রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, ০৯:৩৭:৫৬

‘.....খিদের কিন্তু সীমান্ত নেই.....’

‘.....খিদের কিন্তু সীমান্ত নেই.....’

আবু এন এম ওয়াহিদ: এতদিনে নিশ্চয়ই আপনারা জেনে গেছেন যে, আমি দেশবিদেশে চলতেফিরতে যা দেখি তার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিয়েই লিখি। এ ছাড়াচিন্তাভাবনায় যখন যা আসে তার ওপরও লিখি। বেশিরভাগ সময় এ-সব লেখারাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজ, ঘটনা-দুর্ঘটনা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, তাদের জীবন, জীবনঘনিষ্ট সমস্যা ও ব্যথাবেদনাকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়। আজকের লেখাটা এক অর্থে আলোচ্য কোনো বিষয়ের মধ্যেই পড়ে না, আবার অন্য অর্থে এ-সব কিছুর সংমিশ্রণই এই রচনার বিষয়বস্তু। আগেই বলে রাখছি, শুরুতে আপনাদের মনে একটু খটকা, একটু ধাক্কা লাগতে পারে, তবে শেষ অবধি এই  আলোচনার মূল উৎস এবং উপসংহারের সঙ্গে শিরোনামের একটি সার্থক মেলবন্ধন আপনারা খুঁজে পাবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখাটা শুরু করতে চাই দুুই বাংলার স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী কবির সুমনের গাওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গণসঙ্গীতের কথা দিয়ে। গানটি শিল্পীর নিজের লেখা কিনা জানি না, তবে এর ভাব, বাণী, সুর এবং গায়কী এমনভাবে আমার হৃদয় ছুঁয়েছে যে, আমি আপনাদের সাথে পুরো গানটাই ভাগাভাগি করে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আমার অনুরোধ, গানটি শুধু শুধু পড়বেন না, বরং শিল্পীর কন্ঠে অন্তত একবার হলেও শুনে নেবেন। গানের ভাব যেমন গভীর, বাণী যেমন শক্তিশালী তেমনি, বাংলাদেশের জামাই (কয়েক বছর আগে তিনি বাংলাদেশের গানের পাখি সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেছেন),কবির সুমনের কন্ঠে এটি শুনিয়েছে চমৎকার! ইউটিউব হোমপেজে গিয়ে সার্চ দিলেই গানটি পেয়ে যাবেন। গানের কথাগুলো এরকম:


‘একটা থালায় চারটি রুটি, একটু আচার একটু ডাল,
একই থালায় দু’জন খাবি যুদ্ধ হইত অস্বীকার।
একটা মাটি দু’জন সেপাইদেশবিভাগের সীমান্তে,
দু’জন আছে দুই দিকে আর বন্ধু তারা অজান্তে।
তারা এদেশ ভাগ করেনি দেয়নি কোথাও খড়ির দাগ,
নেতারা সব ঝগড়া করেন জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।
ঝগড়া থাকে আড়াল করে লাভের মাটি লাভের গুড়,
সীমান্তে দুই দেশের সেপাই দেশপ্রেমের দিনমজুর।
দুই কাঁধে দুই বন্দুক আর বুলেট বেশি খাবার কম,
রাজধানীতে হিসেব কষে এদের নেতা ওদের যম।
যমের বাড়ি কাছেই আছে অনেক দূরে নিজের ঘর,
দেশপ্রেমের নজির হলো এই চিতা আর ওই কবর।
খিদের কিন্তু সীমান্ত নেই, নেই চিতা, নেই কবরটাও,
যুদ্ধটাকে চিতায় তোলো যুদ্ধটাকে কবর দাও’।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, কবির সুমন এই গানের বাণীতেইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্র, রাজনীতি, কৌশল, কূটনীতি, যুদ্ধ, ধর্ম, হিংসা, শান্তি, সমাজ, সভ্যতা, বাস্তবতা, এবং মানবিক আবেদনের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। গানের সবগুলো চরণের সাথে আমি পুরোপুরি একমত নই, তবে শেষের দু’টি লাইনের মর্মার্থ আমাকে দারুণভাবে টানে, ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে! আজকের নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে আমি পাঠকদের বিবেচনার জন্য দু’একটি কথা বলতে চাই। ইতিহাসের আদি কাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই কোনো কোনো দেশে সম্পদের প্রাচুর্য, আবার কোথাওবা দারিদ্রের নিদারুণ কষাঘাত,  অভাবের অপশাসন। কোনো দেশে মানুষ না খেয়ে মরছে, আবার কোনো দেশে হচ্ছে অঢেল খাবারের অপচয়, সাধিত হচ্ছে ইচ্ছাকৃত খাদ্যের বিনাশ, কিন্তু এটা তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না। পৃথিবীতে মানুষকে পাঠানোর আগেই তার স্রষ্টা মহান আল্লাহ্জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি উপাদান উপযুক্ত পরিমাণে তৈরি করে রেখেছেন। এখানে কোনো কিছুরই কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।

কোনো কোনো বিশেষ দেশের জন্য প্রযোজ্য না হলেও বৈশ্বিকবিবেচনায় কথাটি ষোলো আনা সঠিক। পৃথিবীর জনসংখ্যা আজ ৭০০ শ’ কোটি পেরিয়ে গেছে, তবু হিসেব করলে দেখা যাবে সারা দুনিয়ায় এখন যা খাদ্য উৎপাদিত হয় এবং বিশ্বে অন্যান্য যত সম্পদ আছে তা পৃথিবীর তাবৎমানুষের জন্য পর্যাপ্ত। তার ওপর মানবসন্তান শুধু একখানা মুখ নিয়েই তো পৃথিবীতে জন্মায় না,  সে সঙ্গে করে নিয়ে আসে মগজভর্তি গোলাকার একটি মাথা এবং কাজের যোগ্য একজোড়া হাতিয়ার, যা কীনা তার হস্তযুগল। আল্লাহ্র দেওয়া সম্পদ এবং জীবনের উপাদানে তার জন্মগত সমঅধিকার নিশ্চিত করা থাকলে, যে কোনো মানুষ নিজের আহার নিজেই যোগাড় করে নিতে পারে। সম্পদের ওপর মানুষের সমঅধিকারটাই আসল সমস্যা।

জগতের প্রতিপালক মানুষজাতিকে গোটা পৃথিবীর ওপর এচেটিয়া  কর্তৃত্ব দিয়েছেন এবং সম্পদে সমান অধিকারও দিয়েছেন, কিন্তু মানুষ নিজেই ডেকে এনেছে তার নিজের সর্বনাশ। প্রশ্ন করতে পারেন, কিভাবে? মানুষ তার ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় কৃত্রিম সীমান্ত দিয়ে পৃথিবীকে ভাগ করেছে ভিন্ন ভিন্ন্দেশে, বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রে। তারপর জাতিসংঘ সনদ বানিয়ে সেটাকে করেছে ঐশীগ্রন্থের মত পবিত্র, অলঙ্ঘনীয়। আর সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে এখান থেকেই। এর ফলে কিছু কিছু দেশ, শক্তি ও কূটকৌশল, কিংবা নিছক ঐতিহাসিক কারণে অসমভাবে সব মানুষের জন্য নির্দিষ্ট সম্পদের একটি বড় অংশকে নিজেদের সুবিধামত কুক্ষিগত করে ফেলেছে এবং বাকিরা সম্পদের অভাবে হাহুতাশ করছে।

তার আগে, প্রাচীন কালে অবশ্য পৃথিবীতে চালু ছিল যতসব জঙলি নিয়ম। ন্যায়নীতিভিত্তিক আইনকানুন কিছুই ছিল না। ‘জোর যার মুল্লুক তার,’ সেটাই ছিল সে সময়কার রেওয়াজ। তখন আধুনিক সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাও ছিল না। যুদ্ধবাজ রাজাবাদশা এবং সেনাপতিরা গায়ের জোরে পৃথিবীব্যাপী যত্রতত্র মানুষের সম্পদ লুটপাট করত। যুদ্ধ জিতে সবার জন্য সৃষ্ট সম্পদের ওপর বিস্তার করত নিজেদের অন্যায্য একচেটিয়া আধিপত্য। অন্যকে অনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে অপচয় করত সেই সম্পদের। জাতিসংঘের আবরণে আজকেও চলছে সেই একই খেলা, একই লুন্ঠন, তবে একটু অন্যভাবে, আড়ালে আবডালে।

সব মানুষের একই তো উৎস। তারপরও তারা সাদা কালো, ধনী-গরিব, এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হলোকিভাবে? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। মানুষকে তার প্রভূ ভিন্নরূপে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা পরষ্পরকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে, আরো ভালো করে চিনতে পারে, জানতে পারে। আল্লাহ্ এমনটি করেছেন মানুষে মানুষে ঝগড়াঝাঁটি করার জন্য নয়, কিংবা তাদের মধ্যে কেউ উত্তম কেউ অধম একারণেও নয়, কিন্তু মানুষ তার কুবুদ্ধি দিয়ে সেই ভিন্নতার সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ বের করেছে। এই ভিন্নতার  ওজর দেখিয়ে জাতিতে জাতিতে শুরু করেছে বিদ্বেষমূলক প্রতিযোগিতা, মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ ও স্বার্থের খেলা। সে যা-ই হোক, এ প্রসঙ্গে কবির সুমন তাঁর ওই গানে ঠিকই বলেছেন,

‘...খিদের কিন্তু সীমান্ত নেই, নেই চিতা, নেই কবরটাও,
যুদ্ধটাকে চিতায় তোলো যুদ্ধটাকে কবর দাও।’

যে দেশে দারিদ্র আছে, অভাব আছে, খিদে আছে, সে দেশের মানুষকে কৃত্রিম রাষ্ট্রীয় সীমান্ত দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সেটা কোনো যুগে কোনো কালেই সম্ভব হয়নি, এখনো হচ্ছে না। খিদের জ্বালায় ও উন্নত জীবনের সন্ধানে মানুষ আজ মরক্কো থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী সাঁতরে স্পেনে চলে যাচ্ছে। তিউনিসিয়া থেকে ছোট ছোট নৌকো করে চলে যাচ্ছে ইটালীর সিসিলিতে। মেক্সিকো থেকে দুর্গম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষ জান হাতে নিয়ে চলে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পূর্ব ইউরোপের অভাবতাড়িত জনগোষ্ঠী অনবরত ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। বাংলাদেশ থেকে সাহসী তরুণরা অভিনব পন্থায় চলেযাচ্ছে পূর্ব এশিয়া ওমধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, আসছে আমেরিকাতেও। যাওয়ার পথে কেউ ঠগবাটপাড়ের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ বাক্সবন্দি লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। কেউ থাইল্যান্ডের গভীর জঙলে গণকবরে ঠাঁই পাচ্ছে, আবার কেউ পেট ভরে খেতে গিয়ে সাগরের নোনা পানিতে নিজেই কুমির আর হাঙ্গরের খাবার হয়ে ভাসছে।

তবু তারা দমবার পাত্র নয়। জীবিকার খোঁজে অনবরত এলোপাথাড়ি ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এই চলাফেরায়, এই যাওয়া-আসায় সবচেয়ে বড় বাধা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসীমার নিয়মকানুন ও বাধ্যবাধকতা। মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম সীমান্তের কারণে মানুষ সহজে চলাফেরা করতে পারে না। আয়উপার্জনের জন্য স্বাভাবিকভাবে সহজে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে না। সীমান্ত না থাকলে মানুষের এ অসুবিধা হতো না। ইদানীং এ অসুবিধা দূর হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, কিন্তু ইউরোপের এই সাতাশটি দেশই তো আর পৃথিবী নয়। দুনিয়াটা আরো অনেক বড় এবং এর সমস্যাও অনেক বেশি, জটিল ও গভীর।

এ ছাড়া আটলান্টিকের ওপারে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ‘ব্রেক্সিট’ এবং এ পারে ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর নির্বাচন-বিজয়বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিপরীতমুখী বার্তা। যে-সব দেশ অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তুলনামূলকভাবে অল্প লোকসংখ্যা নিয়ে বিশাল ভূখ-ের মালিক হয়ে বসে আছে, তারাএকদিকে দুনিয়াব্যাপী তাদের উৎপাদিত পণ্য ও জমা করা পুঁজিভা-ারের অবাধ বিচরণ ও নিরাপত্তা চায়, আবার অন্যদিকে  শ্রমশক্তি ও গণমানুষেরআন্তর্দেশীয় অবাধ চলাচলে দারুণভাবে ভয় পায়। এ বৈপরিত্য ও তার জটিলতা আর কেউ না হলেও সাম্প্রতিককালে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মে এবং আশা করি শিগগির টের পাবেন নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কেন এবং কিভাবে সে নিয়ে আলাদা আরেকটিপিস লিখার ইচ্ছা আছে।
১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে