রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১০:২১:১৭

স্বর্গীয় আভা

স্বর্গীয় আভা

মোহসিনা বেগম: দেখতে দেখতে লাল টকটকে সূর্যটা ডুবে গেলো। একটু পরেই মাগরিবের আজান ভেসে এলো ।

হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে টুলের উপর রেখে মরিয়ম তাঁর স্বামীকে উঠিয়ে তায়াম্মুম করিয়ে আবার শুইয়ে দিলেন। শুয়ে শুয়েই ইশারায় নামায পড়বে সে।

মরিয়মও অজু করে নামাযে দাঁড়ালেন। নামায শেষ করে আবার ফিরে আসলেন স্বামী আনাস এর বিছানার পাশে। আজ একমাস হলো মানুষটা বিছানায় । ডান দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে জীবনে আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না সে। মরিয়ম এসে আনাসের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।

মানুষটার কষ্ট যেনো তাঁর বুকে বিঁধে থাকে সবসময়। কিন্তু কি করবেন! চেষ্টা তো আর কম হলো না! ভিটের এই ঘরটুকু বাদে সবই ডাক্তারের পেছনে চলে গেছে। বিয়ের দুই যুগ পার হয়ে গেছে , তাঁদের দুই জনের ভালোবাসায় এতটুকু ভাটা পড়েনি।

এতো বছরে তাঁদের মধ্যে মান - অভিমান সামান্য হলেও ঝগড়া কখনওই হয়নি । এক স্বর্গীয় আভা যেনো সবসময়ই তাদের মন আলোকিত করে রাখতো। সামান্য ভুল হলেই আনাস বিনীতভাবে মরিয়মের কাছে মাফ চেয়ে নিতো। স্বামী অন্ত প্রাণ মরিয়মও সবসময় নিজেকেই শাসন করতো। ভুলেও স্বামীর কোন অন্যায় তাঁর চোখে পড়তো না। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়!

আনাস ধীর কণ্ঠে ডাকলো ,
- মরিয়ম
- কিছু বলবেন?
- তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে ,না?
-- কিসের কষ্ট?
-- এই যে সংসার চালাও ধার দেনা করে, আবার দিন রাত আমার সেবা করো...
-- কি যে বলেন! আপনার মুখের দিকে তাকালে আমার কোন কষ্টকেই কষ্ট মনে হয় না। আপনার তো অনেক কষ্ট। জানিনা আল্লাহ কবে আপনাকে কষ্ট মুক্ত করবেন!
-- আল্লাহ আমাকে চল্লিশটা বছর সুখে রেখেছেন। এই এক মাসেই ধৈর্য্য হারা হলে চলবে ? আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন। দোয়া করো যেনো তাতে উত্তীর্ণ হতে পারি। জাকারিয়া কবে আসছে?

-- আলহামদুলিল্লাহ। হেফজ তো আগেই শেষ করেছে, , দাওরা হাদিসও শেষ করে ফেলেছে সামনের সপ্তাহে একেবারে বিদায় নিয়েই বাড়িতে চলে আসবে। বাড়ি এসে এখানকার কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হবে। বাড়ি থেকেই সাইকেল দিয়ে মাদ্রাসায় যাবে । আপনি একদমই চিন্তা করবেন না। আল্লাহ আমাদের ছেলেকে ইসলামের সঠিক বুঝ দিয়েছেন।

- - আলহামদুলিল্লাহ। গত রাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম , আলেমদের এক মহা সমাবেশ চলছে, সেখানে জাকারিয়া মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। দেখে আমার মনটা ভরে উঠেছিলো।
-- দোয়া করবেন আপনার স্বপ্নটা যেনো সত্যি হয়। তাহলে আমিও খুব খুশি হবো। এমন একটা স্বপ্ন আমিও রোজ দেখি। আমাদের ছেলে হবে এক সত্যিকারের ইমানদার, ইসলামের খাদেম।
.
জাকারিয়ার বয়স এখন ১৯বছর। বিয়ের ৯ বছর পরেও যখন তাঁদের কোনও সন্তান হলো না তখন তাঁরা গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে একটি নেক সন্তান চাইলো। আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করে একটি ছেলে উপহার দিলেন।

ছোট বেলা থেকেই জাকারিয়া খুবই নম্র - ভদ্র হয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো। আনাস ছিলেন মসজিদের মুয়াজ্জিন। সুললিত কণ্ঠের অধিকারী আনাস যখন আযান দিতেন তখন গ্রামের সব পুরুষ যেনো প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে মসজিদে হাজির হতো।

দুই বছর বয়স থেকেই জাকারিয়া বাবার সাথে নিয়মিত মসজিদে যেতে শুরু করলো। ছেলের আচার আচরণ কথা- বার্তা শুনে মরিয়মেরও খুব ভাল লাগতো। ছোট বেলায় নানান প্রশ্ন করে মরিয়মকে নাজেহাল করে দিতো। মরিয়মের খুব ভালো লাগতো ছেলের এসব কৌতূহল,
- মা, আকাশে ঐগুলা কী?
- ঐগুলা তারা
- তারা কে বানিয়েছেন?
- আল্লাহ বানিয়েছেন। এই পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য ,নদী, সাগর , পাতা , ফুল সব কিছুই আল্লাহ বানিয়েছেন।
-- মানুষ কে বানিয়েছেন?
-- আল্লাহ মানুষ বানিয়েছেন। তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাঁর গুণগান করার জন্য।
-- আমিও আল্লার ইবাদত করবো। ইবাদত কিভাবে করে মা?


-- আল্লাহ আমাদের সব কথা কুরআনে বলে দিয়েছেন। পড়লেই সব জানতে পারবে। এই যে তোমার বাবা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, জিকির করেন, কুরআন তিলাওয়াত করেন, মানুষের সাথে ভাল ব্যবহার করেন , মানুষকে সাহায্য করেন এগুলি সবই ইবাদত।
এভাবেই জানার কৌতূহল নিয়ে শিখতে শুরু করে জাকারিয়া। বাবা আনাসের মতো তাঁর কণ্ঠও শ্রুতিমধুর।
.
জাকারিয়া জানতো তাকে নিয়ে তাঁর বাবা বড় একটা স্বপ্ন দেখেন। তাই সে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামের প্রতি সমর্পণ করে দিয়েছে। আজ সে একজন নামকরা হাফেজ । সারা দেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন ভাল ভাল মসজিদ মাদ্রাসা থেকে তাঁর চাকরির প্রস্তাব আসে কিন্তু সে তাঁর কথায় অনড়। বাবা মায়ের কাছে থেকে তাঁদের সেবা করবে। আর গ্রামের মসজিদ মাদ্রাসার খেদমত করবে।

এমন সময় তাঁর ওস্তাদ ফোন করে তাকে একটা খবর জানালো । শুনে জাকারিয়া খুব খুশি হলো কিন্তু পরিবারকে ছেড়ে এতো দূরে যেতে হবে ভাবতেই মনটা একটু খারাপ হলো। তারপরও যেতে রাজি হলো কারন দেশে বিদেশে ঘুরলে আল্লাহর সৃষ্টি বৈচিত্র দেখা যায় , স্রষ্টার প্রতি ভয়- ভালবাসা বেড়ে যায়। মিশরে গেলে আল্লাহর এক বিশাল কুদরত দেখতে পাবে সে। আল্লাহর সৃষ্টি এবং কুদরত তাকে সবসময়ই টানে।

যতই ভাবে স্রষ্টার প্রতি মাথা নত হয়ে আসে তাঁর। মিশর হয়ে জাকারিয়াকে যেতে হবে সুদান, সেখান থেকে বাহরাইন, সেখান থেকে দুবাই। ফেরাউনের দেশ মিশর তাকে টানতে লাগলো। কুরআনের ২৭ টি সূরায় ৭৪ বার যে ফেরাউনের নাম এসেছে তাকে নিজ চোখে দেখা দারুণ সৌভাগ্যের ।

১৮৮১সালে যখন মিশরে লাশটি পাওয়া যায় তখন লাশটির বয়স ছিলো প্রায় ৩০০০ বছর। ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ কুরআনে ফেরাউনের কথা উল্লেখ করেছেন। মানবজাতিকে আল্লাহর নিদর্শন দেখানোর জন্য আল্লাহ লাশটাকে ধ্বংস করেন নাই। সেই ফেরাউনকে দেখতে পাবে! জাকারিয়া অন্তরে বেশ পুলক অনুভব করলো।
.
ভিসার কাজ শেষ হতে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। এই কয়েকদিন ইংরেজিটাও মোটামুটি শিখে নিলো সে। বিমানবন্দরে পৌঁছে বসে আছে। প্লেন ছাড়তে আরও তিন ঘন্টা বাকি। আশেপাশের মানুষজন দেখছে সে। কাছে দাঁড়িয়ে এক লোক ফোনে কথা বলছে ।

খুব ধনী হবে লোকটা। কথা বলতে বলতে বেশ উত্তেজিত হয়ে ইংরেজিতে গালি গালাজ করছে। জাকারিয়া বুঝতে পারলো লোকটি তাঁর স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। কিন্তু অবাক হলো সে, মানুষ তাঁর আপনজনদের সাথে এভাবে কথা বলে!

একটু পরেই লোকটি চলে গেলো , হাতের ছোট ব্যাগটা ফেলে গেলো ভুল করে। জাকারিয়া ব্যাগটা এনে নিজের কাছে রাখলো। একটু পর হন্তদন্ত হয়ে লোকটা ছুটে এলো। জাকারিয়া তাকে ডেকে ব্যাগটা দিলো। লোকটি তাকে ধন্যবাদ দিলো।

   জাকারিয়া বললো,
-- ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই আমার কর্তব্য ছিলো এটা।
-- ব্যাগে আমার লক্ষ টাকার জিনিস ছিলো। তোমাকে এই ৫০০০টাকা দিলাম , নাও।
-- অন্যের টাকায় আল্লাহর বান্দাদের কোন লোভ থাকা উচিত নয়। আপনাকে ধন্যবাদ।
বলে টাকাটা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলো সে।
-- তা তুমি যাচ্ছ কোথায়?
-- আল্লাহ চাইলে প্রথমে মিশর যাবো।
-- প্লেনে উঠবা মিশর যাবা, আল্লাহর চাওয়া না চাওয়ার কি হলো!
জাকারিয়া চমকে গেলো, এই লোক তো ধর্ম - কর্ম করে না মনে হয়।
-- ভাগ্যে না থাকলে কেউ কিছুই পারে না।


-- অবাক হয়ে গেলাম। এই যুগের ছেলে হয়েও তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করো? পান্জাবি টুপি পড়ো! ভাগ্য টাগ্য বলে কিছু নাই। আমার ছেলে ইউরোপ থাকে , ওখানেই বিয়ে করেছে , আমি ভাগ্য বিশ্বাস করি না। ছেলের পিছনে শ্রম দিয়েছি , ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ আসছে, এমেরিকান এয়ারলাইন্সে আসবে, দুই টায় এসে পৌঁছাবে । আরও চার ঘন্টা বাকি!

জাকারিয়া আর কথা বাড়ালো না, চুপ করে বসে রইলো।
পরদিন খবরে শুনতে পেলো এমেরিকান এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি ঢাকা এয়ারপোর্টে দুইটায় পৌঁছানোর কথা , সেটা মাঝ পথে বিকল হয়ে সাগরে ডুবে গেছে।

আল্লাহর কি কুদরত! ভাগ্যই যে সত্যি, তা আবারো প্রমানিত হলো ।মিশরের মমি ও ফেরাউনের বিশাল আকৃতির লাশ দেখে
আল্লাহর অসীম কুদরত জেনে সিজদায় মাথা নত হয়ে গেলো জাকারিয়ার। শুকরিয়া জানাল পিতা মাতাকে যারা কষ্ট করে তাকে পৃথিবীতে এনেছেন।

মিশরে দুইটা মাহফিলে অংশ নিয়ে মূল লক্ষ্য সুদানে চলে গেলো সে। অনেক প্রতিযোগী সেখানে ,জাকারিয়া আল্লাহর নাম নিয়ে মঞ্চে উঠে তিলাওয়াত শুরু করলো। হাজার হাজার মানুষ সরাসরি এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ টেলিভিশনে তাঁর তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হলো।

আন্তর্জাতিক হিফ্জ প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়ে এক বিরল সম্মানে ভূষিত হলো ছোট্ট একটি দেশের কোন এক নিভৃত পল্লী গাঁয়ের ছেলে জাকারিয়া! আনন্দে তাঁর দু'চোখ জলে ভরে গেলো। পিতা-মাতা তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন তাঁর কিছুটা পূরন হলো।

অসুস্থ বাবা এ সংবাদ শুনে নিশ্চই অনেক খুশি হবে। বাহরাইন, দুবাইতে অনুষ্ঠিত হিফ্জ প্রতিযোগীতায়ও অত্যন্ত সাফল্যের সাক্ষর রাখলো জাকারিয়া। দীর্ঘ তিন মাসের বিদেশ ভ্রমন শেষে এবার দেশে ফেরার পালা। কিন্তু জাকারিয়া জানে না তাঁর জন্য এক মহা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে বাড়িতে! .
.
ঢাকায় এসে এক মাহফিলে সংবর্ধনায় যোগ দেবার কথা কিন্তু যখন ওস্তাদের সঙ্গে দেখা করলো জাকারিয়া তখনই কেমন যেন সন্দেহ মনে উঁকি দিতে লাগলো। কেমন আছে বাড়িতে বাবা -মা? ওস্তাদ তাকে আগে বাড়িতে যেতে বললো কেন? ফোনে তো মায়ের সাথে চার পাঁচ দিন কথা হলো! "আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি" বললো মা, যদিও অসুস্থতার কারনে বাবার ফোনে কথা বলা নিষেধ, তাহলে? ওস্তাদ জাকারিয়াকে অনেক বুঝালো।

বিপদের সময় ধৈর্য্য ধারন করাই ইমানদারের বৈশিষ্ট্য।এলোমেলো ভাবতে ভাবতে দ্রুত ফিরে চললো সেই চিরচেনা মেঠোপথ ধরে তাঁর প্রিয় কুটিরের পানে। রাত নেমে গেছে অনেক আগেই।কেমন যেনো নীরব মনে হচ্ছে বাড়িটা।

ঘরে ঢুকেই দেখলো তাঁর বাবার বিছানাটা শূন্য পড়ে আছে। বুকের ভেতর থেকে হু হু কান্না উঠে আসতে লাগলো। ওদিকে তাঁর মা জায়নামাযে বসে বসে কাঁদছেন। ছেলেকে দেখে কান্নাটা আরও বেড়ে গেলো। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য! জাকারিয়া ভুলে গেলো তাঁর অর্জনের কথা।

অনেকক্ষণ কান্নার পরে মনটা হালকা হলো । কেঁদে তো আর লাভ হবে না। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে হবে বেশি বেশি। দোয়াই শুধু তাঁর নিকট পৌঁছাবে। জাকারিয়া এশার নামায পড়ে মন খুলে দোয়া করলো।
.
জাকারিয়া তাঁর মাকে দেখলো, এই কয়টা মাসেই অনেক শুকিয়ে গেছে। এতো বছরের সংসারের সুখ- দুঃখ , মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে গেছে। এতো প্রেম ভালোবাসা, মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে। নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে একটা মানুষকে।

ভালোবাসার মানুষটা অসুস্থ হলেও চোখের সামনে থাকলেই কি যে প্রশান্তি ! জাকারিয়া ছায়ার মতো মা'কে আগলে রাখতে লাগলো। জোর করে সব কাজ নিজ হাতে করে সে । মা'কে কোন কাজেই হাত দিতে দেয় না। মায়ের কাপড় ধোয়া, মশারি টাঙ্গানো সহ যাবতীয় কাজ জাকারিয়া করে দেয়। বাবা তো চলেই গেছে, মায়ের সেবা করা মানেই জান্নাতের নিকটবর্তী হওয়া। এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। পারলে সে মাকে নিজে খাইয়েও দেয়।
.
গভীর রাত। কান্নার শব্দে জাকারিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মৃদু শব্দে মায়ের গলা ভেসে আসছে " হে আল্লাহ, পরম দয়াময় , আমার স্বামীকে তুমি জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিও, ছেলেটাকে দ্বীনের পথে কবুল করে নিও" ।

এটাই তো প্রকৃত ভালোবাসা! কারও জন্য কল্যান কামনা করলে তো এভাবেই প্রভূর নিকট চাইতে হয়! এমন পিতা- মাতার ঘরে জন্ম নেয়ায় , জাকারিয়া প্রভূর নিকট শুকরিয়া জানালো।
.
সুখিপুর গ্রাম। যেনো সত্যিই সুখে ভরপুর। ভোরে যখন ফজরের সময় হয় তখন মাইকের শব্দ ভেসে আসে " গ্রামবাসী উঠুন, আর কত ঘুমাবেন? সামনে আপনাদের জন্য অসীম সময় অপেক্ষা করছে , তখন ঘুমাবেন। আর সেই ঘুমকে শান্তিময় করতে চাইলে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে চলে আসুন" ।

দলে দলে সব পুরুষ নামাযে চলে যায়। জাকারিয়া তাদের ইমাম। কন্ঠে মধু ঢেলে সে যখন এক একটি সূরা তিলাওয়াত করে তখন সবাই তন্ময় হয়ে শোনে সে পবিত্র কালাম। এ গ্রামে নারীরা পর্দা মেনে চলে, ফলে কেউই ইভটিজিং এর শিকার হয় না। কুরআনের আদেশ - নিষেধগুলো প্রত্যেক নামাযের পর আলোচনা হয় মসজিদে ফলে এখানে ইসলামের সঠিক আইন চলে।

এ কারনে এখানে রয়েছে আল্লাহ বিশেষ রহমত। জাকারিয়া তাঁর বিভিন্ন পুরস্কারের অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও একটি মাদ্রাসা।
.
দেখতে দেখতে বছর চলে যায়। মানুষের জীবন চলে তাঁর আপন গতিতে । মরিয়ম এখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। কবে আসবে সেই মহান প্রভূর ডাক আর সে মিলিত হবে তাঁর প্রিয় স্বামীর সঙ্গে। জাকারিয়াও বিয়ে করে সংসারি হয়েছে।

মরিয়ম ছেলে আর ছেলের বউয়ের কান্ড দেখে মনে মনে হাসেন। তাকে নিয়ে ওরা দুইজনে প্রতিযোগীতা করে। কার আগে কে তাঁর সেবা করতে পারবে! এশার নামায পড়ে এসেই জাকারিয়া মশারিটা টানিয়ে ফেলবে। বউ এসে মধুর ভাষায় বলবে

-- আপনাকে তো বলেছিলাম আম্মার মশারি প্রতিদিন আমিই টানাবো। আম্মা গোসল সেরে আসতে না আসতেই আপনি কাপড়টা ধুয়ে নিয়ে আসেন কেন? বলি, আমারও তো কিছু সওয়াব হাসিল করতে মন চায়! আপনার জন্য তো পারি না!

-- ইস! আমি তো সামান্য এটুকু করি। তুমি তো গোসল করাও, খাওয়াও, অযু করাও , ধরে ধরে ঘরে বাইরে নাও, তুমিই তো বেশি সওয়াব পাও।
মরিয়মের খুব ভালো লাগে ছেলে আর বউয়ের এসব মিষ্টি ঝগড়া।যেনো তাঁদেরই প্রতিচ্ছবি ! জাকারিয়া বাইরের কাজ শেষ করে ঘরে এসে এটা ওটা করতে থাকে। কাজটা সামান্য হলেও ওতেই জড়িয়ে থাকে অনেক ভালোবাসা। দুইজনে একসাথে খেতে বসে। একে অপরকে খাইয়ে দেয়।

এক জনের সামান্য কিছু হলে অপরজন অস্থির হয়ে ওঠে। চাহিদা খুব অল্প কিন্তু অল্পতেই খুব তৃপ্ত হয় জাকারিয়ার স্ত্রী। যে সংসারে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে মহব্বত আছে , অন্তরে আল্লাহ ভীতি আছে , সে সংসার স্বর্গতূল্য।
.
আনাসের ৮ম মৃত্যু বার্ষিকী। মরিয়ম রাতে সারারাত স্বামীর জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদেছে। সবাই ঘটা করে আত্মীয় স্বজনদের খাইয়ে মৃত্যুদিন পালন করে। এতে মৃত ব্যক্তির কোনই উপকার হয় না। নিকটজনদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।

তাই মরিয়ম আল্লাহর কাছে আনাসের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস চেয়েছে । সকাল হতেই সে কেমন যেনো অসুস্থ হয়ে গেলো। ডাক্তার ডাকা হলো কিন্তু মরিয়ম ততক্ষনে হাসতে হাসতে আনাসের কাছে পৌঁছে গেছে। এক গভীর বিষাদ নেমে এলো বাড়িটা জুড়ে।

জাকারিয়ার মাথার উপর থেকে ধ্বসে পড়লো আদরের ছাদখানা। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন বিপদে ধৈর্য্য ধারন করতে। মৃত মায়ের চেহারা হতে যেনো স্বর্গীয় আভা বের হচ্ছে। মুখে যেনো লেগে আছে এক টুকরো মিষ্টি হাসি। প্রভূর সাথে মিলনের এক মহা আনন্দের রেশ সমস্ত চেহারা জুড়ে। জাকারিয়া অস্থির হলো না, আল্লাহর কাছে কেঁদে দোয়া করছে সে "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাাগিরা"।

মায়ের কবরে মাটি দিয়ে এসে ২বছরের শিশু পূত্রকে নিয়ে মসজিদের পানে ছুটলো সে। তাঁর বাবার স্বপ্ন সফল হয়েছে। দেশ বিদেশের আলেম সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি এখন সে। সেই একই স্বপ্নটা নিজের ছেলের মাঝেও সঞ্চারিত করে দিতে চায় সে।

যে পরিবারে, যে সমাজে ধর্ম সঠিকভাবে পালন করা হয় সেখানে থাকে না কোন অশান্তি। সেখানে এক স্বর্গীয় পরিবেশ বিরাজ করে, সেই স্বর্গ থেকে নিজের সন্তানকে বঞ্চিত করবে না সে।
লেখা: মোহসিনা বেগম(MohasinaBegum)
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এম.জে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে