শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৭, ০৯:৫৯:৫৫

স্ট্যাচিন-এর গল্পগাথা

 স্ট্যাচিন-এর গল্পগাথা

আবু এন এম ওয়াহিদ: আমি যখন কোনোঅজানা অচেনা নতুন জায়গায় যাই তখন প্রথমেইআমার মনের মাঝে একটা বিশেষ ধরনের তীব্র ও গভীর অনুভূতি ঢেউ খেলে যায়, উত্তেজনায় গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। অপরিচিত জায়গায় জানাশোনা কেউ না থাকায় দুর্ঘটনা বা বিপদ আপদের ভয় থাকে, কিন্তু সে ভয় সহজেই জয় করা যায় নতুন কিছু দেখা ও জানার উদগ্র বাসনায়। এমনি অভিজ্ঞতা এবারও হয়েছে যখনবার্লিন থেকে বাসে করে পোল্যান্ডের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নগরী স্ট্যাচিন-এ ঢুকি। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে এবার সেখানে ছিলাম তিন দিন। এ ক’দিনের কিছু দেখা, কিছু কথা ও কিছু ভাবনা নিয়ে আপনাদের সামনে আজ হাজির হয়েছি।

বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে যখন হোটেলে এসে উঠলাম, তখন ফ্রন্ট ডেস্কে কর্তব্যরত মেয়েদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ না হয়ে পারিনি!রুমে ঢুকেই প্রথম যে বিষয়টি আমার নজর কাড়লো সেটা সচরাচর অন্য কোথাও দেখা যায় না। লক্ষ করলাম বিছানার হেডবোর্ডের ওপর দেওয়ালে চড়ষরংয ভাষায় লেখা একটি উদ্ধৃতি:
"....Jestesmy z tego samego materiatu co nasze sny...."
Szekspir
"....We are such stuff as dreams are made on...."
Shakespeare

এই বাক্যটি শেক্সপিয়ারের কোন নাটক থেকে নেওয়া হয়েছে, এমন কি এর অর্থ কী, ওই মুহূর্তে সেগুলো আমার কাছে মুখ্য প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়নি। তার চেয়ে বড় হয়ে যে বিষয়টি আমার মনে দাগ কাটলো তা হলো, চার শ’ বছর আগে ইংরেজ কবি শেক্সপিয়ার ইংরেজি ভাষায় কী লিখে গেছেন, সেটা হাজার মাইল দূরে অন্য দেশে অন্য ভাষাভাষী মানুষ এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে, পড়ছে, তা থেকে রস নিংড়ে নিচ্ছে। কোনো লেখক, নাট্যকার, কবি কিংবা সাহিত্যিক যখন সার্থক শিল্প রচনা করেন তখন সেটা আর স্থান, কাল, পাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী এবং কালোত্তীর্ণ হয়ে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে টিকে থাকে যুগ যুগ ধরে। সার্থক শিল্পেরমহৎ ¯্রষ্টাব্যক্তিটি জাতির শ্রেষ্ঠসম্পদ থেকে সর্বজনীন হয়ে ওঠেন।

এ কথা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য যে, তাঁর দেশ ও দেশের মানুষ যতো সহজে তাঁর শিল্পকর্মকে সবার মাঝে বিলিয়ে দেয়, ততো সহজে মানুষটাকে ছাড়ে না, ছাড়তে চায় না। তাঁর স্বদেশবাসি তাঁকে একান্তভাবে নিজের বলেই ধারণ করে, লালন করে এবং দাবি করে। আর তাই তো শেক্সপিয়ার আজো ইংরেজদের জাতীয় কবি। ইংরেজরা শেক্সপিয়ারকে নিজের মনে করে, তাঁকে নিয়ে গর্ব করে। আমি আমেরিকা থেকেও একই রকম একটি উদাহরণ দিতে পারি। সাম্প্রতিক কালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র একবার রাইট ব্রাদার্স-এর ওপর একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছিলেন:
"The invention of Wright brothers belongs to the world, but Wright brothers belong to America."
কথাটা তাঁর নিজের না অন্য কাউকে তিনি উদ্ধৃত করেছিলেন, তা আমার জানা নেই। তবে এখানে এই উদ্ধৃতিটির এর চেয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়ে না।
এবার স্ট্যাচিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সেও আমার একটা সুখকর ও ব্যতিক্রমী নতুন অভিজ্ঞতা হলো।  দ্বিতীয় দিনে কনফারেন্স হলেগিয়ে দেখিবিভিন্ন দেশ থেকে আগত ৩০/৩৫ জন অতিথির সাথে স্থানীয় দর্শক-শ্রোতাআছেন আরো প্রায় ২০/২৫ জন। দু’একজন বাদে তাঁদের সবাই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ান। প্রবন্ধ উপস্থাপকদের মধ্যে আমরা মাত্র তিনজন ছিলাম মুসলমান। তার মাঝে হিজাবপরা এক তিউনিসিয়ান তরুণী। তার নাম মারোয়ারি। সে এসেছে তুরস্ক থেকে। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে পি.এইচ.ডি করছে। অন্য জনের নাম গ্যাজমান্দ। তিনি অধ্যাপক-ব্যাঙ্কার, এসেছেন কসোভো-র প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তৃতীয় জন আমি।

মারোয়ারির উপস্থাপনার সময় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত  সবাই তাকে যেভাবে উষ্ণ অভিনন্দন জানালো, তার প্রতি যেভাবে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখালো, তার বক্তৃতার শুরুতে যেভাবে সমীহ করে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, এবং শেষে যে আন্তরিকতার সাথে দর্শক-শ্রোতারা করতালি দিয়ে তাকে উৎসাহ যোগালো, তা একদিকে আমাকে বিস্মিত ও অভিভূত করলো, অন্যদিকে ইউরোপিয়ান বন্ধুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা বাড়িয়ে দিলো অনেক গুণ। ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত মিডিয়া প্রচারণার পরও এমন অভিজ্ঞতা আমার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হয়েছে!

সেমিনারের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের হোস্ট- ম্যাগডালিনার স্বামী ইয়ারোশ্ত তারগাড়িতে করে স্ট্যাচিন-এ আমাদের নিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেছে, অনেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, অনেক অদেখা দর্শনীয় স্থান দেখিয়েছে। তার সাথে আমরা তিনজন ছিলাম। লুক্সেম্বার্গ থেকে আগত ক্রিস্টোস (সে মূলত গ্রিক) এবং তুরস্ক থেকে আগত মারোয়ারি (সে তিউনিসিয়ার নাগরিক) এবং আমি।

সম্মেলন যেদিন শেষ হয়ে গেলো সেদিন বিকেল বেলা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ইয়ারোশ্ত আমাদের নিয়ে গেলো স্ট্যাচিন-এর একটি ছোট্ট কিন্তু অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁয়। এখানে প্রতি বছর হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক এসে ভিড় জমায় মাত্র একটি খাবার খাওয়ার জন্য। এটা অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার যাকে বলা হয় স্ট্যাচিন-এর ডেলিকেসি। জিনিসটির নাম কাপ্টাচিক। সম্ভবত এর উৎপত্তি রাশিয়ায়। কেন বলছি, সেটাএকটু পরে বুঝতে পারবেন। কাপ্টাচিক আকারে এবং লম্বায় হটডগের মতো কিন্তু এর ব্যাস হটডগের দুই-তিন গুণ হবে। এটি ময়দার তৈরি এবং এর ভেতরে থাকে রান্না করা গরু অথবা মুরগীর গোশত, যেমনি থাকে বাংলাদেশের গরম ও মচমচে সমুসায়। এটাকে আলুর চপের মত গভীর তেলে ভাজা হয়। কাপ্টাচিক খেতে বড়ই মজাদার!

হাতে বানানো ছোট্ট চারকোণো কাগজের ট্র্যেতেকাপ্টাচিক পরিবেশন করা হয়। একটা বা দু’টো কাপ্টাচিক কিনলে প্লাস্টিকের গ্লাসে বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় এক কাপ ঘন রক্তলাল গরম পানীয়। এর নাম বার্স্ট। বিটের রসের সাথে এক বা একাধিক ধরনের মসলা মিশিয়ে বার্স্ট বানানো হয়। আমরা সবাই বিফ কাপ্টাচিক খেলাম। কাপ্টাচিক-এর অপূর্ব স্বাদ জিবে লেগে থাকবে অনেক দিন। বার্স্ট স্বাস্থ্যের  জন্য খুব উপকারি, কিন্তু এর স্বাদ আমার কাছে খুব ভালো লাগেনি, আবার একেবারে খারাপও নয়, আছে মোটামুটি।

কাপ্টাচিক যতোটা মজাদার, যে মেশিনে খাবারটি বানানো হয় তার ইতিহাস তার চেয়েও মজার। খাওয়ার পর ইয়ারোশ্ত আমাদেরকে মেশিনটি দেখালো। এটি স্টিলের তৈরি একটি বড় বৈদ্যুতিক মেশিন। স্বয়ংক্রিয় এই মেশিনে এক সাথে অসংখ্য কাপ্টাচিক তৈরি হয়ে ফুটন্ত তেলে টপ টপ করে পড়ে এবং অল্প ক্ষণেই ভাজা হয়ে যায়। দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ানরা ইউক্রেন এবং বেলারুশের দিক থেকে এসে পোল্যান্ডের এক বিশাল ভূখ- দখল করে নেয়। ওই সব দখলকৃত অঞ্চলে রুশ সেনাবাহিনীরএকাধিক অস্থায়ী গ্যারিসন ছিলো। সেই সব গ্যারিসনে সৈনিকদের খাবারের জন্য রাশিয়া থেকে আনা এসব মেশিনে প্রতি দিন ব্যাচ বাই ব্যাচ হাজার হাজার কাপ্টাচিক বানানো হতো। আমরা
যে-মেশিনে তৈরি কাপ্টাচিক খেলামসেই মেশিন ওই ধরনেরই একটি,যা কিনা রাশিয়ানরা যুদ্ধ শেষে পোল্যান্ডের মাটিতে ফেলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হয়েছে ৭০ বছরেরও আগে। সে সময়কার সৈনিকদের পরিত্যক্ত যন্ত্রে তৈরি খাবার খেয়ে মানুষজন আজো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে, এমন ঘটনা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।

শীতের রাতে স্ট্যাচিন-এ কাপ্টাচিক ও বার্স্ট খেয়ে আমরানতুন শক্তি সঞ্চয় করলাম। শুরু করলাম আরো ঘোরাঘুরি। এক সময় ইয়ারোশ্ত আমাদের নিয়ে এলো গিনিজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডরেকর্ডভুক্ত ‘চরড়হববৎ’ সিনেমা হলে, যেখানে সর্ব প্রথম সিনেমা দেখানো হয় ১৯০৭ সালে। তার ইচ্ছা ছিলো আমাদেরকে ওই হলে একটিসিনেমা দেখাবে। অসময়ে যাওয়ায় এবং হাতে সময় না থাকায় তার সে উদ্দেশ্য হাসিল হলো না। আমরা কিছু ছোট ছোট প্ুিস্তকা কুড়িয়ে ‘চরড়হববৎ’  থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর সে আমাদেরকে ডিনারের জন্য নিয়ে যেতে চাইলো আরেকটি ঐতিহ্যবাহী খাবার দোকানে, যেখানে বাল্টিক সাগরের হেরিং মাছ ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না। তবে এই দোকানের প্রধান বিশেষত্ব হলো: মাছ একটি, কিন্তু এটা ১৯ রকমের ভিন্ন ভিন্ন রেসিপিতে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে রান্না করা হয় এবং কাস্টমারদের পরিবেশন করা হয়।

আমি কাঁটাওয়ালা হেরিং খেতে চাইনি বলে ট্যুর গাইড আমাদের নিয়ে আসলো আরেকটি বিশেষ দোকানে যেখানে কেবলই পাওয়া যায় পটেটো কেক। অর্থাৎ আলুর তৈরি এক কিসিমের নোনতা পিঠা। ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখি এখানে সেখানে, মেঝেতে, টেবিলের ওপরে কাঠের বাক্সে রাখা আলু আর আলু। বুঝলাম এমন জায়গায় এসেছি যেখানে সারা দিন ধরে চলে আলু প্রদর্শনী ও আলুর উৎসব। আমরাও যোগ দিলাম এই মহোৎসবে।

মনে পড়লো দার্শনিক জি.সি. দেবের আলু দর্শনের কথা। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতেমানুষ মাছ, গোশত, চাল, ডাল, সবজি,  সব কিছুর সাথেই আলু খায়, কিন্তু এখানে আলুর সাথে কেবল আলুই যায়, অন্য কিছুনয়। এ রেস্তোরাঁয় কাস্টমার যারা আসে তার সবাই শুধু আলুই খায়, অন্য কিছু চায় না, পায়ও না। আলুর পিঠা খেতে এসে বারোয়ারি, ক্রিস্টোস, ইয়ারোশত ও আমি খাবার টেবিলেকাটালাম বেশ কিছুটা সময়। মজা করে সবাই আলুর পিঠা খেলাম, চা খেলাম এবং ঘন্টা খানেক ধরে আমরা চার দেশের চারজন মানুষ এক টেবিলে বসে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পরিবেশে আড্ডা মারলাম। এই আড্ডার মূল বিষয়বস্তু ছিলোবিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতের খাওয়া-দাওয়ার ফিরিস্তি।

আমার ধারণা ছিলো, জনপ্রিয় আরব মিষ্টিখাবার ‘বাকলাবা’-র আদি উৎস্থান গ্রিস, কিন্তু নিজে গ্রিক হয়েও ক্রিস্টোস এতে সায় দিলো না। সে বললো, গ্রিস এক সময় অটোমান সা¤্রাজ্যের অধীনে ছিলো। তখন গ্রিকদের সাথে আরবদের যোগাযোগ, যাতায়াত ও মোয়ামেলাত ছিলো অবাধ ও উন্মুক্ত। এ কথা বলা মুশকিল, বাকলাবা-র ঐতিহ্য গ্রিস থেকে আরব দেশে এসেছে, না আরব দেশ থেকে গ্রিসে এসেছে’। ক্রিস্টোস-এর  ইতিহাসজ্ঞান, বস্তুনিষ্ঠা এবং হৃদয়ের উদারতা লক্ষ করার মতন!

তারপর আমি যখন বললাম, বিখ্যাত আরব খাবার ‘কুসকুস’-কে নিয়ে মোরক্কানরা খুব গর্ব করে। এটা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।  সঙ্গে সঙ্গে বারোয়ারি আপত্তি করে বসলো। সে বললো, ‘‘কুসকুস’-এর জনক প্রাচীন ‘বারবার’ জাতি। মোরক্কানরা যেমন ‘বারবার’ তেমনি তিউনিসিয়ান, আলজেরিয়ান এবং লিবিয়িনরাও। সুতরাং মরোক্কা এককভাবে ‘কুসকুস’-এর মালিকানা দাবি করতে পারে না। কুসকুস-এ তাদের যতটুকু অধিকার আমাদেরও ততোটুকু’।

ক্রিস্টোসের মতে, আরো দু’টি মজার খাবার ‘কোফ্তা’ এবং ‘গাইরোস’-এর সুতিকাগার হলো গ্রিস। তবে বন্ধু মাহবুবের গবেষণমতে ‘কোফতা’র উৎপত্তি পারস্য অর্থাৎ বর্তমান ইরান দেশ, অবশ্য  ‘গাইরোস’-এর উদ্ভব গ্রিসে হলে হতেও পারে। গ্রিক ইয়োগার্টের কথা যখন আলোচনার টেবিলে আসলো তখন দেখলাম ক্রিস্টোস-এর বুক গর্বে ফুলে উঠলো। যখন বিখ্যাত ‘ইজমির কোফতা’ (ইজমির, তুরস্কের জনপ্রিয় পর্যটন নগরী) নিয়ে আলোচনা শুরু হলো, তখনও দেখলাম ক্রিস্টোসের চেহারায় আলোর ঝিলিক, ‘আমার বাবা গ্রিক হলেও আমার নানার বাড়ি ইজমির’।কথাটা বলতে সে একটুও দেরি করলো না। চা খেতে গিয়ে দেখলাম, টি ব্যাগের গায়ে লেখা, ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’। আমি প্রসঙ্গ তুললে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হলো, ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ কী এবং চায়ের প্যাকেটে ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ শব্দ দু’টো লেখারই বা মানে কী। এ বিষয়ে আগামীতে আরেকটি পৃথক রচনা লেখার ইচ্ছা আছে।

আমাদের নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে ইয়ারোশ্ত তাদের নিজেদের কিছু ইতিহাস ও আবেগের কথা পাড়লো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্ট্যাচিন ছিলো জার্মানীর অঙ্গীভূত, জার্মান মানুষ অধ্যুষিত একটি জার্মান শহর। আগেই বলেছি, যুদ্ধে জিতে রাশিয়া পোল্যান্ডের একটি বড় অঞ্চল দখল করে নিলো এবং ওই সব দখলকৃত এলাকা থেকে পোলিশদের স্থানান্তরিত করে স্ট্যাচিন অঞ্চলে নিয়ে এলো। তার আগে রাশিয়ানরা তাদের ইচ্ছামতো যুদ্ধে পরাজিত জার্মানীর উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে প্রায় ২ শ’ কি.মি. পশ্চিম দিকে ঠেলে দেয়। এ ভাবে স্ট্যাচিন পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আজকের স্ট্যাচিনবাসিরা, ‘স্ট্যাচিনবাসি’-তে  পরিণত হয়।  ইয়ারোশ্ত বললো, তারা স্ট্যাচিনের বাসিন্দা হলেও আদতে বহিরাগত। এ শহরে তারা থাকে বটে, কিন্তু তাদের পরিবারের কিংবা বংশের শেকড়ের কোনো সন্ধান এখানে কিংবা এর আশে পাশে কোথাও নেই। এ নিয়ে তাদের মাঝে লক্ষ করেছি গভীর দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার!

ষাট ও সত্তর-এর দশকে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন অহরহ স্লোগান শুনতাম, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, ধ্বংস হোক’। তখন জানতাম না, কিন্তু এখন দেখছি, সাম্রাজ্যবাদী আচার আচরণ শুধু আমেরিকানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই প্রবণতা রাশিয়ানদের মধ্যেও ছিলো, এবং এখনো আছে।

এ বার আসি আজকের শেষ প্রসঙ্গে। শহর ঘুরতে বেরুনোর আগে ওই দিন ইয়ারোশ্ত আমাদেরকে সবার আগে নিয়ে গিয়েছিলো স্ট্যাচিন সেন্ট্রাল  সেমেটারিতে। এটা ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গোরস্থান। এর আয়তন ১ হাজার ৬ শ’ ৬৭ হেক্টর এবং এখানে ৩ লাখ মানুষের কবর আছে। এই বিশাল কবরস্থানে শুয়ে আছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকরা, এখানে কবর আছে রাশিয়ানদের, জার্মানদের, ইহুদীদের। এ ছাড়াও এখানে আছে ইউরোপের অনেক দেশের মানুষেরকবর। যখন কবরস্থানে গিয়ে আমরা পৌঁছাই তখন মাত্র সন্ধ্যা নেমে আসছে। মূল প্রবেশপথের বড় বড় বিদ্যুতের বাতি চোখ ঝলসে দিচ্ছিলো। ভেতরে ঢুকে দেখতে পাচ্ছিলাম, বড় বড় গাছের নিচে কবরে কবরে জ্বলছে নিভু নিভু মোমবাতির কাঁপা কাঁপা মৃদু আলো।

গোরস্থানের মূল রাস্তার মাঝখানে আয়ল্যান্ডে এক অদ্ভূত ধরনের বড় বড় গাছ দেখলাম। এ জাতীয় গাছ আমি আগে আর কোথাও দেখিনি। কবর স্থানের যে অংশ ধরে ইয়ারোশ্ত আমাদের নিয়ে হাঁটলো, সেখানে কোনো ঘাস নেই, একটা গাছের পাতাও নেই। একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝক তকতক করছে। হাঁটতে হাঁটতে ইয়ারোশ্ত কতো কথা বলেছে, আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমি ভেবেছি অন্য কথা।

বিশাল গোরস্থানে অসংখ্য মানুষের কবরের মাঝে আমার মনে হয়েছে, এই লোকগুলোই তো এক সময় আমাদের মতো দু’পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতো, হাঁটতো, চলতো, কথা বলতো, জীবন জীবিকা চালাতো। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, যুদ্ধ করেছে, প্রকৃতি ও সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, মানুষ মেরেছে, নিজে মরেছে। কিন্তু আজ তাদের মাঝে কোনো বিবাদ বিসংবাদ নেই, মারামারি নেই, ঝগড়াঝাঁটি নেই। একই জায়গায় সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে একসাথে সবাই শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।  সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তাদের কাতারে একে একে আমরাও গিয়ে শামিল হবো!
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S.
২১ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে