রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০, ০৯:৪৮:৩২

বাদশার আ'হা'জা'রি

বাদশার আ'হা'জা'রি

গাইবান্ধা: ‘লাইন চালু রেখেই ১১ হাজার ভো'ল্টে'র বি'দ্যুতের তা'রের সং'যো'গ লা'গাতে বলা হয়। বারবার বলেছি লাইন ব'ন্ধ করেন। ঠিকাদার বললেন কাজ ক'রো। চা'পের মুখে সংযো'গ স্থাপনের জন্য ১১ হাজার ভোল্টের বি'দ্যুতের তা'রে হা'ত দিই। স'ঙ্গে স'ঙ্গে বি'দ্যুৎস্পৃ'ষ্ট হয়ে খুঁ'টিতে ঝু'লে যাই। ঝু'লে থাকা অব'স্থায় ঠিকাদার পা'লিয়ে যান। পরে বি'দ্যুতের সংযো'গ ব'ন্ধ করে আমাকে উ'দ্ধার করা হয়। কিন্তু ত'তক্ষ'ণে সব শেষ। প্রাণে বাঁ'চলেও দুই হাত কে'টে ফে'লতে হয় আমার। এখন প্র'তিব'ন্ধী হয়ে বেঁ'চে আছি। ঠিকাদারের ভু'লে চি'রত'রে প'ঙ্গু হয়ে গেলাম আমি।’

পল্লী বি'দ্যুতের কাজ করতে গিয়ে প'ঙ্গু হওয়ার নির্ম'ম ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চন্দনপাঠ গ্রামের যুবক বাদশা মিয়া। ঠিকাদারের হয়ে পল্লী বি'দ্যুতের কাজ করতে গিয়ে প'ঙ্গু হন তিনি। সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে কেঁ'দে ফেলেন বাদশা মিয়া।

২০০৯ সালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন বাদশা। ২০১১ সালে এমএ মোত্তালিব টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ২০১৩ সালে তার মা ফেলানী বেগম মা'রা যান। মা হা'রানোর শো'ক বুকে নিয়ে অনেক ক'ষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে বোনারপাড়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন তিনি।

বাবা মোসলেম উদ্দিন রংপুর সুগার মিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে বাদশা মেজো। বড় ভাই মোহাম্মদ আলী বিজিবিতে কর্মরত। ছোট ভাই মেহেদী হাসান লেখাপড়া করছেন। স্ব'প্ন ছিল লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরি করে বড় ভাইয়ের পাশাপাশি সংসারের হাল ধ'রবেন। এরই মধ্যে পাশের গ্রামের উর্মি আক্তারকে বিয়ে করেন বাদশা।

বিয়ের ছয় মাস না যেতেই অধিক বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলেন প্রতিবেশী পল্লী বি'দ্যুতের ঠিকাদার সোহরাব এন্টারপ্রাইজের মালিক মোখলেছুর রহমান। পল্লী বি'দ্যুতের কাজে বাদশাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার বিটঘর কাইতলা এলাকায় নিয়ে যান মোখলেছুর রহমান। কি কাজ করতে হবে কোনো ধা'রণা না দিয়েই বাদশাকে পল্লী বি'দ্যুতের কাজ করতে বলা হয়। এরপর জীবিকার তাগিদে পল্লী বি'দ্যুতের কাজ শুরু করেন তিনি।

নেই কোনো অভি'জ্ঞতা, নেই দ'ক্ষতা। ঠিকাদার যেভাবে বলেন সেভাবে বি'দ্যুতের কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে বি'দ্যুতের সং'যোগ ব'ন্ধ আছে কি-না জানতে চাইলে ঠিকাদার গা'লিগা'লাজ করেন। কাজ করতে গিয়ে বাদশা বুঝে গেছেন ঠিকাদারের কাছে কর্মীদের জীবনের কোনো মূল্য নেই।

১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের সং'যোগ বন্ধ না করেই নতুন সং'যোগ স্থাপনের কাজ করতে হয় বাদশাকে। দু'র্ঘট'নার দিন বি'দ্যুতের খুঁ'টিতে উঠে বাদশা বারবার ঠিকাদার মোখলেছুর রহমান ও অন্যদের বলেছেন সং'যোগ ব'ন্ধ কি-না। এ সময় ঠিকাদার রে'গে গিয়ে বলেন লাইন ব'ন্ধ, কাজ করো। এত ভ'য় কিসের। টাকা কি এমনি এমনি দেব।

ঠিকাদারের চা'পের মুখে নতুন সং'যোগ স্থাপনের জন্য ১১ হাজার ভোল্টের বি'দ্যুতের তারে হাত দেয়ার স'ঙ্গে স'ঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃ'ষ্ট হয়ে খুঁ'টিতে ঝু'লতে থাকেন বাদশা। ঝু'লে থাকা বাদশাকে ফেলে ঠিকাদার ও তার লোকজন ঘটনাস্থ'ল থেকে পা'লিয়ে যান। পরে বি'দ্যুতের লাইন ব'ন্ধ করে বাদশাকে উ'দ্ধার করেন স্থানীয়রা। কিন্তু ত'তক্ষণে বড় ক্ষ'তি হয়ে যায় বাদশার। প্রা'ণে বাঁ'চলেও দুই হাত কে'টে ফেলতে হয় তার। এখন প্রতিব'ন্ধী হয়ে বেঁ'চে আছেন তিনি। ঠিকাদারের খা'মখে'য়ালিপনায় এমন ঘ'টনা ঘ'টেছে বলে অভি'যো'গ বাদশার।

নিজের সঙ্গে ঘ'টে যাওয়া সেদিনের ঘটনার কথা মনে করে কেঁ'দে ফেলেন বাদশা মিয়া। কেঁ'দে কেঁ'দে তিনি বলেন, ঠিকাদার কোনো ধ'রনের প্রশিক্ষণ ছা'ড়াই আমাদের দিয়ে বি'দ্যুতের কাজ করান। লাইন চালু রেখে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুতের তার খোলা ও সং'যোগের কাজ করতে বলা হয়। সেদিন বারবার বলেছি লাইন বন্ধ কি-না। ঠিকাদার কোনোভাবেই আমার কথা কানে নেননি। যদি সেদিন কথা কানে নিতেন তাহলে আমার এই অব'স্থা হতো না। নিজের স্বা'র্থ হাসিলের জন্য আমাদের মতো কর্মীদের দিয়ে ঝুঁ'কিপূ'র্ণ কাজগুলো করান ঠিকাদার। আমি এখন অস'হায়, প্র'তিব'ন্ধী হয়ে বেঁ'চে আছি। আমার চলাফেরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। ঠিকাদারের ভু'লে চিরতরে প'ঙ্গু হয়ে গেলাম। এ নিয়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভি'যোগ দিয়েও কোনো সমাধান পাইনি।

তিনি বলেন, পিপাসা লাগলে এক গ্লাস পানি নিজ হাতে খেতে পারি না। কেউ খাইয়ে না দিলে না খেয়ে থাকতে হয়। বাবা আছেন তার সমস্যা নিয়ে। বাবা নিজেই চলতে পারেন না আমাকে কীভাবে চালাবেন। সংসারে এখন আমি সবার বোঝা হয়ে গেছি। বাড়ির সব কাজ স্ত্রী করে দেয়। অনেক সময় বির'ক্ত হয়ে রা'গারা'গি করে বাপের বাড়ি চলে যায়। প্র'স্রাব-পা'য়খানা করে পানি নিতে পারি না। ভাই কিংবা স্ত্রী অথবা অন্যের সাহায্যে আমাকে চলতে হয়।

বাদশা মিয়ার বাবা মোসলেম উদ্দিন বলেন, ঠিকাদার মোখলেছুর রহমানের খামখেয়ালিপনায় আমার ছেলে প'ঙ্গু হয়ে গেছে। কোনো ক্ষ'তিপূ'রণ না দিয়ে এখন হু'মকি-ধা'মকি দিচ্ছেন মোখলেছুর রহমান। তার ভ'য়ে অস'হায় জীবনযাপন করছি আমরা। আমি এ ঘটনার উপ'যুক্ত বিচার চাই।

বাদশা মিয়ার স্ত্রী উর্মি আক্তার বলেন, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় পল্লী বিদ্যুতের কাজে গিয়ে আমার স্বামী প'ঙ্গু হয়ে যায়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি প্রতিব'ন্ধী হওয়ায় দিশেহা'রা আমরা। অনেক কষ্টে সংসার চলে আমার। ক্ষ'তিপূ'রণ চাইলে আমাদের ভ'য়ভী'তি দেখান ঠিকাদার। এত বড় ক্ষ'তির পরও আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি ঠিকাদার কিংবা পল্লী বি'দ্যুৎ। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। আমি অন্তঃস'ত্ত্বা। আমরা কোথায় যাব, কি করব, কীভাবে চলবে আমাদের সংসার তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আমার স্বামীর এ অবস্থার জন্য যারা দা'য়ী তাদের শাস্তি চাই। একই সঙ্গে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনু'রোধ জানাই।

বাদশা মিয়ার সহকর্মী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাঘাটা উপজেলার কামালের পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমি সেদিন বাদশা মিয়াকে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি তুলে দেই। বাদশা ও আমি একাধিকবার বলার পরও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করেননি ঠিকাদার ও সুপারভাইজার। সেদিন আমাদের জোর করে বিদ্যুতের খুঁ'টিতে তুলে দেন ঠিকাদার। বিদ্যুতের লাইন বন্ধ না করে কাজ করতে বাধ্য করার ফলে দুর্ঘ'টনায় দুই হাত হা'রান বাদশা।’

বাদশা মিয়ার মতো একই অবস্থা সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের চন্দনপাঠ গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম, বাবুল ইসলাম ও আব্দুল হাইসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির। ঠিকাদারের হয়ে পল্লী বিদ্যু'তের কাজ করতে গিয়ে প'ঙ্গু হয়েছেন তারা। জাহিদুল ইসলাম বলেন, পল্লী বি'দ্যুতের ঠিকাদার মোখলেছুর রহমানের অব'হেলায় আজ আমি প'ঙ্গু। সংসারের বো'ঝা হয়ে আমাকে জীবনযাপন করতে হয়। এত বড় ক্ষ'তির পরও কোনো ধরনের সহায়তা দেননি ঠিকাদার।

এ বিষয়ে মেসার্স সোহরাব এন্টারপ্রাইজের মালিক ঠিকাদার মোখলেছুর রহমান বলেন, বাদশার বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করা হবে। তবে দু'র্ঘটনার দিন বিদ্যুতের লাইন ব'ন্ধ না করার জন্য ঠিকাদার দায়ী নন। ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত সুপারভাইজার ও শ্রমিক সর্দারের বিষয়টি দেখার কথা ছিল। ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত সুপারভাইজার মাহিদুল ইসলাম বলেন, সেদিন ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না। পরে শুনেছি বাদশা দুর্ঘ'টনার শি'কার হয়েছেন।

শ্রমিক সর্দার সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা লাইন ব'ন্ধ করার অবেদন দিয়ে কাজ শুরু করেছি। কাজ চলা অবস্থায় দুর্ঘ'টনা ঘটেছে। বিষয়টি মীমাংসার জন্য একাধিকবার সালিশ-বৈঠক করলেও কোনো সমাধান হয়নি। ঠিকাদার বিষয়টি মীমাংসা করছেন না।

সাঘাটার কচুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. গোলজার রহমান বলেন, আমার ওয়ার্ডে হাত-পা হারানো ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। এদের অধিকাংশই পল্লী বিদ্যুতের কাজে গিয়ে দুর্ঘ'টনায় পড়ে হা-পা হা'রিয়েছেন। এখন প্রতিবন্ধী হয়ে দিন কা'টছে তাদের। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন দুর্ঘ'টনায় না পড়ে সে বিষয়ে পদক্ষে'প নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানাই। একই সঙ্গে অভি'যুক্ত ঠিকাদারের বিরু'দ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।

অভি'জ্ঞতা ছাড়া ঠি'কাদারের লোকজন বি'দ্যুতের কাজ করতে পারবে কি-না জানতে চাইলে গাইবান্ধা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বোনারপাড়া জোনাল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আব্দুল হালিম বলেন, আমরা পল্লী বিদ্যুতের যেকোনো কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারদের দেই। নতুন সং'যোগ বা ট্রান্সফরমার পরিবর্তনের জন্য পল্লী বিদ্যুতের নির্দিষ্ট ফরমের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। নিয়মবহি'র্ভূতভাবে কাজ করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘ'টনা ঘটলে তার জন্য ঠিকাদার দায়ী থাকবেন। যেহেতু টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেয়া হয় সেহেতু দু'র্ঘটনার দা'য় নেবে না পল্লী বিদ্যুৎ।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে