শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:২৪:০৪

ফ্রেমবন্দি ভালবাসা

ফ্রেমবন্দি ভালবাসা

লেখকঃ নিলয় আহসান নিশো
..
..
(১)
..
...
প্রতিটা ভোরে মেয়েটি ঘুম ভেঙে দেখে ছেলেটি তাকে জড়িয়ে আছে। তাকে জড়িয়ে রাখা হাতকে মেয়েটি পরম ভালবাসায় বুকে নিয়ে রাখে। ছেলেটি তার আরও কাছে চলে আসে। এতোটাই কাছে যে মেয়েটি তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট বুঝতে পারে। ছেলেটির দিকে মুখ ফেরাতেই দেখে সে তাকিয়ে আছে। আর ছেলেটিও সুযোগ বুঝে মেয়েটির বুকে মুখ লুকিয়ে চুপ করে থাকে।
.
মেয়েটি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে
.
ঘুম ভেঙেছে কখন?
.
তুমি যখন হাতে হাত রেখেছো তখন।
.
মুখ লুকিয়ে আছো যে?
.
তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকতে ভাললাগে।
.
আমাকে যে এখন উঠতে হবে।
.
তখন ছেলেটি মেয়েটিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে
.
না, উঠতে দিবো না।
.
তখন মেয়েটি বলে
.
পাগলামি করো না সোনা। কাজ আছে আমার। উঠতে হবে এখন।
.
তখন ছেলেটি কপট রাগ দেখিয়ে বলে
.
সব কিছু বাদ। আমার কাছে থাকতে হবে তোমার। যতক্ষণ আমি চাইবো।
.
তখন  ছেলেটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে মেয়েটি বলে
উঠবো না আমি। তোমাকে বুকে নিয়েই থাকবো...
..
...
(২)
..
...
আমাদের বিয়েটা এরেঞ্জ মেরেজ হয়েছিল।
রক্ষণশীল পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় বিয়ের আগে প্রেম করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
পরে জেনেছিলাম তুমিও বিয়ের আগে প্রেম করো নি। তোমার নাকি বউয়ের সাথে প্রেম করার ইচ্ছা ছিল ছোট বেলা থেকেই।
..
...
বিয়ের প্রথম রাতে বলেছিলাম "আমরা তো দুজনেই দুজনার অপরিচিত। দুজনকে চিনে নিতে তো আমাদের কিছুদিন সময় লাগবেই।আমাকে সেই সময়টুকু দিলে ভাল হয়,
তুমি সেই সময়টুকু আমাকে দিয়েছিলে।শুধু বলেছিলে তোমার পরিবার কে দেখে রাখতে। তাদের ভালবাসতে। তোমার নিজের জন্য কোন চাওয়া ছিল না আমার কাছে।
আমি সেদিন কিছু মানুষের কথা ভাবছিলাম। যারা আমাকে বলেছিল,পুরুষ মানুষ ক্ষুধার্ত বাঘের মতো হয়।আমি অবাক হয়ে তোমাকে দেখছিলাম। ভাবছিলাম,এরকম পুরুষও আছে দুনিয়াতে!
..
...
বাসর রাতেই তোমার প্রেমের ঘোরে পড়লাম, যত দিন যাচ্ছিল তোমার প্রেমের সাগরের অতলে ডুবেই যাচ্ছিলাম।তোমাকে যত দেখছিলাম তোমার প্রতি মুগ্ধতা ততই বাড়ছিলো। কোন ভাবেই তোমাকে ভাল না বেসে থাকা যায় না...
শেষে নিজে থেকেই তোমাকে আপন করে নিতে হল...
.
:যাবে আমার সাথে?(আমি)
:কোথায়?(তুমি)
:আমাকে নিয়ে সমুদ্রে বেড়াতে?(আমি)
:তুমি রাজি থাকলে হানিমুনেই যাই(তুমি)
.
আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম....
..
...
৩দিন পর অফিস থেকে হানিমুনের ছুটি নিয়ে আমাকে নিয়ে কক্সবাজার গেলে। আমার ইচ্ছা পুরনে...
আর আমিও তোমাকে ভালবাসি বলার আর ভালবাসা দেবার জন্য এটা চেয়েছিলাম...
কক্সবাজারেই আমাদের বাসর ঘর সাজিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছিলাম....
সেই রাতের কথা তুমি আর আমি কেউ কখনোই ভুলবো না...
..
...
পরদিন গোধুলীবেলায় তোমার হাতে আমার হাত ,তোমার কাঁধে আমার মাথা রেখে তোমার পায়ে তাল মিলিয়ে আমিও তোমার সাথে হাটছিলাম সমুদ্রতটে, তুমি যেমন হাঁটো।
.
অনেকক্ষন হাঁটার পরে আমি ক্লান্ত হয়ে যখন বালুচরে বসে পড়ি ,ঠিক সেই সময় সমুদ্রের এক রাশি দুষ্টু ঢেউ এসে আমার গায়ে আছড়ে পড়ে। আমি তখন লজ্জায়, অস্বস্তিতে তোমার দিকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আমার সর্বাঙ্গ যে ভেজা শাড়ীতে জড়িয়ে গেছে। কিভাবে তাঁকাই তোমার দিকে!
তুমি তখন আমাকে তোমার দিকে ঘুরিয়ে বললে,
নিরুপমা,
লজ্জা পাচ্ছো কেন? আমিই তো। তোমার আমি। আমাকে দেখে লজ্জার কি আছে?
তোমার অভয় পেয়ে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি
.
"আমার লজ্জা আমার ভয়
তুমি বুঝলেই আমার সয়"
.
তখন তুমি মিষ্টি হেসে আমার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে  বললে
.
"চলো হাঁটি নিরুপমা....
.
তুমি জানো না, তুমি যতবার আমার নাম টা ধরে ডাকো ততবার আমি স্রষ্টার শুকরিয়া করি আমার এত সুন্দর মনের একজন জীবন সঙী দেবার জন্য। যার মুখে আমার নাম টা শুনে মুগ্ধতায় ভরে যায় আমার দেহ মন আত্বা।
..
...
(৩)
..
...
খুব সকালে সদ্য স্নান সেরে বেরিয়ে এসে দেখি তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভেজা তোয়ালে টা চেয়ারে রেখে আমি তোমার পাশে এসে বসলাম। প্রতিদিনের মতো তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। আর তুমি,তুমি আরেকটু আরাম করে ঘুমুচ্ছো।আমি মৃদু হেসে তোমার কপালে আলতো করে চুমু দিলাম।ঠিক তখনি আমার অবাধ্য ভেজা চুলগুলো তোমার মুখে এসে পড়লো।চুলের পানি লেগে তোমার ঘুম ভেঙে যায়।আমাকে তুমি এতটাই কাছে আবিষ্কার করলে যতটা কাছে এলে দুজনের নিঃশ্বাস এক হয়ে যায়।
..
...
আমি জানতাম,
আমাকে শাড়ি পড়া দেখলে তুমি অনেক খুশি হও।কিন্তু আমি সপ্তাহ জুড়ে কার জন্য শাড়ি পড়বো? তুমিতো বাসায়ই থাকো না।তাই আমি ঠিক করেছিলাম আমি তোমার প্রতিটা ছুটির দিনে শাড়ি পড়বো।
সেইবার ছুটির দিনে দুপুরে যখন কোমরে শাড়ির অাঁচল গুজে আমি রান্না করছিলাম,তুমি তখন আমার পাশে এসে দাঁড়ালে।দেখলে বেখেয়ালে আমার হাতে গরম তেলের ছিটে লেগে ফোসকা পড়ে গেছে।আমাকে তোমার দিকে ঘুরিয়ে বললে
"শুধু রান্না করলেই হবে নাকি নিজের খেয়ালও রাখতে হবে"
আমি তখন তোমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
"তুমিতো আছো,আমার খেয়াল রাখতে"
.
তুমি তখন আমাকে তোমার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে ভালবাসার চিহ্ন একে দিলে। তুমি জানো না নিলয়, তোমার বুকে থাকতে কি শান্তি লাগে আমার....
আমার পরম শান্তির যায়গা তোমার বুকটা।
..
...
সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লো।গোধুলী বেলাও শুরু হয়ে গেল।কি অপরুপ দৃশ্য আবির রাঙা গোধুলীবেলার। তুমি আমি মিলে আমাদের ছোট্ট বেলকোনিতে বসে মুড়ি মাখা আর তোমার পছন্দমত দেড় চামচ চিনি দিয়ে চা খাচ্ছিলে। তুমি একটু অন্যমনস্ক হতেই আমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম । তুমি বুঝতে পেরেও কিছু বলছিলে না। শুধু হাসতে হাসতে আমাকে তোমার কোলে বসিয়ে নিলে বললে,
"তুমি এক চুমুক আর আমি এক চুমুক খাবো... তুমি আমাকে খাইয়ে দিবা আর আমি তোমাকে"
আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলাম। তুমি তখনি আমার কপালে চুমু এঁকে দিলে.... আমি তোমার গলা জড়িয়ে ধরলাম...
..
...
প্রতিটা রাতেই ঘুমুতে যাওয়ার সময় তুমি আমাকে ডাকতে। কোনদিন আমি তোমার এক ডাকেই চলে আসতাম। আর কোনদিন বলতাম "তুমি শুয়ে পড়ো, আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি"।
তুমি তখন প্রচন্ড অভিমানে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকতে।আমি কিছুক্ষণ পর এসে বিছানায় বসলেও তুমি আমার দিকে মুখ ফেরাতে না।
তোমার সেই অভিমানটা ভাঙাতে হতো আমার ভালবাসা দিয়ে।
..
...
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখলে আমি তোমার পাশে নেই।
উঠে এলে,দেখলে আমি বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার কাধে চুমু দিয়ে বললে,
হঠাৎ করে তোমায় জড়িয়ে ধরলাম,ভয় পেলে না যে?
.
তোমার এই স্পর্শ যে আমার খুব চেনা তাই ভয় পাই নি।
.
একা একাই পূর্ণিমা দেখছো।আমায় ডাকলে না কেন?
.
তুমিতো গভীর ঘুমে ছিলে।তাই ডাকিনি।
.
তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে না ধরে থাকলে যে আমার ঘুম হয় না।তাইতো উঠে এলাম।
.
তখন আমি তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
সারাজীবন এভাবেই তোমার বুকে জড়িয়ে রাখবে তো আমায়?
.
তোমার দুহাতের মধ্যে আমার মুখ টা নিয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললে,
সারাজীবন ই রাখবো তোমায় নিরুপমা...
..
...
(৪)
..
...
আয়নাতে নিজেকে দেখছি আর তোমার কথা ভাবছি।
.
সেদিন হঠাৎ করেই তুমি আমার প্রশংসা করা শুরু করলে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললে,
.
নিরুপমা,
.
তোমার কাজল কালো টানা টানা চোখ ২টো অনেক সুন্দর। ঠিক যেমনটি আমি
খুঁজেছি।
.
আমার সেদিন অবাক হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।। কারণ কথা গুলো আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলো।
.
ভাবতে ভাবতেই চোখের কোনে জল চলে এলো।
.
চোখটা মুছে ফের আয়নার দিকে তাকাতেই আমি আমার পাশে তোমাকে দেখতে পেলাম।তুমি তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ২ লাইন কবিতা বললে
.
"প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখেই দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ "
.
লাইন ২টো শুনে আমি চমকে গেলাম। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি যে বিষয়টা নিয়ে ভাবছি সেই বিষয়টা তুমি জানলে কি করে।

কিন্তু তুমি যখন এগিয়ে এসে আমাকে তোমার বুকে জড়িয়ে নিলে তখন বুঝতে পারলাম।

খাঁটি ভালবাসা বুঝি এমনি হয়।। একে অপরের মনের কথা বুঝতে পারে
..
...
অদ্ভুত বাঁধনে বেঁধে রেখেছো আমায়।নিদ্রায় জাগরণে শুধু তুমিই আছো।তোমার গায়ের গন্ধটা আজও নাকে লেগে আছে।আজও মাঝে মাঝে তোমার স্পর্শ আমার শরীরে অনুভূত হয়।মনে পড়ে যায় আমায় প্রথম ছুঁয়ে দেওয়ার কথা। সেদিন সকালে যখন গুনগুন করে গান গাইছিলাম "একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি"
তখন তুমি বলেছিলে,আজকের সকাল টা আমাদের জীবনে না এলে তো বুঝতামই না তুমি এত ভাল গান গাও।
কি লজ্জাটাইনা আমি পেয়েছিলাম সেদিন।
তুমি তখন আমায় আদর করে বলেছিলে,আমি প্রতিটা সকালে ঘুম ভেঙে তোমার এই লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে চাই।
..
...
(৫)
..
...
আমিতো তোমার থেকে কয়েকটা দিন দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। সারাজীবন তো দূরে থাকতে চাইনি। তবে তুমি কেন আমায় ছেড়ে দূরে চলে গেলে?
আমিতো চলে যেতে পারছিনা।
তুমি তো স্বার্থপরের মতো চলেই গেছো। আমি চলে গেলে তোমার পরিবারকে কে দেখে রাখবে,কে ভালবাসবে?
.
কে আব্বুর প্রেসার মেপে সঠিক সময় ওষুধ টা দিবে, কে আম্মুর জায়নামাজ টা বিছিয়ে রাখবে, কে আম্মু কে সময় মত খাওয়াই দিবে?
আমি তো তোমার মত করে স্বার্থপর হতে পারি না।আম্মু কে ছাড়া যে আমার চলেই না।
শুভর সাথে দুষ্টুমি না করলে তো দিন টা পুর্নই হয় না আমার...
স্কুল থেকে ফিরেই শুভর বাসার দরজায় এসে প্রথম ডাক টা হল,
চাচীমনিইইইইই, কই তুমি???
তারপর এসে তাকে কোলে বসিয়ে আদর করে তারপর ইউনিফর্ম খুলবে....
এত ভালবাসা রেখে কিভাবে যাই বলো?
যাই বলো তাই বলো...
আমি পারবো না.....
..
...
জানো,
তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর অনেকেই বলছিল আমায়, মাত্রতো কয়েকটা দিন গেছে। সব ভুলে যাবে।
আমি শুধু বলেছিলাম,ভালবাসতে কয়েক বছর লাগে না। কয়েকটা মুহুর্তই যথেষ্ট। মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে নাইবা বাঁচতে পারলাম,স্মৃতিগুলো নিয়েই থাকবো।
সেদিন রুমে দরজা লাগিয়ে অনেক কেঁদেছিলাম। তোমার ছবির ফ্রেমটা হাতে নিয়ে বলেছিলাম, ওরা কেন বুঝে না তুমি আমার সাথে মিশে আছো। তোমার মত আর কেউ হবে না। আমি আর কোন পুরুষকে চাইনা আমার জীবনে।
আমি আজও তোমার ছবির ফ্রেমটা বুকে চেপে ধরে কাঁদি। শুধু একটাই নালিশ আমার তোমার কাছে
.
"তুমি কেন ফ্রেমে বন্দী হয়ে গেলে?"
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে