রবিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৮, ১২:৫৩:৪৫

পাঁচ বছরের কারাদন্ড মাথায় নিয়ে ফাইনাল খেলবেন মডরিচ!

পাঁচ বছরের কারাদন্ড মাথায় নিয়ে ফাইনাল খেলবেন মডরিচ!

অনিমেষ চৌহান: ছড়ানো-ছিটানো জুতা, মোজা, শিনগার্ড। কেউ কেউ জার্সি ছেড়ে একেবারে অন্তর্বাসে নেমে গেছেন, হয়তো অপেক্ষা করছেন শাওয়ারের।কিতারোভিচ হাজির সেখানেই, প্রথমে কোচ ডালিচকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন, এরপর একে একে সব ফুটবলারকে। কেউ প্রেসিডেন্ট ভেবে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন প্রথমে, তবে প্রেসিডেন্ট তখন অন্য মুডে। কয়েকজনকে তো দেখা গেল বেশ নির্বিকার, প্রেসিডেন্ট এসেছে ড্রেসিংরুমে, তেমন গায়েই মাখছেন না যেন!

এই আলিঙ্গনগুলোর মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়বে লুকা মডরিচেরটা। প্রেসিডেন্ট তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন, তাকে দেখে যে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি- বলা যায় সেটাও। মডরিচ ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুটবল নায়ক এখন, এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় তারকা, দলের প্রাণভোমরা। তবে লুকা মডরিচ ক্রোয়েশিয়ায় এখন ভিন্ন কিছু।

গ্রাভার-কিতারোভিচের এই কর্মকান্ড হতে পারে তার ফুটবলের প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, আবার হতে পারে পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটা জনসংযোগের অংশ। তবে ক্রোয়েশিয়ার এই সোনালী প্রজন্মের এমন ফুটবল সাফল্যের পরও বর্তমান চিত্রটা বেশ গোলমেলে।

হ্যারি কেইন যদি ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেন, একটা নাইটহুড তার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেই পারে। কিলিয়ান এমবাপ্পের গোলে যদি ফ্রান্স জেতে ফাইনাল, নতুন ফরাসী রাজা উপাধি পেয়ে যেতে পারেন তিনি। কিন্তু লুকা মদ্রিচ যদি শিরোপাও জেতেন, তাহলে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? অন্তত কেইন বা এমবাপ্পের মতো তেমন কিছুর আশা তিনি নিজেও করছেন না বোধহয়। নিজ দেশের জনগণই যে বেশ চটে আছে তার ওপর! এমনকি অপেক্ষা করে আছে কারাভোগের হুমকিও!

বাস্তবতা বলছে, অনেক গভীরে প্রোথিত দূর্নীতি, বিচার-ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে ক্রোয়াটরা খুব একটা আশাবাদি নন তাদের দেশের ব্যাপারে। রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বের মাঝে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও মুখ থুবড়েই পড়ছে শুধু। নব্বইয়ের দশকের ‘খেলাধুলায় ক্রোয়েশিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করাটা দেশপ্রেমের অংশ’, এমন তত্ত্বের এতো অসদ্ব্যবহার হয়েছে, ক্রোয়াট জনগণরা রীতিমতো বিরক্ত।

এই ‘পাবলিক ফিগার’রা শুধু নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যবহার করেছেন ক্রোয়েশিয়ার ‘ট্যাগ’টা। সমাজের আর দশটা সমস্যা ঢাকতেও ঢাল হিসেবে এই ফুটবলের মতো খেলাকেই ব্যবহার করা হয় বলেও মত তাদের। মডরিচ তেমনই একজন, যার ওপর বিরক্ত ক্রোয়াটরা। শুধু বিরক্ত নন, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার মামলাও আছে তার নামে। এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে ফুটবলই।

এর মূলে আছে মদ্রিচের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলের একসময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি দ্রাভকো মামিচের সম্পর্ক। মামিচ বিভিন্ন সময় ডায়নামো যাগরেবের নির্বাহী কর্মকর্তা, ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ডায়নামো যাগরেবে খেলার সময় আর সবার মতো মডরিচও চুক্তি করেছিলেন মামিচের সঙ্গে।

সেসব চুক্তিপত্রে ছিল, কোনও খেলোয়াড়ের পরবর্তী আয়ের অংশিদারীত্বের বিনিময়ে মামিচ তাদেরকে বর্তমানে আর্থিক সহায়তা করবেন। এবং পরবর্তীতে যেসব আয় হবে, তা করতে হবে তার পুত্র মারিওর অধীনে, যিনি একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্ট। সুতরাং একজন ফুটবলার যদি পরবর্তীতে অন্য কোনও ক্লাবের কাছে বিক্রি হয়ে যান, তাহলে সেই ট্রান্সফার ফির একটা বড় অংশ পাবেন মামিচ ও তার পরিবার।

২০০৮ সালে ১০.৫ মিলিয়ন ইউরোতে টটেনহামে গিয়েছিলেন মডরিচ। তবে প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোই তাকে দিয়ে দিতে হয়েছিল মামিচ ও তার পরিবারকে। বাগড়া বেঁধেছিল মদ্রিচের বর্তমান ক্রোয়েশিয়া দলের বেশ কয়েকজনের ট্রান্সফার ফি-তে মামিচ পরবর্তীতে এসব শর্ত যুক্ত করায়। ডেয়ান লভরেন, সিমে ভ্রসালিকো, মাতেও কোভাচিচ- সবাইকেই বিক্রি করে দিয়েছিল ডায়নামো, এবং সবার চুক্তিপত্রেই নিজের অংশের ব্যাপারটা ঢুকিয়েছিলেন মামিচ। এসব লেনদেনেই অবৈধ পন্থা অবলম্বনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল মামিচকে, ট্যাক্স ফাঁকি সহ কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার করার পর। তিনি সেখানে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন, তার সাজাও হয়েছে ৬ বছরের।

মামিচ অবশ্য পালিয়ে গেছেন বসনিয়া ও হার্জেগোভেনায়। তিনি আবার সেখানকারও নাগরিক, এবং ক্রোয়েশিয়া চাইলেই এখন তাকে এনে শাস্তি দিতে পারবেও না। এই মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়েই ফেঁসে গেছে মডরিচ।

২০১৭ সালের জুনে লভরেনের সঙ্গে সাক্ষী দিতে গিয়ে মডরিচ বলেছেন, ডায়নামো ও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর দিনগুলিতে তিনি ঠিক কতো আয় করতেন, তা তিনি ‘ঠিক মনে করতে পারেন না’। এবং চুক্তিপত্রে যেসব শর্ত নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে এই মামলা, সেসব শর্ত তার টটেনহামে যাওয়ার আগে থেকেই ছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি।

তবে এই সাক্ষী তার আগের দেওয়া জবানবন্দির সঙ্গে সাংঘর্ষিক প্রমাণিত হওয়ার পরই আনা হয়েছে মিথ্যা সাক্ষীর এই অভিযোগ। বিশ্বকাপের পরই শুনানি শুরু হবে তার, দোষী প্রমাণিত হলে পাঁচ বছরের কারাদন্ডও হয়ে যেতে পারে মদ্রিচের। লভ্রেনের সাক্ষী নিয়েও তদন্ত হয়েছিল অবশ্য, তবে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনা হয়নি।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে