সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, ০১:১৯:১৭

এক গ্রামে ১২ লাশ, শোকে নির্বাক এলাকাবাসী!

এক গ্রামে ১২ লাশ, শোকে নির্বাক এলাকাবাসী!

আশরাফুল ইসলাম, মো. রফিকুল ইসলাম ও খায়রুল মোমেন : সারি সারি লাশ। এক লাশের পাশে আরেক লাশ। একই পরিবার আর গ্রামের ১২ জনের লাশ এর আগে একসঙ্গে কখনো দেখেননি কিশোগঞ্জের নিকলীর ছাতিরচর এলাকাবাসী। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় গ্রামের এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে হতবাক, নির্বাক হয়ে গেছেন ছাতিরচরসহ আশেপাশের এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। তাদের এমন আকস্মিক মৃত্যুর শোকে কাঁদছে প্রত্যন্ত হাওরের গ্রাম ছাতিরচর। গোটা এলাকায় শোকের আবহ আর বুকফাটা মাতম।

নরসিংদীর বেলাবো দড়িকান্দি এলাকায় বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১৩ জনের মধ্যে ১২জনই কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে গ্রামের মানিক মিয়া (৪৫) ও হাছেন আলী (৩৫) সহ এই দু’জনের পরিবারের ৪ জন করে মোট ৮ জন রয়েছেন। এছাড়া নিহতের ওই তালিকায় দুই ভাই-বোনও রয়েছেন। তারা হলেন- ছাতিরচর গ্রামের মহরম আলীর দুই সন্তান নাজমুল মিয়া (৩০) ও সাধনা বেগম (৩৩)।

নিহত মানিক মিয়ার পরিবারের সদস্যরা হলেন- মানিক মিয়ার স্ত্রী মাফিয়া আক্তার (৪০), ছেলে অন্তর আলম (৯) ও পুত্রবধূ শারমিন আক্তার (২৫)। এছাড়া নিহত হাছেন আলীর পরিবারের সদস্যরা হলেন- স্ত্রী হালিমা আক্তার (২৮), ছেলে ইশান (৯) ও শ্যালিকা ঝুমা আক্তার (১৫)। এই তিন পরিবারের ১০ জনের বাইরে গ্রামের কুতুব উদ্দিনের স্ত্রী ফিরোজা বেগম (২৮) ও সবদর আলীর ছেলে মাইক্রোর হেলপার হীরা মিয়া (৩৫) রয়েছেন। এছাড়া নিহত শারমিনের ছেলে রাব্বি (২) ও নিহত ফিরোজার মেয়ে মারুফা (৭) এই দুই শিশুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

স্বজনরা জানিয়েছেন, নিহত মানিক মিয়া ও হাছেন আলী রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর মাতব্বর বাজার এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন। দুজনেই পেশায় রিকশাচালক। আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় গ্রামীণ মেলাকে উপলক্ষ করে তারা একসঙ্গে ছাতিরচর গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। এছাড়া রোববার মেলা মাঠেই ওয়াজ মাহফিল থাকায় দুই দিন আগেই তারা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ি ফিরতে মাইক্রোবাসে এই দুইজনের পরিবারের সঙ্গী হন মহরম আলীর দুই সন্তান দিনমজুর নাজমুল মিয়া ও তার বড় বোন সাধনা বেগম।

রোববার ভোর ৫টার দিকে মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-১১-৮৬৫১) যোগে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর সকাল ৭টা ১০ মিনিটের দিকে নরসিংদীর বেলাবো দড়িকান্দি এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী অগ্রদূত পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৬৫৬৮) সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে দুই পরিবারের ৮ জনসহ মোট ১৩ জন মারা যান। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ১১ জন আর ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পথে দুজন মারা গেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মারাত্মক এই দুর্ঘটনায় মাইক্রোটি দুমড়ে মুচড়ে যায় এবং বাসেরও সামনের দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দু’টি বাহনই পুলিশ জব্দ করেছে। হাইওয়ে পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে ভৈরবে নিয়ে আসলে সেখান থেকে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও নরসিংদীর জেলা প্রশাসনসহ পুলিশ বিভাগের সহযোগিতায় কোনোরকম ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ এলাকায় নিয়ে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়।

খবর পেয়ে ছাতিরচর ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন লাশগুলো গ্রামে আনতে ভৈরব যান। এমন করুণ মৃত্যু আর স্বজন হারানোর খবর পেয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে ছাতিরচর গ্রাম। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা স্বজনদের মরদেহের অপেক্ষায় জড়ো হন ছাতিরচর লঞ্চঘাটে। ছাতিরচর লঞ্চঘাটে গ্রামের শোকার্ত মানুষজন দাঁড়িয়েছিলেন, কখন আসবে লাশের মিছিল। শুরু হয় অশ্রুসিক্ত নয়নে তাদের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা। প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটি পিকআপ ভ্যানে করে ১১ জনের লাশ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বেলা পৌনে তিনটার দিকে ছাতিরচর ঘাটে এসে পৌঁছান। পরে ছোট নৌকায় করে লাশগুলো ছাতিরচর গ্রামে আনা হয়। লাশগুলো সারিবদ্ধভাবে একের পর এক রাখার পর সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। এসময় স্বজনসহ এলাকাবাসীর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। পরে সন্ধ্যার কিছু আগে স্থানীয় কবরস্থান সংলগ্ন মাঠে তাদের নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। নামাজে জানাজায় নিকলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কারার সাইফুল ইসলামসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।

স্বজনেরা জানান, প্রমত্তা ঘোড়াউত্রা নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনে গৃহহারা সাধনা আক্তার কৈশোরের শুরুতেই পাড়ি জমায় রাজধানী ঢাকা শহরে। বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে স্বপ্ন দেখে বাবার পরিবারে একটু সহযোগিতার। সামান্য আয়ের পুরোটাই তুলে দেয় বাবা-মায়ের হাতে। একদিন পরিচয় হয় চাঁদপুর জেলার ছিদ্দিক মিয়ার সঙ্গে। ছিদ্দিকও ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের মাতবর বাজার এলাকায় থেকে রিকশা চালান। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। এক সময় পরিবারের সমর্থনে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। একদিন নিজেদেরও একটি ঠিকানা হবে বলে সামান্য আয় থেকেই সঞ্চয় করতে থাকে। সাধনার কোলজুড়ে জন্ম নেয় একে একে ৬ কন্যা সন্তান। বড় মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হতেই ভালো পাত্রে পাত্রস্থ করতে কন্যাদের নিয়ে স্বামীর বাড়ি চাঁদপুরে স্থায়ী হয় বছর সাতেক আগে। ৪ মেয়েকে সাধ্যমতো বিয়ে দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে সাধনা-ছিদ্দিক পরিবার।

বিয়ের বাকি স্কুল পড়ুয়া আঁখি (৯) ও পাখি (৭)-এর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সাধনা আবার আশায় বুক বাঁধেন। সিদ্ধান্ত নেন প্রবাসে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে যাওয়ার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধারকর্জ করে স্থানীয় এক দালালকে টাকাও দেন সাধনা-ছিদ্দিক। মেডিকেল ও ফিঙ্গার প্রিন্ট করতে এ মাসেরই ৮ তারিখে ঢাকায় আসে। উঠে ছোট ভাই নাজমুলের কামরাঙ্গীরচরের ভাড়া বস্তিতে। নাজমুল কামরাঙ্গীরচরে থাকা তার এলাকার লোকজনের সঙ্গে ফাল্গুনের প্রথম মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য গ্রাম্য মেলায় বাড়ি আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। মেলার আগেই গতকাল রোববার ছিলো এলাকার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল।

সাধনা তার প্রবাস জীবনের পূর্বে বাল্যসখী, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন আর কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থানের টানে বাপের বাড়ি আসতে ভাই, নাজমুল ও এলাকার লোকজনের ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে ভোর ৫টায় রওনা হয়। বাপের বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলার নদীঘেরা ছাতিরচর ইউনিয়নে ফিরতে নরসিংদী জেলার বেলাবোর কাছে দড়িকান্দি স্থানে মাইক্রোবাসটির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় একটি নিয়ন্ত্রণহীন বাসের। মুহূর্তেই সব শেষ। নিহত ১৩ জনের মধ্যে ভাই নাজমুল ও সাধনারও মৃত্যু ঘটে। সাধনার প্রবাস জীবনের স্বপ্ন হয়ে উঠে শুধুই স্মৃতি। এই দুর্ঘটনা সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, এতো লাশ রাখি কোথায়? নিহতদের স্বজনদের বাঁধভাঙ্গা কান্না সব মানুষের অন্তরে অন্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। গোটা গ্রাম যেন শোকের গ্রামে পরিণত হয়েছে। নিকলী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কারার সাইফুল ইসলাম বলেন, জীবনে এক সঙ্গে এতো লাশ কখনো দেখিনি। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এমজমিন
১০ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে