রাজাপুর (ঝালকাঠি) : গত এক মাসে শিশু সন্তানদের কোনো চাহিদাই পূরণ করতে পারেননি সগির হাওলাদার। আড়াই বছর বয়সী শিশু সানজিদা প্রতি রাতে অপেক্ষায় থাকে বাবার জন্য। বাবা তাঁর জন্য কি নিয়ে আসবে? কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে তাকে আশাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, ছোট দুই ভাই ও এক কন্যা সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল সগিরের। কিন্তু গত দুই মাস ধরে পরিবারের সবার মুখে খাবার তুলে দিতেই সগির ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। বলছিলাম ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার পূর্ব আঙ্গারিয়া গ্রামের ত্রিশ বছরের যুবক সগির হাওলাদারের কথা। তিনি পেশায় একজন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক। পুরো শীত মৌসুমে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও ঝালকাঠির জেলার প্রায় ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে উন্নয়ন কাজের জন্য তৈরি হওয়া ধুলার কারণে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে যাত্রী না থাকায় সগিরের এই দুরাবস্থা।
সম্প্রতি সগির হাওলাদারের মুখে এমন দুরাবস্থার কথা শুনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথার সত্যতা পাওয়া গেল আরো করুণভাবে। সগিরের বৃদ্ধা মা মনোয়ারা বেগমের চাহিদা ছিল একটু সরিষা তেলের। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শিশু সন্তান ও বৃদ্ধা মায়ের শরীরে রুক্ষতার চিহ্ন স্পষ্ট। ঘরে তেল না থাকার কারণেই এই অবস্থা বলে জানান সগিরের স্ত্রী রেহানা আক্তার। তিনি বলেন, ‘যেখানে পেটে ভাত জোটে না সেখানে আবার তেল’ কথাগুলো বলার সময় চোখ ছল ছল করছিল তাঁর।
সগির হাওলাদার বলেন, ‘শীত আসার আগে প্রতিদিন ৭০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারতাম। সংসারে সবার সব চাহিদা পূরণ হত তাতে। বাচ্চার খাবার, বাবা-মায়ের ওষুধ, ভাইদের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চলে যেত। কিন্তু গত দুই মাস ধরে কারো কোনো চাহিদাই পূরণ করতে পারছি না।’
শুধু সগির নয়, তাঁর মতো এমন মানবেতর সময় পার করছেন উপজেলার তিন সহাস্রাধিক ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলচালক। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করা সগিরের মতো দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষাধিক মোটরসাইকেলচালক রয়েছেন। এদের মধ্যে যারা একটু স্বচ্ছল তারা পৌষ-মাঘ মোটরসাইকেল না চালালেও অস্বচ্ছলরা পেটের দায়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের অনেকেই কিস্তিতে মোটরসাইকেল কিনেছেন। তাই ঠাণ্ডা ও সংস্কার কাজ চলা সড়কের প্রচণ্ড ধুলা উপেক্ষা করেই তারা বাসষ্ট্যান্ডে ভীড় করছেন।
উপজেলার বাইপাস মোড়ে গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় দেখা গেল ২৫-৩০ জন মোটরসাইকেলচালক যাত্রীর আশায় বসে আছেন। শাকিল, মিরাজ, জাম্বু, জুয়েল, কাজল, হেমায়েত, আসলামদের কাছে রোজগারের বিষয়ে জানতে চাইলে সবাই কষ্টের কথাগুলো অকপটে জানান।
রাজাপুর উপজেলার ভাতকাঠি গ্রামের মোটরসাইকেলচালক কবির হোসেন জানান, আগে যেখানে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০-৭০০ টাকা রোজগার হতো, সেখানে এখন ২০০ টাকাও রোজগার হয় না। এর ফলে মোটরসাইকেল মালিককের ভাড়াও পরিশোধ করতে পারছি না। এ অবস্থায় পরিবার পরিজন নিয়ে দারুন অর্থ কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।
উপজেলার বড়ইয়া গ্রামের মোটরসাইকেলচালক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বেকার ছিলেন। গত এক বছর ধরে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালিয়ে কৃষক বাবাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। রাজ্জাক বলেন, ‘বছরের পৌষ-মাঘ এই দুই মাস আমাদের জন্য খুবই কঠিন সময়। এই সময়ে যেমন আমাদের দুর্ঘটনায় বেশি পড়তে হয়, তেমনি রোজগার থাকে না বললেই চলে। তাঁর সাথে আবার যোগ হয়েছে উন্নয়নের মধুর যন্ত্রনা। সারা দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আমরাই গতিশীল রেখেছি। অথচ আমাদের এই দুঃসময় সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
রাজ্জাক আরো বলেন, অনেক মোটরসাইকেলচালক এই মৌসুমে রোজগার না থাকায় ধান কাটা, ইট ভাটাসহ অন্য কাজ করেন। আবার কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েন অনৈতিক কাজে। তাই সার্বিক বিবেচনায় এই শীত মৌসুমে রাষ্ট্রের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।’
রাজাপুরে মোটরসাইকেলচালকদের কোনো বড় সংগঠন নেই। তারা এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট সংগঠন করে নিয়েছেন। তবে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলচালকদের সবার মুরব্বি প্রাক্তন বিডিআর সদস্য সোহরাব খান। সবার অঘোষিত এই নেতা বলেন, ‘ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল গ্রামের অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। যেসব যুবক পূর্বে অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল, তারাও এখন গাড়ি চালিয়ে সৎ পথে উপার্জন করছে। আমরা যারা এই পেশায় রয়েছি, তাদের এই দুই মাস দারুন অভাবে কাটে। সরকার যদি আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়, তবে আমরা এই দুঃসময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকতে পারব।’-কালের কণ্ঠ