বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৭, ১১:৪৫:০৪

৭ খুনের প্রধান আসামী নূর হোসেনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন যারা

৭ খুনের প্রধান আসামী নূর হোসেনকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন যারা

তানভীর হোসেন : নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের হয়ে আইনি লড়াই চালিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা।  নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা সবারই জানা।

চাঞ্চল্যকর মামলাটির প্রধান আসামি নূর হোসেনের মুক্তির দাবিতে মিছিল করতেও দেখা গেছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের। নূর হোসেনের মতো র‌্যাবের চাকরিচ্যুত  আসামিদের পক্ষেও ছিলেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরা।

গত ১৬ জানুয়ারি মামলায় রায় ঘোষণার সময় বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো নূর হোসেনের পক্ষের আইনজীবীদের। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থক অন্য আইনজীবীদের পাশাপাশি জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাদের দেখা গেছে আনন্দ মিছিল করতে। এই সমিতির ১৭টি পদের মধ্যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ৯ জনই আওয়ামী লীগ পন্থী।

এই মামলায় নূর হোসেনের পক্ষে খোকন সাহা, তারেক সাঈদের হয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান (যিনি আগে পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন) আর আরিফ হোসেনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আড়াইহাজার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া। মামলা চলার সময় পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) ওপর চাপ সৃষ্টি করতে দেখা গেছে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের।

গত বছরের ৩ মার্চ একটি মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটিকে কড়া সুরে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। ওই সময় নূর হোসেন সহ কয়েকজনকে নিঃশব্দে হাসতে দেখা যায়। সেদিন খোকন সাহাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বিউটি বলেন, ‘একজন আইনজীবী মারা গেছেন। তাকে খুন করা হয়েছে। আর আপনি একজন আইনজীবী হয়ে কিভাবে এ মামলা করছেন? আপনি তো আপনার সহকর্মী আর ভাইয়ের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করছেন। সাত খুনের পর আপনি আমার বাসায় গিয়ে বলেছেন, সহায়তা করবেন। অথচ এখন আসামীদের পক্ষে কাজ করছেন।’

জবাবে খোকন সাহা বলেন, ‘আমি এখন একজন আইনজীবী হিসাবে মামলায় সহায়তা করছি। এখন আমি একজন আইনজীবী।’

সেদিন বিউটিকে অ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি দেখেছেন, নূর হোসেন আপনার স্বামী সহ ৭ জনকে অপহরণ করেছেন?’

উত্তরে বিউটি বলেন, ‘আমি যদি দেখতাম, তাহলে কি আর আমার স্বামীকে মারতে পারতো। আপনি একজন আইনজীবী। যদি আজ আপনার বোন এভাবে স্বামীহারা হতো, তাহলে আপনার কেমন লাগতো? সাতটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেলো, অথচ আপনারা আসামিদের সহায়তা করছেন।’

১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার পর নূর হোসেনের বরাত দিয়ে খোকন সাহা বলেন, নূর হোসেন বলেছেন যে আমি ন্যায়বিচার পাইনি। আমি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না। রায়ের বিরুদ্ধে অচিরেই উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আশা করি, উচ্চ আদালতে আমরা ন্যায়বিচার পাবো।

তিনি আরো বলেন, আমি, অ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান ও আব্দুর রশিদ পেশাদার আইনজীবী। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলার জন্য আমরা এই মামলায় আসামিদের পক্ষে ছিলাম। আমরা স্বাধীনতার পর থেকে অর্ধশতাধিক মামলার শুনানি করেছি। আমরা প্রমাণ করেছি, এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় শুনানি করার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন আইনজীবী নারায়ণগঞ্জে রয়েছে। আসামিরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে উচ্চ আদালতে আপিল এবং লিভ টু আপিল করতে পারবেন। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করলে ন্যায়বিচার পাবেন বলেও মন্তব্য করেন খোকন সাহা।

অ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান ও আবদুর রশিদ ভূঁইয়াও রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের কথা বলেন।

নূর হোসেনকে নজরুলের অবস্থান নিশ্চিত করেন খোকন সাহা!

সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেনকে সোর্স হিসাবে ব্যবহার করার তথ্য র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। একটি ভিডিওতে নূর হোসেনকে বলতে দেখা যায়, ‘ঘটনার দিন আমি শহর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহাকে ফোন করে বলেছিলাম, ‘দাদা কেমন আছেন?’ দাদাও আমি কেমন আছি তা জানতে চান। পরে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘দাদা, কোর্টে কি নজরুল এসেছে?’ তখন দাদা বলেন, ‘হ্যাঁ, কোর্টে তো নজরুল এসেছে।’

জঙ্গিবিরোধী মিছিলে নূর হোসেনের মুক্তি দাবি
গত ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জে জঙ্গিবিরোধী একটি মিছিলে নূর হোসেনের মুক্তি দাবি করা হয়। সেদিন সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়ে ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ হয়। সিটি করপোরেশনের ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ব্যানারে ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের নেতৃত্বে মিছিলে নূর হোসেনের মুক্তি দাবি করে স্লোগান দেওয়া হয়।

সেদিন মিছিলে ‘নূর হোসেনের সৌজন্যে’ লেখা অনেকগুলো ব্যানার ও ফেস্টুন ছিল। আরও ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি শামীম ওসমান সহ স্থানীয় নেতাদের ছবি। পরে সিদ্ধিরগঞ্জের হাজী ফজলুল হক মডেল হাই স্কুল মাঠে সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল মতিন মাস্টার, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি চন্দন শীল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি আব্দুস সামাদ বেপারী, নাসিক ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল, ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল হক হাছান প্রমুখ।

নূর হোসেনের সহযোগীরাও ক্ষমতাধর
নূর হোসেনের শ্যালক নূরে আলম খান সোনারগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। গত বছর রাজধানীর মহাখালীতে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাওয়া পিস্তলসহ ধরা পড়লেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় পালিয়ে যান নূরে আলম। গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি ৯নং ওয়ার্ড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছেন।

২নং ওয়ার্ডে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসামি ইকবাল হোসেনের কাছে হেরে গেছেন। ইকবাল থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। ৭ খুনের মামলার এজাহারে ইকবাল ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিনকে আসামী করেন বিউটি। এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় পরে। ইয়াছিনসহ একটি পক্ষ বিউটির বিরোধিতা করে। নূর হোসেনের অনুসারীরাও তাদের পক্ষ নেওয়ায় বিজয়ী হন ইকবাল।

৩নং ওয়ার্ডে এবারও জিতেছেন নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। ৭ খুনের পর তিনি দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর এলাকায় ফিরে এলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ৪নং ওয়ার্ডে নূর হোসেনের ক্যাশিয়ার আরিফুল হক হাসান এবারও জিতেছেন। গত বছরের ২৮ এপ্রিল মদসহ আরিফুলকে গ্রেফতার করেছিলো র‌্যাব।

৬ নং ওয়ার্ডে থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মতিউর রহমান জিতেছেন। সাত খুনের পর তিনিও অনেকদিন পলাতক ছিলেন। ওই সময় সিআইডি কয়েকবার মতিউরের বাসায় অভিযান চালায়। নূর হোসেনের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল।

এখনও এলাকায় নূর হোসেনের স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা
নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর সেতুর ঢালে ‘মেসার্স জেরিন ট্রেডার্স’ নামে সাইনবোর্ড দিয়ে বালুর ব্যবসা শুরু করেছেন। শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালটির নিয়ন্ত্রণ ছিলো নূর হোসেনের সহযোগী মনিরের ভাই ছোট নজরুল ও জহিরুলের হাতে। তার ভাতিজা কাউন্সিলর আরিফুল ও কাউন্সিলর বাদলের হাতে এখন ট্রাকস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ। নূর হোসেনের আরেক ভাতিজা আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু এলাকায় ফিরে লেগুনা ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন। সেখানে ৩০০টি লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। পরিবহন সেক্টরের দখল নিয়েছেন নূর হোসেনের ভগ্নিপতি রতন মোল্লা।

ওসির বক্তব্য
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি সরাফত উল্লাহ জানান, এলাকায় কেউ কাউকে হুমকি কিংবা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার মতো কোনও অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে তদন্ত করে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। -বাংলা ট্রিবিউন।
১৯ জানুয়ারী, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে