম দেখা গেলো বাংলাদেশ দলে। ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হলো ছেলেটি সেই "পেস বোলিং অলরাউন্ডার" হিসেবে খেলবে।
কিন্তু কিসের কি!
পাঁচ সিরিজের চার ম্যাচ শেষ হয়ে গেলেও দেখা মেলে না সেই ছেলের। অবশেষে ৪-০ তে এগিয়ে থেকে হোয়াইটওয়াশ করার মিশনের শেষ ম্যাচের একাদশে দেখা গেলো ছেলেটির নাম।
কিন্তু তাতেই কার কি বয়ে যায়? ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে নেয়া ছেলেটিকে দিয়ে একটি ওভারও বোলিং করালেন না দলের অধিনায়ক। অবশ্য আরেক স্পিনারের স্পিন জাদুতে ধরাশায়ী জিম্বাবুয়ের সামনে নতুন ওই পেস বোলিং অলরাউন্ডারকে বোলিংয়ে ডাকার সুযোগ ছিলো খুব অল্পই।
তবে ১২৮ রানের ছোট্ট টার্গেটে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ দলের ৫ম ওভারেই উদ্বোধনো জুটির বিচ্ছেদের ফলে অভিষেক ম্যাচেই তিন নাম্বারে ব্যাট হাতে নেমে যেতে হয় ছেলেটির। নামার পরে বেশীক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি। ১০ম ওভারে সাজঘরে ফেরত যাওয়ার আগে বল খেলেছিলেন ১৮টি। আর ঝুলিতে রান? বলের থেকে দুই বেশি। ২০!
এটুকু পড়ে নতুন ছেলেটিকে বাতিল বিবেচনা করছেন? তাহলে একটু অপেক্ষা করুন।
নিজের অভিষেকে খেলা ওই ১৮টি বলেই ছেলেটি বুঝিয়ে দিয়েছিলো সে এসেছে বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে। সে এসেছে জাতীয় দলের ওপেনার তামিম ইকবালকে একটু নির্ভার করতে। কি হয়েছিলো সেই ১৮ বলে? প্রত্যেকটি বল সে খেলেছিলো বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে। চোখেমুখের নার্ভাসনেসটা ব্যাটে ভর করতে দেয় নি বিন্দুমাত্রও। নিখুঁত স্ট্রেইট ড্রাইভ,অফ ড্রাইভের পরে খেলেছিলো দর্শনীয় এক "আপার কাট"। আইসিসি পরে তাঁর এই শটের নাম দেয় "পেরিস্কোপ"।
এতোক্ষণে তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, বলছি সৌম্য সরকারের কথা। সেই যে ১লা ডিসেম্বর ২০১৪তে শুরু সৌম্য রূপকথার, ২০১৫ এর পুরোটা এবং ২০১৬ এর প্রায় অর্ধেকটা সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট ডুবে ছিলো এই "সৌম্য রূপকথা"র জাদুতে।
নিজের খেলা ওই ১৮ বলেই জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন সৌম্য। তাইতো আর দ্বিতীয় চিন্তা না করেই ২০১৫ বিশ্বকাপের জন্য পরম আরাধ্য সেই "পেস বোলিং অলরাউন্ডার" হিসেবে সৌম্য সরকারের নামটাই ঘোষণা করলেন নির্বাচক কমিটির সদস্যরা।
প্রথাগত নিয়মে পেস বোলিং অলরাউন্ডাররা সাধারণত লেট-মিডল অর্ডারে ব্যাট করে থাকলেও, সৌম্যকে বেছে নেয়া হয়েছিলো অভিষেক ম্যাচের মতোই তিন নাম্বার পজিশনের জন্যই। তারই প্রতিদান দিতে বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেই ১০০+ স্ট্রাইকরেটে যথাক্রমে ২৮ এবং ২৫ করলেও, তৃতীয় ম্যাচে এসে প্রথমবারের মতো হোঁচট খান সৌম্য সরকার। নিয়মিত ওপেনার এনামুল বিজয়ের ইনজুরীতে ইনিংসের সূচনা করতে নেমে ৫ বল থেকে মাত্র ২ রান করে আউট হয়ে যান তিনি।
তার পরের ম্যাচেই আবারো তাঁকে ফিরিয়ে নেয়া হয় তাঁর চেনা পজিশন ওয়ান-ডাউনে। আর সেদিনই বেরিয়ে আসে সৌম্যের লড়াই করার অদম্য মানসিকতা। সিমিং কন্ডিশনে এন্ডারসন-ব্রডদের পেস বোলিং এর সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যান অদম্য এক যোদ্ধার বেশ ধরে। মাত্র ৮ রানেই দুই ওপেনার হারানো বাংলাদেশ দলের হয়ে শক্ত হাতে পালটা আক্রমণ চালান ইংলিশ বোলারদের ওপর। কঠিন কন্ডিশনেও রান তুলছিলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। শেষপর্যন্ত ছয় চার ও এক ছয়ে ৫২ বল থেকে ৪০ রান করে আউট হয়ে গেলেও, দলকে দিয়ে যান বড় সংগ্রহের ভীত এবং সাহস। তাঁরই সাহসিকতার হাত ধরে পরে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের দেশের হয়ে বিশকাপে প্রথম সেঞ্চুরী এবং মুশফিকুর রহিম এর ৮৯ রানের ইনিংসে ভর করে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৭৫। এবং ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারানোর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের নক-আউট স্টেজে পৌছে যায় বাংলাদেশ দল ।
পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডেরই বোলারদের বিপক্ষে তুলে নেন নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি। ৫৮ বল থেকে ৫১ রান করার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেন যে তিনি এসেছেন (বোলারদের) শাসন করতে, (বোলারদের কর্তৃক) শোষিত হতে নয়।
স্বপ্নীল বিশ্বকাপ শেষে হাসিমুখে ফিরে আসে বাংলাদেশ দল। এক মাসের বিশ্রাম শেষ না হতেই দেশে উপস্থিত পাকিস্তান ক্রিকেট দল। নিজের অভিষেক সিরিজের মতোই এই সিরিজেরও হোয়াইটওয়াশ করার ম্যাচেই জ্বলে উঠেন তিনি। পাকিস্তানের বোলারদের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো হাজির হয়ে ছয় ছক্কার মারে তুলে নেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরী। সাথে প্রথমবারের মতো জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরষ্কারটাও।
তারপরের ভারত এবং দক্ষিণ-আফ্রিকা সিরিজ কাটে স্বপ্নের মতো। ভারতের বিপক্ষে প্রত্যেক ম্যাচেই তামিমকে সঙ্গে নিয়ে এনে দিচ্ছিলেন উড়ন্ত সূচনা। কখনো পেরিস্কোপ,কখনো অফ ড্রাইভ কিংবা কখনো আবার নান্দনিক স্ট্রেইট ড্রাইভ। প্রতিনিয়তই পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করে চলছিলেন তিনি।
এরই মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের শেষ দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৮৮* ও ৯০ রান করে একা হাতেই ১-০ তে পিছিয়ে থাকা সিরিজকে বাংলাদেশের হয়ে জিতে নেন সৌম্য সরকার। একই সাথে তাঁর ঝুলিতে জমা হয় দুইটি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ এবং একটি সিরিজসেরার পুরস্কার।
দুঃখজনক ভাবে এরপরই উড়ন্ত সৌম্য সরকারের ক্যারিয়ারের উলটো পিঠটাও উন্মোচিত হতে ধরেছিলো প্রায়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিজের ১৭ তম ম্যাচে প্রথমবারের মতো শূন্য রানে আউট হোন তিনি। এছাড়াও তার পরের তিন ম্যাচেও পেরুতে পারেন নি বিশ রানের কোটা।
তবে খুশির সংবাদ হচ্ছে কোচ-নির্বাচকদের ক্রমাগত বিশ্বাসের মর্যাদা দিতেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে রানের ফেরার আভাস দিয়েছেন তিনি।
সাতক্ষীরায় জন্ম এবং বড় হওয়া সৌম্য সরকার জাতীয় দলের জার্সিতে এখনো পর্যন্ত খেলেছেন ২০টি একদিনের ম্যাচ,২২টি টি-২০ ম্যাচ এবং ৫টি পাঁচদিনের ম্যাচ।
একদিনের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হওয়ায় এই ফরম্যাটের ক্রিকেটটা খেলতেই যেনো ভালোবাসেন সৌম্য। এখনো পর্যন্ত ২০ ওয়ানডেতে ৯৯.৪৫ স্ট্রাইকরেট এবং ৪০.২২ গড়ে রান করেছেন ৭২৮।
এছাড়াও ২২টি টি-২০তে ১১৮ স্ট্রাইকরেটে তাঁর সংগ্রহ ৩৮০ এবং ৫টি পাঁচদিনের ম্যাচে ৩২ এভারেজে রান করেছেন ২৮৬।
মজার ব্যাপার হচ্ছে পেস-বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে দলে আসলেও এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বল করেছেন মাত্র ৪৮.৪ ওভার। উইকেটের ঝুলিটাও তাই প্রায় শূন্য। বল হাতে একমাত্র সাফল্য পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান আজহার আলীর টেস্ট উইকেট।
১৯৯৩ সালের আজকের দিনে সাতক্ষীরায় জন্ম নেয়া সৌম্য বিকেএসপিতে খেলা শুরু ২০০৮-০৯ সাল থেকে।শুরু থেকেই প্রচন্ড মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। ২০১০ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলের সদস্য হিসেবে দলে থাকলেও ২০১২ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য হয়েই অস্ট্রেলিয়া সফরে যান সৌম্য। এ'দুইয়ের মাঝে এশিয়া কাপ টূর্ণামেন্টে কাতার অনুর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে করে বসেন অসাধারণ এক ডাবল সেঞ্চুরী।
২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের টি-২০ স্কোয়াডে ডাঁক পেলেও সেবার খেলা হয় নি কোনো ম্যাচ। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের শেষ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ পর্যন্ত।
অভিষেকের পর থেকেই ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে প্রতিনিয়তই শুভসূচনা এনে দিচ্ছেন বাংলাদেশ দলকে। নির্ভার করেছেন সিনিয়র ওপেনার তামিম ইকবালকে। একইসাথে ক্রিকেট বিশ্বকেও জানান দিয়েছেন তাঁর আগমনী বার্তার।
২৪তম জন্মদিনে কোনো ম্যাচ না পেলেও, আশা করা যায় তাঁর জন্মদিনের কিছুদিন পরেই অনুষ্ঠিতব্য শ্রীলংকা সিরিজে দারূণ কিছু ইনিংসের মাধ্যমেই নিজের ২৪তম জন্মদিন উদযাপন করবেন সৌম্য সরকার।-খেলাধুলা
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/ এমটি নিউজ২৪ ডটকম/আ শি