শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮, ০২:২৫:০৭

'খেলনা বিক্রি না হলে খাব কী?'

'খেলনা বিক্রি না হলে খাব কী?'

হায়দার আলী, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। দুপুর দেড়টায় ক্লাসে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়টির পাশেই প্লাস্টিকের চটে বসে আছেন অশীতিপর এক বৃদ্ধ। চটের সামনেই সারিবদ্ধভাবে সাজানো মাটির তৈরি হরেক রকম খেলনা।

স্কুলভবনে থাকা শিক্ষার্থীদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, 'মুখ ফুটে বলতে পারেন না আমি খুব কষ্টে আছি। দুটো জিনিস কিনে নিয়ে যাও, তোমরা কিনলেই আমার দুমুঠো ভাতের জোগাড় হবে'। বৃদ্ধার চোখের চাহনিতে কি এক তীব্র আকুতি!

সকাল গড়িয়ে দুপুরও শেষ হচ্ছে। কিন্তু বিক্রি হয়নি তাঁর কোন খেলনা। খেলনা বিক্রি করতে না পারলে যে তাঁর মুখে আহার জুটবে না। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই যেন দুশ্চিন্তার বাজ পড়ছে চেহারায়। গত বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় ৯২ বছরের বৃদ্ধর এমন দৃশ্য দেখে থমকে যায় এ প্রতিবেদক। একটু সামনে এগিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করেই ছবির জন্য দুটি ক্লিক, কিছুই বলছেন না তিনি শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।

বয়স্কভাতার কার্ড পেতেই ঘুষ লাগে, তাই সেই 'সোনার হরিণ' পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি ৯২ বছরের এই বৃদ্ধের

এ প্রতিবেদক নিজ পরিচয় দিয়ে কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি নরেশ পাল। থাকেন সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পালপাড়ায়। দুই পুত্র এবং তিন কন্যার জনক নরেশ পাল। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনই কোনো স্থানে ছুটে যান মাটির তৈরি খেলনা বিক্রি করতে।

কখনো টাঙ্গাইল রেল ষ্টেশন কিংবা সুরুজ বাজার। কখনো আশপাশের ইউনিয়নের বিভিন্ন স্কুলের পাশে। নিজ বাড়ি পালপাড়া থেকে প্রতিদিনই মাথায় মাটির খেলনা ঝাপি নিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে হেঁটেই যান দূর-দূরান্তে। এমন বয়সে যার হাঁটা চলাই কঠিন, সেখানে নরেশ পাল তিনবেলা মুখের আহার জোটাতে স্কুলে-স্কুলে, ষ্টেশন আর বাজার ঘুরে বিক্রি করেন খেলনা।

খেলনা বিক্রির টাকায় তাদের পরিবারের খাবার জোটে। নরেশ পাল কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, 'বাপুরে, এগুলো বিক্রি না করলে খাব কী? কয়েকশত বছর আগের পেশা, এটা বিক্রি করেই আমাদের পেট চলে। সকালে ঘারিন্দা স্কুলের মাঠে এসেছি, এখন পর্যন্ত কোনো খেলনা বিক্রি হয়নি'।

এ কথা বলতে বলতেই দুটো চোখ ছলছল করে উঠে নরেশ পালের। শুধু মাথা নেড়ে জানান, বিক্রি হয়নি একটিও। এ প্রতিবেদক কিছু খেলনা কিনতে চাইলে খুশিতে সেই ভেজা চোখখানিই যেন চকচক করে উঠে। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ওই গ্রামের রাজন মিয়া বলেন, 'এমন বয়স্ক লোক এতদূর থেকে এসে মাটির খেলনা বিক্রি করতে দেখে আমাদেরও খারাপ লাগে। সরকার কি এদের জন্য কিছু করতে পারে না।

আপনি কি বয়স্ক ভাতা পান না? জবাবে রেশ পাল বলেন, 'বয়স্ক ভাতার জন্য কয়েকবার গালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল, কিন্তু তাকে কার্ড দেয়া হয়নি। কেন দেয়া হয়নি জানতেই চাইলে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা যুবক গোপাল চন্দ্র পাল বলেন, 'টাকা ছাড়া কোনো কার্ডই পাওয়া যায় না, বয়স্কভাতা আর বিধাব কিংবা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পেতে এখন ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা লাগে। এমন কথোপকথনের সাঁয় দেন নরেশ পাল। টাকাও নেই, কার্ডও জুটে না নরেশ পালের কপালে।

পরের দিন শুক্রবার খুব ভোরে সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলে প্রহলাত পালের সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র বানানোর কাজে ব্যস্ত বৃদ্ধ নরেশ পাল। আর বাড়ির উঠানে নরেশ পালের স্ত্রী মিলন পাল কাদামাটি নিয়ে হাড়ি পাতিল বানানোর কাজে ব্যস্ত। মিলন পাল বলেন, 'মাটির জিনিস বানাই, না বানাইলে খামু কী? কেউ তো আমাদের খাবার এনে দিবে না'।

দুই সপ্তাহ পরই বৈশাখের মেলা, বিভিন্ন এলাকায় মেলায় বিক্রি হবে এসব জিনিসপত্র, যত বেশি বিক্রি তত বেশি ভালো থাকবেন তারা। তাইতো ঘরের আশপাশে শুধুই মাটির তৈরির জিনিস বানানোর ধুম লেগেছে।

ছেলের বউ সন্ধ্যা রানী বলেন, 'কষ্টের সংসার। নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধ শ্বশুরকে এসব বিক্রি করতে পাঠান। একদিকে স্বামী বিক্রি করেন, অন্যদিকে শ্বশুর বিক্রি করে মাটির তৈরি খেলনা। এটা বিক্রি করেই আমাদের পেট চলে। প্রায় প্রতিদিনই খেলনা নিয়ে বিভিন্ন স্কুল ও হাট বাজারে যান খেলনা বিক্রি করতে। আমাদের টাকা পয়সা থাকতে তো আর উনাকে এমন কষ্ট করতে হতো না।-কালের কণ্ঠ
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে