বুধবার, ২২ মার্চ, ২০১৭, ০৩:১১:৫৮

পলাশে শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানি দেখার কেউ নেই

 পলাশে শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানি দেখার কেউ নেই

তারেক পাঠান পলাশ প্রতিনিধিঃ ময়লা আবর্জনা, শিল্পকারখানার দূষিত ক্যামিকেল বর্জ্য, গৃহস্থালিয় বর্জ্যসহ প্রায় সব ধরণের বর্জ্য ফেলে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করা হচ্ছে। যেন এসব বিষয়ে দেখার কেউ নেই। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ ২২ মার্চ বুধবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব পানি দিবস। ছোট বেলা থেকে  শুনে আসছি যে, পানির আর এক নাম ‘জীবন’। কিন্তু বলতে দুঃখ হয়, আজ পলাশের বিভিন্ন খাল,বিল এবং বিশেষ করে শীতলক্ষ্যা নদীর আশপাশে অবস্থিত প্রায় সবগুলো জলাশয়ের পানির বীভৎস রং ও দুষণের ভয়াবহ অবস্থা দেখে মনে হয় পানির নাম জীবন না হয়ে ‘মরণ’ হওয়াটা উচিত ছিল।

 বিশেষ করে এখন যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় শীতলক্ষ্যা নদীর পানির দশা কি? এই প্রশ্নের জবাবে সবাই হয়তো আমার উত্তরের সঙ্গে একমত হবেন পৃথিবীর কোনো দেশের খাল,বিল, নদ-নদীর পানি মনে হয় এর চেয়ে দূষিত হতে পারে না। প্রতিনিয়ত নদী ভরাট করে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে, ময়লা আবর্জনা ফেলে, শিল্পকারখানার দূষিত ক্যামিকেল বর্জ্য,গৃহস্থালিয় বর্জ্যসহ প্রায় সব ধরণের দুষিত বর্জ্য ফেলে এই নদীর পানিকে যে ভাবে দূষিত করা হচ্ছে তার যথাযথ প্রতিকার ও নজরদারী করার মতো যেন কেউ নেই। বৃষ্টি হলে পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌরসভায় অবস্থিত ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নতুন বাজার এলাকায় জলাবন্ধতার সৃষ্টি হয়। এসব জলাবন্ধতার প্রধান কারণ মানচিত্র থেকে একের পর এক জলাশয় গুলো হারিয়ে যাওয়া। প্রতিনিয়ত নদীর এই পানি কল-কারখনার সৃষ্ট দূষণের কবলে এর ঘনত্ব এত বেড়েছে এবং এর রং এমন বীভৎস কালো ও সবুজ রূপ ধারণ করেছে যেন ইহা দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করাতো দুরের কথা, এতে বসবাসকৃত কোন জলজ প্রাণী ও মৎস বেঁচে থাকতে পারবে কি না এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

 দূষিত এই পানি দিয়ে কৃষিতে সেচ কাজে ব্যবহার, গোসল করা, দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজকর্ম করা একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির এই বেহাল দশার কারণে পলাশে বা গাজীপুরে বসবাসকৃত  প্রতিটি মানুষকে এখন বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট অনুভব করতে হচ্ছে। এই নদীতে পূর্বে যারা গোসল করতেন তারা বলেন, খুবই দুঃখ হয়, শীতলক্ষ্যা নৌপথে ভ্রমনের সময়।অন্তরে যদি কারো সাধ জাগে এক আচঁলা পানি হাতে নেবে বা পানিতে পা ডোবাবে  নদীর পানিতে একটু গাঁ ভেজাবে সেই আশাও এখন গুড়েবালি। কেননা এই পানি হাতে বা শরীরে লাগলে ভয়াবহ চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায়ই বেশি বিরাজ করছে। বর্তমানে দূষণে দূষণে এই নদীর পানি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, এই পানি ব্যবহারের চিন্তা করাতো দূরের কথা তা দেখলেই রীতিমত ভয় পেতে হয়। মূলত: অধিক বিষাক্ত ও দুষিত হয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী। মনে হয় এই পানিকে এখন পানি বললে ভুল বলা হবে। আমরা কি পারি না প্রকৃতিক এই ঋণ মোচনে শীতলক্ষ্যার মতো বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাল, বিল, নদ-নদীগুলির প্রতি একটু সচেতনতা ও সজাগ  দৃষ্টি রাখতে?। যা এমন ধ্বংস ও মৃতপ্রায় নদী-নালাকে বাঁচিয়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, নদীপথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভুমিকা পালন করবে। যা সকলের কল্যাণে ইতিবাচক বলে মনে করেন এখানকার স্থায়ি বাসিন্দারা।

বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন সময়ে পরিবেশবিদ, সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নদী রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের কাছে বিভিন্ন সময় দাবী রেখেছে, আন্দোলন করেছে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের নীতি-নির্ধারকগণ এই ব্যাপারগুলির প্রতি অধিক উদাসিত থেকেছেন।তারা যেন দেখে ও না দেখার মত থাকছে । মূলত: সংশ্লিষ্টদের অধিক উদাসিনতায় শীতলক্ষ্যাকে আমরা মেরে ফেলেছি প্রতিনিয়ত দখল করে এবং জেনে শুনে দূষণ করে। উক্ত কাজে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় প্রকৃতির এমন দূবৃর্ত্তরা নিবিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে এসব অপকর্ম। আজ শীতলক্ষ্যার আশেপাশে অবৈধ ভাবে ভুমি দখল করে গড়ে উঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানা নদীর দুইপার্শ্বে অবস্থিত বহু ক্যামিকেল ফ্যাক্টেরি, শিল্পকারখানা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ফেলা রাসানিক বর্জ্য ও দুষিত আবর্জনা প্রতিনিয়ত নদীকে গ্রাস করছে মৃর্ত্যুর দিকে। বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি সরকারের ছত্রছায়ায় এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অর্থের জোড়ে নদী ভরাট, অবৈধ ভাবে বালু বিক্রিসহ নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা বানিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়েছে । যা এখনও অব্যহত আছে। প্রতিকারে সংশ্লিষ্টদের অধিক নজরদারী এবং নদীর পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর সীমানা পুনরুদ্ধার করা অধিক জরুরী বলে মনে করেন এখাকার স্থানিয় জনতা। বলতে দুঃখ হয়, অবৈধ অর্থের কাছে

প্রকৃতির আশীর্বাদ এই নদীকে অবলীলায় ধ্বংসের এই হীনকাজে কোথাও কোথাও প্রশাসন নির্বাক থেকেছে। এতে আমাদের জনগণ নির্বাধায় নিজ নিজ হীনস্বার্থে নদী দখলের এই কাজগুলো চালিয়ে গেছে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। সরকারের সংশ্লিষ্টদের অধিক উদাসিনতা, ভূমি দৌষুদের অপতৎপরতা, দোষীদের যথাযথ আইনের আওতায় আনতে না পারা ও তাদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া, আইনী দূর্বলতা, ঘুষ বাণিজ্য, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থলিপ্সা এবং অধিক নজরদারীর অভাবে শীতলক্ষ্যা নদীর মতো এমন অনেক খাল,বিল, নদ-নদীকে প্রতিনিয়ত হত্যা করা হচ্ছে। যদিও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, নদীমাতৃক সুজলা-সুফলা কৃষিনির্ভর এই দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ শীতলক্ষ্যার মত শত শত নদ-নদী যা কেবলমাত্র আমাদের অযতœ, অবহেলায়, উদাসীনতায়, অপরিচর্যায় এবং প্রয়োজনীয় নদী শাসনের অভাবে তা প্রতিনিয়ত ক্রমেই শুকিয়ে মৃত খাল ও মরুভুমিতে পরিণত হচ্ছে। যথাযথ নদী শাসনের অভাবে নদী পথের পানি প্রবাহ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ঠিক তেমনি নদীর পানি দূষণ এবং দুই ধারে অবাধে ভুমিদখলের কারণে নদীর স্বাভাবিক রূপ ও গতি ব্যহত হচ্ছে। নদী ভরাট হওয়া  প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদেরকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। যা দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে। বর্তমানে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে ঘনঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন মতো ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদেরকে গ্রাস করছে। এতে দেশ ও জাতি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও কৃষিখাত হচ্ছে বিপর্যস্ত। পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা আশষ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনুরুপ ভাবে পানি দূষণের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট ও দিনদিন তীব্র আকার ধারণ করছে।

পলাশ বাজার ঘাটে নৌকার মাঝি আবদুল হাকিম মিয়া বলেন, দীর্ঘ ২৬ বছর যাবত এই ঘাটে নৌকা চলাই। কিন্তু পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এত দূষিত ছিল না। পানির এখন যেই অবস্থা তাতে নৌকা চালাতে ও ভয় করে। বাঁচাও শীতলক্ষ্যা নদী আন্দোলনের সমন্নয়ক মাহবুব সৈয়দ বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্যে ও দখলে নদীর  পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। শিল্পায়নের নামে নদী দখলের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনা বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত হয়ে দেশের নদ-নদীর জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। আজ থেকে ৫০ বছর পরের চাহিদা ও বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে নদ-নদীর পানি রক্ষা করতে হবে। একটা সময় আসবে যখন দেশজুড়ে জনপদ-নগরগুলোর বিপুল পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে নদীগুলো থেকে। কারণ,ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক মাত্রায় অনেক নিচে নেমে গেছে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের মধ্যে নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি-চেতনা ও দায়বদ্ধতায় পারে দেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে।

তাই আজ আন্তর্জাকি পানি দিবসে আসুন আমরা শপথ নেই যে, আমরা দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর পানি দূষিত করবো না। আমরা সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে নদীকে রক্ষা করবো। নদী দখল বা ভরাট করবো না। নদীকে বাঁচাবো এবং পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসবো।     
২২ মার্চ ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে