শনিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৮, ১০:৩০:৫৭

'দেশের ক্রিকেটে তার যে অবদান তাতে কিছুতেই খাটো করা যাবে না'

'দেশের ক্রিকেটে তার যে অবদান তাতে কিছুতেই খাটো করা যাবে না'

স্পোর্টস ডেস্ক: আগামী ৫ ফেব্রুয়ারী থেকে শুরু হতে যাওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ডিপিএলকে সামনে রেখে প্লেয়ার্স ড্রাফটের খসড়া তালিকায় গ্রেড ‘সি’তে রাখা হয়েছে একসময় জাতীয় ক্রিকেট দলের নিয়মিত সদস্য, বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেলকে। এর প্রেক্ষিতে তিনি ফেসবুকে নির্বাচকদের মন বড় করার আহবান জানিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছেন তিনি। বুকে জমানো অনেক কষ্ট নিয়ে ফেসবুকে যে পোষ্ট তিনি দিয়েছেন তা কি নির্বাচকদের নাড়া দিয়েছে?

একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের অন্যতম বোলিং ভরসা ছিলেন সৈয়দ রাসেল। ৩৩ বছর বয়সী বাঁহাতি এই বোলার জাতীয় দলের হয়ে ৬ টেস্টে ১২ উইকেট, ৫২ ওয়ানডেতে ৬১ উইকেট এবং ৮ টি-টোয়েন্টিতে ৪ উইকেট অর্জন করেছেন। অন্যদিকে ৬৬টি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ম্যাচে ১৮৫ উইকেট, ১১১ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ১২৯ উইকেট এবং ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগে ১৭ ম্যাচ খেলে ১২ উইকেট অর্জন করেছেন রাসেল। ক্যারিয়ার খুব বেশি স্বস্তিদায়ক নয়, কিন্তু দেশের ক্রিকেটে তার যে অবদান তাতে কিছুতেই খাটো করা যাবে না।

সৈয়দ রাসেলকে বলা হতো ‘বাংলার চামিন্দা ভাস’। বোলিং অ্যাকশন এবং বল সুইং করানোর দারুণ দক্ষতা থাকায় তাকে এমন অভিধা দেওয়া হয়েছিলো। এমনকি সেই ভাসের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের দিন ২৮ রান খরচায় ২ উইকেট তুলে নেন রাসেল। এই রাসেলই জাতীয় দলে অভিষেকের আগে অস্ট্রেলিয়ায় বিসিবি’র এক প্রশিক্ষণ সফরে গ্রেট অজি ব্যাটসম্যান জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে পরপর ৪ বার আউট করেন। মূলত ল্যাঙ্গারই প্রথম রাসেলকে লঙ্কান গ্রেট চামিন্দা ভাসের সাথে তুলনা করেন।

অথচ সেই রাসেল ২০০৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর ২০০৭ সালে টেস্ট ২০১০ সালে শেষ ওয়ানডে খেলেছেন। ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফির সঙ্গেই ক্রিকেটে তার যাত্রা শুরু। তাদের বন্ধুত্বও বেশ মজবুত। কিন্তু সেসময়ের কোচ জেমি সিডন্সের কাছে তিনি একপ্রকার ব্রাত্য হয়ে ছিলেন। মাত্র ৬ টেস্টে খেলানোর পরই তার শেষ দেখে ফেলেছিলেন সিডন্স! পরে আর তার ফেরা হয়নি। মাঝখানে দুর্ঘটনায় পড়ে খেলায় বিরতি দেন তিনি। পরে অবশ্য সুস্থ হয়ে ফিরলেও দলে ফেরার রাস্তা তৈরি হয়নি। কিংবা বলা যায়, তৈরি করতে পারেন নি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সর্বশেষ আসর দিয়ে মাঠে ফিরেছেন রাসেল। লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জের হয়ে খেলেন ছয়টি ম্যাচ, উইকেট নেন আটটি। প্রিমিয়ার লিগের সর্বশেষ ম্যাচে ৩৮ রান খরচায় নেন চার উইকেট।

বাংলাদেশ জাতীয় দল থেকে একবার কেউ বাদ পড়লে তার ফিরে আসা অনেক কঠিন, পেসারদের জন্য সেটা আরও কঠিন। ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত পেসাররাই, কারণ উইকেট’ কথাটা এক সাক্ষাৎকারে রাসেল নিজেই বলেছিলেন। কথাটা আরও একবার প্রমাণিত হলো। এবার তো একপ্রকার অপমানের শিকার হতে হলো তাকে। সর্বশেষ ঘোষিত ড্রাফটের ২২৭ ক্রিকেটারের তালিকায় ‘সি’ গ্রেডে রাখা হয়েছে রাসেলকে, যেখানে পারিশ্রমিক সাড়ে ৩ লাখ টাকা। শুধু রাসেল নয়, জাতীয় দলের বাইরে থাকা আরেক পেসার রবিউল ইসলামকেও সর্বশেষ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই দেশের হয়ে একদা প্রতিনিধিত্ব করা এই ক্রিকেটার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর তা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশও করেছেন। তিনি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘নির্বাচকদের বলছি, মনটা একটু বড় করুন। টেস্ট খেলা দুজন ক্রিকেটারকে এভাবে অপমান না করলেও পারতেন। আপনারই বলেন শ্রদ্ধা করতে, কিন্তু নিজেরাই তো শ্রদ্ধা করা শিখলেন না। রেকর্ড ঘাটুন। পারফর্ম করে ক্রিকেট খেলি, চেহারা দেখিয়ে নয়। শেম অন ইউ গাইজ।’

এই একটা স্ট্যাটাসে কতটা কষ্ট এবং উপেক্ষার জবাব লুকিয়ে আছে তা কি আমাদের নির্বাচকদের মনে নাড়া দিবে? দিবে না, কারণ, শুধু এই দুজন কেন অনেক যোগ্য ক্রিকেটার আজ সঠিক তত্ত্বাবধান এবং সুযোগের অভাবে ঝরে গেছেন। দীর্ঘদিন জাতীয় দলের বাইরে থাকা শাহরিয়ার নাফীজ, তুষার ইমরানদের কথা সবাই জানে। ‘রান মেশিন’ খ্যাত তুষার ইমরান বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০ হাজার রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান হতে চলেছেন। জাতীয় দলের বাইরে থাকা মুমিনুল এইতো সেদিন ২৫৮ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেললেন। প্রায়ই তাকে দলের বাইরে রাখা হয়। নিয়মিত সুযোগ না পেলে তার মতো প্রতিভাও আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারবো না।

শুধু তুষারই নয়, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া অলক কাপালি, নাঈম ইসলাম জুনিয়র, মোহাম্মদ শরীফরাও ক্ষীণ আশা নিয়ে আছেন দলে ফেরার। কিন্তু তাদের সঠিক পরিচর্চা করা হয়না। আর দল নির্বাচন নিয়ে নির্বাচকদের সমালোচনা নতুন নয়। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে কোচ থাকাকালীন নির্বাচকদের ভূমিকা ছিল অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। ক্রিকেট বোর্ডে এখন একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যা দেখার আসলেই কেউ নেই মনে হয়। একজন নির্বাচক আছেন যাকে দেশের মানুষ ঠিকভাবে চিনেই না। এমন এক নির্বাচক প্যানেল আদতে কতোটা যৌক্তিক তা বিসিবি’ই জানে।

রাসেল যে কষ্ট প্রকাশ করলেন সেটা শুধু তার একার নয়। নির্বাচকদের কারণে ক্যারিয়ার নিয়ে সংকটে পড়াদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর রাসেলতো অপমানিত হওয়ার কথাও প্রকাশ করলেন। একজন সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারকে তার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হোক, এমন দাবী করা অন্যায় কিছু নয়। অথচ, যদি এই সহজ কথাগুলো নির্বাচকদের ভাবনায় থাকতো তাহলে এমন কষ্টের কথা এভাবে ফেসবুকে প্রকাশ করতে হতো না রাসেলকে ।

নির্বাচকরা তথা বোর্ড যদি সঠিক ভূমিকা পালন করতো তাহলে আরও অনেক প্রতিভা যেমন উঠে আসতো, তেমনি হারিয়ে যেতো না অনেক প্রতিভা। অপরদিকে, দেশের হয়ে ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদান রাখার প্রতিফল যদি হয় অপমান, সেটাতো অশনি সংকেত। অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন রাসেল। আশা করি, অন্তত, ক্যারিয়ারের গোধূলি বেলায় আর যেন কোন ক্রিকেটারকে রাসেলের মতো ফেসবুকে নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ না করতে হয়। আশা করি, রাসেলের কষ্ট নির্বাচকদের হৃদয় স্পর্শ করবে।
– মোয়াজ্জেম হোসেন মানিক
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে